অপরাধে নতুন নতুন মুখ, হামলায় ভাড়াটে লোক

  • সহযোগীরাও এখন বড় সন্ত্রাসী।

  • অনেক সন্ত্রাসী স্থানীয়। রাজনীতিকদের সঙ্গে সমঝোতা করে চলেন।

রাজধানীর পল্লবীর ১০ নম্বর সড়কের ইন্টারনেট সংযোগের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এক্সট্রিম সাইবার জোন। ৩ মে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় প্রতিষ্ঠানটিতে একটি ককটেল ছোড়া হয়। এটি বিস্ফোরিত হলে গুরুতর আহত হন প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপক জিসান (৩০)। স্থানীয় লোকজন ধরে ফেলেন মো. রাজু (৩৫) নামের ওই হামলাকারীকে। পরে পুলিশ এসে তাঁকে গ্রেপ্তার করে। তখন রাজু জানান, তিনি পেশায় রিকশাচালক। পাঁচ হাজার টাকার চুক্তিতে এই ককটেল ছুড়েছেন। পরে পুলিশ জানতে পারে, প্রতিষ্ঠানটি থেকে চাঁদা না পাওয়ায় ওই রিকশাচালককে দিয়ে হামলা করান পল্লবী এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী মোক্তার হোসেন।

আরও পড়ুন

এ ঘটনার তদন্তে নেমে পুলিশ তথ্য পায়, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কেউ কেউ এখন চাঁদাবাজির জন্য কাউকে ভয় দেখাতে বা আতঙ্ক সৃষ্টি করতে চোরাগোপ্তা হামলার জন্য লোক ভাড়া করছেন। এ জন্য রিকশাচালক, পথশিশু, ছিন্নমূল মানুষকে বেছে নিচ্ছেন তাঁরা। এভাবে অপরাধজগতে অনেক নতুন মুখ যুক্ত করেছেন সন্ত্রাসীরা।

ভয় দেখাতে চোরাগোপ্তা ককটেল হামলায় রিকশাচালক, পথশিশু, ছিন্নমূল মানুষকেও টাকার বিনিময়ে ব্যবহার করছেন পেশাদার সন্ত্রাসীরা।

এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পল্লবী এলাকার সহকারী কমিশনার শাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে মাঝেমধ্যেই বেনামি নম্বর থেকে বিভিন্নজনের ফোনকল আসে। চাঁদার জন্য কোথাও কোথাও হামলা হয়। তবে হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের পর দেখা যায়, তাঁরা খুবই সাধারণ মানুষ। টাকার বিনিময়ে তাঁদের ভাড়া করা হয়েছে।

অপরাধজগৎ সম্পর্কে জানাশোনা আছে, এমন একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, পেশাদার সন্ত্রাসীদের দলনেতারা সাধারণত তাঁদের সহযোগীদের অর্থ ও অস্ত্রের জোগান দিয়ে থাকেন। গ্রেপ্তার হলে আইনজীবী নিয়োগ, আদালতের খরচ ও কারাগারে ‘ভালো থাকতে’ ব্যবস্থা করেন। বড় ঘটনার পর বিদেশে পালাতে সহায়তা করছেন। পাশাপাশি রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় কমিটিতে নিজেদের অনুগতদের বসাতে নানাভাবে চেষ্টা করেন। এখন তাঁরা নতুন কৌশল নিয়েছেন, নিজেদের ছোটখাটো হামলার ঘটনায় তাঁরা ভাড়া করা লোকজন ব্যবহার করছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে ফাঁকি দিতে তাঁরা এটা করছেন।

রাজু জানান, তিনি পেশায় রিকশাচালক। পাঁচ হাজার টাকার চুক্তিতে এই ককটেল ছুড়েছেন। পরে পুলিশ জানতে পারে, প্রতিষ্ঠানটি থেকে চাঁদা না পাওয়ায় ওই রিকশাচালককে দিয়ে হামলা করান পল্লবী এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী মোক্তার হোসেন।

অল্প টাকার বিনিময়ে সন্ত্রাসীদের দ্বারা ব্যবহৃত এসব লোকজনের কেউ কেউ পরে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়েছেন বলে ধারণা করছেন অপরাধবিশেষজ্ঞরা।

এর বাইরে শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিতি পাননি অথচ রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায় ভয়ের পরিবেশ তৈরি করছেন, এমন দুর্বৃত্তের সংখ্যা এখন ৩০–এর অধিক বলে অনুসন্ধানে জানা গেছে। এর বেশির ভাগই আলোচিত সন্ত্রাসীদের সহযোগী। তাঁরা অনেক ক্ষেত্রে স্থানীয় পর্যায়ের রাজনৈতিক নেতা ও জনপ্রিতিনিধিদের সঙ্গে সমঝোতা করে চলেন।

আরও পড়ুন

র‍্যাবের মুখপাত্র, বাহিনীর আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার আরাফাত ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় মাঝেমধ্যে মধ্যম পর্যায়ের সন্ত্রাসীদের তৎপরতা দেখা যায়। অভিযান চালিয়ে তাঁদের অনেককে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। তিনি বলেন, ‘নিম্ন আয়ের মানুষদের ব্যবহার করে যাঁরা অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা করেন, তাঁদের ওপরও আমাদের নজরদারি আছে।’

নিম্ন আয়ের মানুষদের ব্যবহার করে যাঁরা অপরাধ সংঘটনের চেষ্টা করেন, তাঁদের ওপরও আমাদের নজরদারি আছে।
কমান্ডার আরাফাত ইসলাম, মুখপাত্র, র‍্যাব

যে কারণে ভাড়াটে সন্ত্রাসী দিয়ে হামলা

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সূত্র জানায়, মামলার তদন্তে তথ্যপ্রযুক্তিনির্ভর প্রমাণ উপস্থাপনের চর্চা শুরু করার পর পেশাদার সন্ত্রাসীরা ভাড়াটে লোকজন দিয়ে ককটেল ফাটানো বা ছোটখাটো হামলার ঘটনা ঘটানো শুরু করেন। যাতে তদন্তে মূল সন্ত্রাসীদের নাম সহজে না আসে।

গত তিন মাসে কেবল পল্লবীতেই এমন তিনটি হামলার খবর পাওয়া যায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, বিদেশে পলাতক পল্লবী এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী মোক্তার এই হামলাগুলো করান। এর মধ্যে ৩ মে ইন্টারনেট সংযোগ ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান এক্সট্রিম সাইবার জোনে হামলার আগে মোক্তার একটি বিদেশি নম্বর থেকে ফোন করে চাঁদা চেয়েছিলেন। এই এলাকায় তাঁর মূল সহযোগী মিরপুর–১১ নম্বরের সি ব্লকের মিলন ওরফে চোরা মিলন। ককটেল বিস্ফোরণের জন্য মিলনই ওই রিকশাচালককে ভাড়া করেছিলেন। মিলনের নাম জানাজানি হওয়ার তিনি পালিয়ে যান। পুলিশের কাছে তথ্য রয়েছে, মোক্তারই এই মিলনকে ভারতে নিয়ে যান।

গোয়েন্দা সূত্র জানায়, এর আগে চলতি বছরের ২ ফেব্রুয়ারি পল্লবী থানার ৩ নম্বর ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের নেতা ও স্থানীয় ডিশ ব্যবসায়ী মজিবুর রহমানের কাছে চাঁদা দাবি করেন মোক্তার। চাঁদা না দেওয়ায় গত ১৬ ফেব্রুয়ারি মোটরসাইকেলে করে তিন ব্যক্তি তাঁর পল্লবীর বাসায় গিয়ে গুলি করেন। গুলির শব্দে লোকজন বেরিয়ে এলে সন্ত্রাসীরা মোটরসাইকেল ও একটি পিস্তল ফেলে পালিয়ে যান।

শীর্ষ সন্ত্রাসীদের নামে মাঝেমধ্যেই বেনামি নম্বর থেকে বিভিন্নজনের ফোনকল আসে। চাঁদার জন্য কোথাও কোথাও হামলা হয়। তবে হামলাকারীদের গ্রেপ্তারের পর দেখা যায়, তাঁরা খুবই সাধারণ মানুষ। টাকার বিনিময়ে তাঁদের ভাড়া করা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) পল্লবী এলাকার সহকারী কমিশনার শাহিদুল ইসলাম

সর্বশেষ ১৪ মে মিরপুর–১০ নম্বরের এ ব্লকের ৬ নম্বর রোডে নিউ রোড কিং টায়ার অ্যান্ড ব্যাটারি নামে একটি দোকানে ককটেল হামলা হয়। হামলার আগে দোকানমালিক কাজী মোহাম্মদ হোসেনের কাছে দফায় দফায় চাঁদা চেয়ে হুমকি দেওয়া হয়েছিল।

এসব হামলার বিষয়ে পুলিশের পল্লবী অঞ্চলের সহকারী কমিশনার শাহিদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, কখনো ভাড়াটে সন্ত্রাসী, কখনো আলোচিত সন্ত্রাসীদের সহযোগীরা এই কাজগুলো করেন। ১৪ মে ককটেল হামলার পর হৃদয় হোসেন নামের সন্ত্রাসী মোক্তারের এক সহযোগীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় একাধিক সূত্র জানায়, সহযোগীরা অপরাধ করে গ্রেপ্তার হলে শীর্ষ সন্ত্রাসীরা তাঁদের দায়িত্ব নেন। প্রয়োজনে বিদেশে পালানোর ব্যবস্থা করেন। যেমন মোহাম্মদপুর এলাকার এক শীর্ষ সন্ত্রাসীর হয়ে এখন কাজ করেন বাদল। চাঁদাবাজি, ভূমি দখল, ছিনতাই, মাদক ব্যবসাসহ নানা অপরাধে তাঁর নাম এসেছে। তাঁর ওপর যখনই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নজরদারি বাড়ে, তখনই তিনি ওই শীর্ষ সন্ত্রাসীর সহায়তায় দেশ ছেড়ে পালান।

ডিএমপির সাবেক কমিশনার নাইম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সন্ত্রাসীদের মূল শক্তির উৎস তাঁদের গডফাদাররা। তাঁদের মদদেই শীর্ষ সন্ত্রাসীরা অপরাধগুলো করেন। তিনি বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অপরাধগুলোর সঙ্গে আর্থিক বিষয় যুক্ত। এ কারণে একজন বড় সন্ত্রাসী মারা গেলে অথবা সক্রিয় না থাকলে সেখানে নতুন কেউ চলে আসেন।

কখনো ভাড়াটে সন্ত্রাসী, কখনো আলোচিত সন্ত্রাসীদের সহযোগীরা এই কাজগুলো করেন।
পল্লবী অঞ্চলের সহকারী কমিশনার শাহিদুল ইসলাম

বাড্ডায় নতুন মুখ যাঁরা

ঢাকার পূর্বাঞ্চলে মতিঝিল এলাকার পরে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের সবচেয়ে বেশি তৎপরতা বাড্ডা এলাকায়। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, এই এলাকায় চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত সন্ত্রাসীদের মধ্যে এখন আলোচিত হচ্ছেন আমজাদ হোসেন ওরফে সোহেল ওরফে চাকু সোহেল, মহিউদ্দিন ওরফে মহি, জাহিদুল ইসলাম, আবুল বাশার ওরফে বাদশা ও মোহাম্মদ রহিম। তাঁদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তারও হন। তাঁরা বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন।

পুলিশের বাড্ডা অঞ্চলের সহকারী কমিশনার রাজন কুমার সাহা প্রথম আলোকে বলেন, ‘সন্ত্রাসী জিসানের সহযোগীদের কিছু তৎপরতা আমাদের নজরে এসেছিল। চলতি বছরের শুরুর দিকে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র, গুলিসহ তাঁদের কয়েকজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। এর বাইরে অন্য যাঁরা সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড করছেন, তাঁদের ওপরও পুলিশের নজরদারি আছে।’

বাড্ডায় জিসানের সহযোগীদের বাইরে মেহেদী গ্রুপ এবং রবিন, ডালিম ও মাহবুব গ্রুপ নামে আরও দুটি পেশাদার অপরাধী চক্র সক্রিয়। এর মধ্যে মেহেদী যুক্তরাষ্ট্রে এবং রবিন, ডালিম ও মাহবুব মালয়েশিয়ায় আছেন। তাঁদের সহোযাগীরা এলাকায় মাদক ব্যবসা, জমি দখল ও চাঁদাবাজিতে জড়িত বলে গোয়েন্দা সূত্র থেকে জানা গেছে।

চাঁদাবাজি, ছিনতাইসহ বিভিন্ন অপরাধে জড়িত সন্ত্রাসীদের মধ্যে এখন আলোচিত হচ্ছেন আমজাদ হোসেন ওরফে সোহেল ওরফে চাকু সোহেল, মহিউদ্দিন ওরফে মহি, জাহিদুল ইসলাম, আবুল বাশার ওরফে বাদশা ও মোহাম্মদ রহিম। তাঁদের কেউ কেউ বিভিন্ন সময়ে গ্রেপ্তারও হন। তাঁরা বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের সহযোগী হিসেবে কাজ করেন।

ছিনতাই, ডাকাতি, চাঁদাবাজি করান তাজ

মিরপুরের কাফরুল এলাকার শীর্ষ সন্ত্রাসী হাবিবুর রহমান ওরফে তাজ। তাঁর বিরুদ্ধে মিরপুর, কাফরুল, পল্লবীসহ বিভিন্ন থানায় হত্যাসহ বিভিন্ন অভিযোগে নয়টি মামলা রয়েছে। একটি মামলায় তাঁর সাজাও হয়েছে। ভারতে পালিয়ে গেলে ২০০৮ সালে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়। বর্তমানে কারাগারে আছেন।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও স্থানীয় লোকজন জানান, তাজ কারাগারে থেকেই মিরপুর–২, ৬ ও ১০ নম্বর এবং বর্ধিত পল্লবী এলাকায় চাঁদাবাজির নিয়ন্ত্রণ করেন তিনি। ডিশ ও ইন্টারনেট ব্যবসা এবং ফুটপাত তাঁর চাঁদাবাজির মূল ক্ষেত্র। তাজের হয়ে এলাকায় চাঁদাবাজির নেতৃত্ব দেন আবুল হোসেন। তাজ একসময় যুবদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

দলীয় পদ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টায় সন্ত্রাসীরা

অনুসন্ধানে জানা যায়, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের অনেকে এলাকায় সহযোগীদের অবস্থান মজবুত করতে রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় কমিটি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করেন। তাঁরা বড় দলগুলোর সহযোগী সংগঠনের স্থানীয় কমিটির গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে নিজের পছন্দের ব্যক্তিকে বসাতে চান।

ডিএমপির একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কোনো দল নেই। অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণের জন্য তাঁরা এলাকায় রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণও নিজেদের কবজায় রাখতে চান। কখনো কখনো প্রশাসনের ওপরও প্রভাব বিস্তার করতে চান। নিজের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে এই কর্মকর্তা বলেন, ‘কয়েক বছর আগে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কাজ করতে গিয়ে মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে অনেক রাজনৈতিক তদবির পেয়েছি। বদলি করে দেওয়ার হুমকিও এসেছে।’

শাহাদাতের ভয়ে ছাত্রলীগের কমিটি হয়নি ১৮ বছর

২০০২ সালে অবিভক্ত ঢাকা মহানগর ছাত্রলীগের মিরপুর থানার কমিটি হয়। এতে সাধারণ সম্পাদক হন মিরপুর এলাকার আলোচিত সন্ত্রাসী শাহাদাত হোসেন। এরপর ১৮ বছরে আর কমিটি করতে পারেনি ছাত্রলীগ। কারণ হিসেবে ছাত্রলীগের একাধিক সূত্র জানায়, কমিটি গঠনের আলোচনা শুরু হলেই শাহাদাতের হুমকি আসত। ফলে কেউ ঝুঁকি নিয়ে কমিটি করতে উদ্যোগী হতেন না। পরে শাহাদাতের সঙ্গে বোঝাপড়ার ভিত্তিতে ২০২০ সালের শেষ দিকে ছাত্রলীগ মিরপুর থানা কমিটি দিতে সক্ষম হয়।

ছাত্রলীগের তৎকালীন একজন গুরুত্বপূর্ণ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ২০০২ সালে কমিটি গঠনের পর ২০০৪ সালে সেই কমিটি ভেঙে দেওয়া হয়েছিল। ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আবার সেই কমিটি পুনর্বহাল করা হয়েছিল। এর পর থেকে যখনই কমিটি দেওয়ার আলোচনা এসেছে, তখনই শাহাদাত ফোন করে হুমকি দিয়েছেন। তাঁর ভয়ে কেউ কমিটি করতে পারেননি।

গতকাল সোমবার বিকেলে শাহাদাত পরিচয় দিয়ে এই প্রতিবেদকের কাছে দুই দফায় ফোন আসে। ইন্টারনেটভিত্তিক কলিং সফটওয়্যারের মাধ্যমে আসা ফোনে তিনি দাবি করেন, গত ১০ বছরে মিরপুরে সংঘটিত কোনো অপরাধে তিনি জড়িত নন। আর ছাত্রলীগের কমিটি নিয়ন্ত্রণের বিষয়ে তাঁর ভাষ্য, ‘একসময় যেহেতু ছাত্রলীগ করতাম, এ কারণে অনেক ছোট ভাইয়ের সঙ্গে আমার কথা হয়। এটা কোনো অপরাধ হতে পারে না।’

কমিটি করতে গেলেই হেলালের ফোন

শাহাদাতের মতো মোহাম্মদপুর এলাকায় বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের কমিটি গঠনের সময় প্রভাব বিস্তারের চেষ্টা করেন কারাগারে থাকা শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমামুল হাসান ওরফে পিচ্চি হেলাল। তিনি একসময় ছাত্রদলের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন।

ছাত্রদলের সাবেক একজন কেন্দ্রীয় নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, ‘মোহাম্মদপুর এলাকায় কমিটি করতে গেলেই পিচ্চি হেলালের ফোন আসত। তিনি তাঁর অনুগতদের এসব পদে বসাতে চান।’ এ ছাড়া স্থানীয় পর্যায়ের একাধিক সাবেক ও বর্তমান জনপ্রতিনিধিসহ আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতার সঙ্গেও পিচ্চি হেলাল যোগাযোগ রক্ষা করে চলেন বলে গোয়েন্দা সূত্রের কাছে তথ্য রয়েছে।

আমাদের রাজনৈতিক নেতারা মুখে সন্ত্রাসবিরোধী কথা বলে থাকেন। কিন্তু দেশের রাজনীতিতে সব সময় সন্ত্রাসীদের কদর ছিল। নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বা চাপে রাখতে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করা হয়। এটিও অপরাধজগতে নতুন মুখ তৈরি হওয়ার অন্যতম কারণ
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক

 ২৭ মামলার আসামি মামুনের বিএনপিতে পদ

শীর্ষ সন্ত্রাসী মফিজুর রহমান (মামুন) পল্লবীর ‘ধ ব্লকের মামুন’ হিসেবে বেশি পরিচিত। তাঁর বিরুদ্ধে অন্তত ২৭টি মামলা রয়েছে। ২০০২ সালে পল্লবী থানায় হামলা চালিয়ে আসামি ছিনিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে আলোচিত হয়েছিলেন মামুন।

পুলিশ জানায়, ২০০১ সালে কিছুদিন কারাভোগ করেন মামুন। এরপর ২০০৪ সালে ভারতে পালিয়ে যান। পাসপোর্ট জালিয়াতি ও অনুপ্রবেশের অভিযোগে ২০০৮ সালে ভারতে গ্রেপ্তার হন। সে দেশে ১০ বছর কারাভোগ করেন। মুক্তি পাওয়ার পর গোপনে দেশে ফিরে মিরপুরের অপরাধজগতে আবার সক্রিয় হন। ২০২১ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি মামুনকে ঢাকায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ। এর অল্প কিছুদিনের মাথায় তিনি জামিনে মুক্তি পান। এরপর তিনি বিদেশে পালিয়ে যান। এই মামুনকেই ২০২২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি পল্লবী থানা বিএনপির ৯১ নম্বর ওয়ার্ড (সাংগঠনিক ওয়ার্ড) কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক করা হয়।

বিশেষজ্ঞদের মতে, রাজনৈতিক পরিচয় যুক্ত হলে সন্ত্রাসীদের মনে বিশ্বাস তৈরি হয় যে অপরাধ করে সমস্যায় পড়লে তাঁদের রক্ষা করার জন্য কেউ আছেন। এ প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্বিবদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক তৌহিদুল হক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের রাজনৈতিক নেতারা মুখে সন্ত্রাসবিরোধী কথা বলে থাকেন। কিন্তু দেশের রাজনীতিতে সব সময় সন্ত্রাসীদের কদর ছিল। নির্বাচনে প্রভাব বিস্তার, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করতে বা চাপে রাখতে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ব্যবহার করা হয়। এটিও অপরাধজগতে নতুন মুখ তৈরি হওয়ার অন্যতম কারণ।’ (শেষ)