টঙ্গী উন্নয়ন কেন্দ্র : হত্যা ও নির্যাতন মামলায় আটক শিশু বেড়েছে

প্রতীকী ছবি

পাঁচ বছরের মধ্যে গত বছর টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালক) বিভিন্ন মামলায় আটক শিশু নিবাসীর সংখ্যা সবচেয়ে বেশি ছিল। গত বছর ওই কেন্দ্রে দিনে গড়ে ৮০৯ জন শিশু নিবাসী ছিল, যা ধারণক্ষমতার আড়াই গুণের বেশি। সমাজসেবা অধিদপ্তরের ওয়েবসাইটের তথ্য অনুসারে, কেন্দ্রটিতে আসন রয়েছে ৩০০।

আর এ বছরের মার্চ মাসে কেন্দ্রে বাস করা শিশুদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলা পর্যালোচনায় দেখা গেছে, হত্যা, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ও মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে হওয়া মামলার সংখ্যা সবচেয়ে বেশি।

সমাজসেবা অধিদপ্তরের তথ্য অনুসারে, কেন্দ্রগুলোয় কখনো কখনো প্রতিদিনই শিশুর সংখ্যা ওঠানামা করে, কখনো কয়েক দিন পর সংখ্যার পরিবর্তন হয়। সে জন্য একটি কেন্দ্রে প্রতিদিনের নিবাসীর সংখ্যা বছরওয়ারি যোগ করে দৈনিক গড় বের করা হয়। তাতে দেখা যায়:

মাদক বহনে শিশুদের যুক্ত করা এবং ছোটখাটো চুরি ও মারামারির ঘটনাগুলোয় শিশুদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার প্রবণতা বাড়ায় আটক শিশুর সংখ্যা বেড়েছে বলে মনে করছেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের এক কর্মকর্তা। আর ওই শিশুদের মামলা পরিচালনা করা আইনজীবীরা বলছেন, জামিনপ্রক্রিয়ার ধীরগতির কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেন্দ্র থেকে যত শিশু কমার কথা, তত কমছে না।

মাদক বহনে শিশুদের যুক্ত করা এবং ছোটখাটো চুরি ও মারামারির ঘটনাগুলোয় শিশুদের বিরুদ্ধে মামলা দেওয়ার প্রবণতা বাড়ায় আটক শিশুর সংখ্যা বেড়েছে বলে মনে করছেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের একজন কর্মকর্তা। আর ওই শিশুদের মামলা পরিচালনা করা আইনজীবীরা বলছেন, জামিন প্রক্রিয়ার ধীর গতির কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে কেন্দ্র থেকে যত শিশু কমার কথা, তত কমছে না।

বাংলাদেশের ২০১৩ সালের শিশু আইন অনুযায়ী, ৯ থেকে অনূর্ধ্ব-১৮ বছরের কোনো ছেলেশিশু আইন লঙ্ঘন করলে তাদের গাজীপুরের টঙ্গী ও যশোরের পুলেরহাটের শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালক) রাখা হয়। মেয়েদের রাখা হয় গাজীপুরের কোনাবাড়ীতে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে (বালিকা)। টঙ্গীর কেন্দ্রে শিশু নিবাসীর সংখ্যা গত বছর বেশি থাকলেও অন্য দুটি কেন্দ্রে তুলনামূলক কম ছিল।

মামলা বেশি হওয়া প্রসঙ্গে সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রতিষ্ঠান শাখার সহকারী পরিচালক এস এম রফিকুল হায়দার প্রথম আলোকে বলেন, অনেক ব্যক্তির মধ্যে সহনশীলতা কম। দেখা গেছে, ছোটখাটো চুরি বা মারামারির ঘটনায় অভিভাবকের সঙ্গে আলোচনা করে মিটিয়ে ফেলার পরিবর্তে মামলা দিয়ে দেন। এসব কারণে আগের চেয়ে মামলার সংখ্যা বেশি।

মাদক ও চুরির মামলা বেড়েছে

টঙ্গীর কেন্দ্রের শিশু-কিশোরদের বিরুদ্ধে হওয়া মামলার নথি বলছে, ঢাকার নিম্নবিত্ত এলাকার এক কিশোরকে গাঁজা বহনের অভিযোগে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে গ্রেপ্তার দেখিয়ে পাঠানো হয়েছে টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে। সে পুলিশকে জানিয়েছে, একেক পোঁটলা গাঁজা নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে দেওয়ার বিনিময়ে সে পেত ৫০ টাকা। এমন ২০ পোঁটলা গাঁজা সে পৌঁছে দিতে পারত।

এ বছরের ২৬ মার্চ টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে  নিবাসী ছিল ৭২১ জন।  ওই নিবাসীদের মধ্যে হত্যার অভিযোগ ১৬৭ জনের বিরুদ্ধে, যা মোট মামলার (৭২১টি মামলা) প্রায় চার ভাগের এক ভাগ। মোট মামলার এক পঞ্চমাংশের বেশি মামলা হলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে। এই আইনে করা মামলার বেশির ভাগই ধর্ষণ ও ধর্ষণে সহযোগিতা করার অভিযোগে। মাদকের মামলা রয়েছে  মোট মামলার  এক পঞ্চমাংশের কম। নিবাসীদের ৬৭ জন চুরি এবং ৪৩ জনের বিরুদ্ধে রয়েছে ডাকাতি ও ডাকাতির প্রস্তুতি মামলা।  

টঙ্গীর কেন্দ্রের আরেক শিশুর বিরুদ্ধে হয়েছে মুঠোফোন চুরির মামলা। মামলার নথি সূত্রে জানা গেছে, টেকনাফের কয়েক নিবাসীর বিরুদ্ধে রয়েছে ইয়াবা বহনের মামলা। ওই শিশুরা বলেছে, সংসারের অভাব-অনটনের মধ্যে নিজেদের খরচ চালানোর জন্য জেনেবুঝে তারা ইয়াবা বহন করেছে।

ওই কেন্দ্রে থাকা ১৬ বছর বয়সী এক কিশোরের বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা হয়েছে। মামলাসূত্রে জানা গেছে, প্রেমের কারণে কিশোরীকে নিয়ে ওই কিশোর বাড়ি ছাড়ে। পরে কিশোরীর পরিবার থেকে কিশোরের বিরুদ্ধে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে অপহরণের অভিযোগে মামলা করা হয়।

এখন সামাজিক অস্থিরতার সঙ্গে পারিবারিক অস্থিরতাও সমানভাবে বেড়েছে। অভিভাবকেরা শিশুদের সামাজিক আচরণ শেখানোর ব্যাপারে অনেকটাই উদাসীন থাকছেন। ফলে, শিশুরা দায়িত্বশীল আচরণ করছে না।
সুহেলী সায়লা আহমদ, সহকারী অধ্যাপক, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়

পুরান ঢাকায় দুই গ্রুপের মারামারির মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে হত্যায় জড়িত থাকার অভিযোগে আটক কিশোরও জামিনের অপেক্ষায় রয়েছে ওই কেন্দ্রে।
এ বছরের ২৬ মার্চ টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রে নিবাসী ছিল ৭২১ জন।  ওই নিবাসীদের মধ্যে হত্যার অভিযোগ ১৬৭ জনের বিরুদ্ধে, যা মোট মামলার (৭২১টি মামলা) প্রায় চার ভাগের এক ভাগ। মোট মামলার এক–পঞ্চমাংশের বেশি মামলা হলো নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে। এ আইনে করা মামলার বেশির ভাগই ধর্ষণ ও ধর্ষণে সহযোগিতা করার অভিযোগে। মাদকের মামলা রয়েছে মোট মামলার এক–পঞ্চমাংশের কম।

নিবাসীদের ৬৭ জন চুরি এবং ৪৩ জনের বিরুদ্ধে রয়েছে ডাকাতি ও ডাকাতির প্রস্তুতি মামলা।

টঙ্গীর শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রের (বালক) তত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ এহিয়াতুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, মা-বাবার বিবাহবিচ্ছেদের কারণে কিছু শিশু পরিবারবিচ্ছিন্ন, তাদের ওপর কোনো নজরদারি নেই। ওই শিশুরা নিজেদের প্রয়োজন মেটাতে আইনের সঙ্গে সংঘাতে জড়ায়। দারিদ্র্যের কারণে কিছু শিশু অপরাধীদের দ্বারা ব্যবহৃত হয়।

আদালতে হাজির হওয়ার দিনে গাড়ি নিয়ে পুলিশ না আসায় অনেক সময় শিশুরা হাজির হতে পারে না। এ কারণে জামিনের প্রক্রিয়া দীর্ঘায়িত হওয়ার ক্ষেত্রে আইনজীবীদের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চাইলে মোহাম্মদ এহিয়াতুজ্জামান বলেন, এটা মাঝেমধ্যে ঘটে। পুলিশের উপস্থিতি ছাড়া শিশুদের আদালতে পাঠানো সম্ভব নয়। তিনি জানান, যেসব শিশুর অভিভাবক রয়েছে, তাদের জামিনের প্রক্রিয়া তুলনামূলক দ্রুত হয়। যাদের অভিভাবক নেই, তাদের আইনি সহায়তা তহবিল থেকে সহায়তা দেওয়া হয়।

পিএইচডি গবেষণার প্রয়োজনে শিশু উন্নয়ন কেন্দ্রগুলো থেকে ২০১৮ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তথ্য সংগ্রহ করেছেন খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের মানবিক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক সুহেলী সায়লা আহমদ। তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এখন সামাজিক অস্থিরতার সঙ্গে পারিবারিক অস্থিরতাও সমানভাবে বেড়েছে। অভিভাবকেরা শিশুদের সামাজিক আচরণ শেখানোর ব্যাপারে অনেকটাই উদাসীন থাকছেন। ফলে, শিশুরা দায়িত্বশীল আচরণ করছে না।

টঙ্গীর কেন্দ্রের কিশোরদের প্রসঙ্গে সুহেলী সায়লা আহমদ বলেন, সেখানে যেসব শিশু আছে, তাদের এমনিতেই যথাযথ সামাজিকীকরণ হয় না। ওই শিশুরা পারিবারিকভাবে সুবিধা থেকে বঞ্চিত। স্কুলের প্রতি অনীহা এবং অভিভাবকদের অবহেলা ওদের অপরাধমূলক কাজে উসকানি দিচ্ছে।