‘স্পাইডারম্যানদের’ ভয়ে রাজধানীবাসী

নাম ইসমাইল হোসেন। তবে শাগরেদদের কাছে তিনি পরিচিত ‘স্পাইডারম্যান’ (মাকড়সা-মানব) হিসেবে। মাকড়সার মতো দেয়াল ও ভবনের পাইপ পেয়ে উঠে যেতে পারেন বলে তাঁর এই পরিচিতি।

অবশ্য পুলিশের চোখে ইসমাইল একজন পেশাদার চোর। ঢাকায় যেসব চোর গ্রিল কেটে চুরিতে সিদ্ধহস্ত, তাঁদের একজন ইসমাইল। তাঁর দলে ২০ জন সদস্য রয়েছেন। এঁদের বেশির ভাগ তথ্যদাতা হিসেবে কাজ করেন। তথ্যের ভিত্তিতে ইসমাইল নিজের শাগরেদদের নিয়ে চুরি করেন।

ঢাকায় ইসমাইলের মতো কয়েকজন গ্রিলকাটা চোরকে গ্রেপ্তার ও তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদের ভিত্তিতে পুলিশ জানিয়েছে, চোররা বেশি সক্রিয় থাকে বড় ছুটির সময়। এই সময় সাধারণত মানুষ বাসা খালি রেখে বেড়াতে যায়। কোন বাসা খালি, তা চোরেরা আন্দাজ করে বাতি দেখে। কোনো বাসায় যদি সন্ধ্যার সময় বাতি না জ্বলে, তাহলে চোররা ধরে নেয় বাসাটি খালি।

রাজধানীবাসীর জন্য গ্রিলকাটা চোরেরা এখন বড় আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কারণ, এ ধরনের চুরি বাড়ছে। ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) হিসাবে, ২০২২ সালে ঢাকায় বাসাবাড়িতে ৭১৩টি সিঁধেল চুরির মামলা হয়েছে, যা আগের বছরের চেয়ে ২৩ শতাংশ বেশি। উল্লেখ্য, গ্রিল কেটে চুরির ঘটনাগুলোকেই সিঁধেল চুরি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে পুলিশ।

এদিকে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মামলার চেয়ে প্রকৃত চুরির ঘটনা অনেক বেশি। কারণ, অনেক ক্ষেত্রেই চুরির ঘটনায় ভুক্তভোগীরা মামলার ঝামেলায় যেতে চান না। মামলা করলে মালামাল উদ্ধার হবে, সেই আশাও অনেকের নেই। কারও কারও অভিযোগ, পুলিশ চুরির মামলায় তদন্তে আগ্রহ দেখায় না। চোরদের শাস্তি নিশ্চিত করতে লেগে থাকে না। অনেক ক্ষেত্রে তদন্ত না করে মামলায় চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। ফলে একই চোরেরা বছরের পর বছর চুরি করে যায়।

ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার (অপরাধ) বিপ্লব বিজয় তালুকদার প্রথম আলোকে বলেন, চুরির ঘটনা পুলিশ তদন্ত করতে চায় না, এটা ঠিক নয়। মামলা হলে তদন্ত হবে। দীর্ঘদিন ধরে মামলা তদন্ত করেও প্রমাণ করা না গেলেই শুধু চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

পুলিশ জানিয়েছে, ‘স্পাইডারম্যন’ ইসমাইল জামিনে বেরিয়ে গেছেন। দুই শাগরেদসহ ইসমাইলকে গত সেপ্টেম্বরে গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। কারণ ছিল, ইসমাইল গত বছরের এপ্রিলে ঢাকার ইস্কাটনে ১০ তলা ভবনের নবম তলায় উঠে গ্রিল কেটে সাড়ে ১২ লাখ টাকার মালামাল চুরি করেছিলেন। বাসাটির রান্নাঘরের গ্রিল কেটে ভেতরে ঢোকেন।

জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে ডিএমপির সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, ইসমাইল অত্যন্ত চতুর। চুরির সময় তিনি মুঠোফোন বন্ধ রাখেন, যাতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে তাঁকে শনাক্ত করা না যায়। তিনি থাকতেন কেরানীগঞ্জে। সেখান থেকে ঢাকায় এসে চুরি করতেন। জামিনে বেরিয়ে এখন ইসমাইল কোথায় আছেন তা জানাতে পারেননি পুলিশ কর্মকর্তারা।

গ্রিল কেটে চুরি করতে গিয়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনাও ঘটছে। ৯ জানুয়ারি ঢাকার তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের কুনিপাড়ায় একটি কারখানায় গ্রিল কেটে চুরি করতে গিয়েছিলেন হানিফ নামের এক ব্যক্তি। পুলিশ বলছে, চুরিতে বাধা দেওয়ায় তিনি নিরাপত্তাকর্মী হাশিমকে খুন করে পালান। এ ঘটনায় পুলিশ হানিফকে গ্রেপ্তার করেছে। তিনি দিনে ফেরিওয়ালা সেজে চুড়ি, ফিতা ও প্রসাধনী বিক্রি করার আড়ালে ঘুরে ঘুরে কোন ভবনে চুরি করা যায়, তা ঠিক করতেন। রাতে বাসা, অফিস ও কারখানায় গ্রিল কেটে অথবা ভেঙে চুরি করতেন।

ডিএমপির সভায় উদ্বেগ

ডিএমপিতে ১৮ জানুয়ারি ডিসেম্বর মাসের অপরাধ পর্যালোচনা সভা হয়। পুলিশ সূত্র জানায়, সভায় ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক বাসাবাড়িতে চুরির ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেন। এ ধরনের চুরি প্রতিরোধে তিনি মাঠপর্যায়ের পুলিশ কর্মকর্তাদের জোর দিতে বলেন।

ডিএমপির আলোচনায় উঠে আসে যে চুরির ঘটনায় অধিকাংশ ক্ষেত্রে মালামাল উদ্ধার হয় না, আসামি গ্রেপ্তার হয় না। মামলার রহস্য উদ্‌ঘাটন না করে অনেক ক্ষেত্রে আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।

অভিযোগ আছে, একজন চোরের শাস্তি নিশ্চিত করতে যেভাবে গুরুত্ব দিয়ে তদন্ত দরকার, আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া দরকার, বিচারের পর্যায়ে সাক্ষ্য দেওয়া দরকার, তা পুলিশের পক্ষ থেকে করা হয় না। ডিএমপির উপকমিশনার পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশে অনিচ্ছা জানিয়ে প্রথম আলোকে বলেন, গুরুত্বপূর্ণ মামলার তদন্ত তদারকিতে ডিএমপির একটি ‘মনিটরিং সেল’ রয়েছে। এর সভায় মূলত খুন, ধর্ষণ, ডাকাতি, ছিনতাই ও অপহরণ—এই পাঁচ ধরনের মামলা নিয়ে আলোচনা হয়। তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের কাছে এসব মামলার তদন্তের অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাওয়া হয়। চুরির মামলার অগ্রগতির বিষয়ে জানতে চাওয়া হয় না। এ কারণে চুরির ঘটনা নিয়ে খুব বেশি মনোযোগ দিতে চায় না থানা-পুলিশ।

ডিএমপি গত সেপ্টেম্বরে আজিজুল ফকির নামে ‘চোরচক্রের’ এক প্রধানকে গ্রেপ্তারের পর সংবাদ সম্মেলন করেছিল। পুলিশ তখন জানিয়েছিল, গ্রিল কেটে চুরিতে পারদর্শী। তাঁর নেতৃত্বে পাঁচ শতাধিক চুরির ঘটনা ঘটেছে। যোগাযোগ করা হলে আজিজুল গতকাল সন্ধ্যায় মুঠোফোনে প্রথম আলোকে বলেন, তিনি অনেক আগেই জামিনে বেরিয়ে গেছেন।

‘ছোট অপরাধে’ ব্যক্তির বড় ক্ষতি

রাজধানীতে বহুতল ভবনে নিরাপত্তাকর্মী নিয়োগ করা হয়। আবার এলাকাভিত্তিক নৈশপ্রহরীও থাকে। এলাকাবাসী নিজেরা অর্থ ব্যয় করে নিরাপত্তার এই ব্যবস্থা করেন। বাসায় তালা তো থাকেই। ওদিকে জনগণের করের টাকায় ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় ক্লোজড সার্কিট (সিসিটিভি) ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। সাধারণ মানুষের অনেকেও বাসায় সিসিটিভি ক্যামেরা লাগিয়েছেন। এরপরও নিরাপদ থাকা যাচ্ছে না।

ভুক্তভোগীদের কেউ কেউ বলছেন, চুরি ঠেকাতে হলে চোরের বিচার নিশ্চিত করতে হবে। যদি ধরা পড়ার পর কয়েক মাস কারাগারে থেকে জামিনে বেরিয়ে আসা যায়, মামলার বিচার শেষ না হয়, তাহলে চোরেরা তো উৎসাহিত হবেই। পুলিশের কাছে চুরি একটি ছোট অপরাধ হতে পারে, ভুক্তভোগীর কাছে সেটি সারা জীবনের সঞ্চয় অথবা সম্পদ হারানো। অনেক পরিবারই আর্থিকভাবে সংকটে পড়ে যায় চুরির কারণে। এখন খুনের ঘটনাও ঘটছে।

ঢাকার হাতিরঝিলের আবরার হোসেন নামের এক ব্যক্তির বাসায় গত বছরের মে মাসে চুরি হয়। চোরেরা পাঁচ ভরি সোনার গয়নাসহ ১০ লাখ টাকার মালামাল চুরি করে। ঘটনার প্রায় ৯ মাস পেরিয়ে গেলেও চোরদের শনাক্ত করতে পারেনি পুলিশ।

মামলাটির খোঁজ রাখেন আবরারের স্বজন ইশতিয়াক ইমন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশ সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনা করেছে। তবে চোর শনাক্ত করতে পারেনি। পুলিশ বিভিন্ন সময় বলেছে, সিসি ক্যামেরা কোনো ফুটেজ অস্পষ্ট, কোনোটির ফুটেজ সংরক্ষণ করা হয়নি। কাউকে শনাক্ত করতে না পেরে পুলিশ এখন মামলায় আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়ার কথা বলছে।

ইশতিয়াক বলেন, গুরুত্ব দিলে পুলিশ চোরদের ধরতে পারত।