কাপড় ও মুরগি বিক্রির আড়ালে ডাকাতির তথ্য সংগ্রহ করতেন তাঁরা

এই ডাকাত দলে ডেকোরেটর ব্যবসায়ী ও রিকশাচালক থেকে শুরু করে ভ্রাম্যমাণ কাপড় ও মুরগি বিক্রেতাও রয়েছেন
ছবি: সংগৃহীত

শহরের অলিগলিতে প্রতিনিয়তই ভ্রাম্যমাণ কাপড় ও মুরগি বিক্রেতা দেখা যায়। কেউ কেউ আবার ভ্যানে করে সবজি ছাড়াও বিভিন্ন গৃহস্থালিপণ্য বিক্রি করেন। তবে এসব পেশার আড়ালে ডাকাতির উদ্দেশ্যে বাসাবাড়ির তথ্য সংগ্রহকারী চক্র গড়ে উঠেছে। রাজধানী ঢাকায় এক ব্যাংক কর্মকর্তার বাড়িতে ডাকাতির ঘটনায় কয়েকজনকে গ্রেপ্তারের পর এ ধরনের একটি চক্রের সন্ধান মিলেছে।

পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, এসব পেশার আড়ালে চক্রের সদস্যরা বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে তথ্য সংগ্রহের পর বাসাবাড়িতে ডাকাতির লক্ষ্য ঠিক করেন। পরে চক্রের স্থানীয় সদস্যদের নিয়ে এসব বাসাবাড়িতে ডাকাতি করা হয়।

যেভাবে খোঁজ মেলে চক্রটির

গত ২৫ জুলাই গভীর রাতে রাজধানীর সবুজবাগের দক্ষিণগাঁওয়ে শাহ আহসান হাবিবের বাড়িতে ডাকাতির ঘটনা ঘটে। তিনি একটি সরকারি ব্যাংকের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। এ ঘটনায় গত ১০ থেকে ১৬ আগস্টের মধ্যে ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জে অভিযান চালিয়ে মূল পরিকল্পনাকারীসহ সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়।

পুলিশ জানায়, পরিবারের সদস্যদের হাত-পা ও মুখ বেঁধে তিন লাখ টাকা ও আট ভরি স্বর্ণালংকার নিয়ে পালিয়ে যান মুখোশধারী সাত ডাকাত। পরে আসামিরা স্বর্ণালংকার ডেমরার একটি দোকানে বিক্রি করে দেন।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের কাছ থেকে ১ লাখ ৮৪ হাজার টাকা, একটি সোনার চেইন, এক জোড়া কানের দুল ও একটি আংটি উদ্ধার করেছে পুলিশ। আসামিরা এখন কারাগারে।
পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে জানা গেছে, গ্রেপ্তার সাতজনই বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত। তাঁদের মধ্যে ডেকোরেটর ব্যবসায়ী, রিকশাচালক থেকে শুরু করে ভ্রাম্যমাণ কাপড় ও মুরগি বিক্রেতাও রয়েছেন।

দামি গাড়ি দেখে ডাকাতির পরিকল্পনা

জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে পুলিশ বলছে, আহসান হাবিবের দামি গাড়ি দেখে ডাকাত দল তাঁর বাসায় ডাকাতির পরিকল্পনা করে। গাড়িটির দাম ৩৫ লাখ টাকার মতো। গাড়িটি দেখে ডাকাত দলের সদস্যরা ধারণা করেছিলেন, এ বাসায় বিপুল পরিমাণে নগদ অর্থ ও স্বর্ণালংকার থাকতে পারে। এ ধারণা থেকেই গত ২৫ জুলাই গভীর রাতে কলাপসিবল গেট কেটে পরে শাবল দিয়ে দরজা ভেঙে বাসায় ঢোকে ডাকাত দল।
সবুজবাগ থানার পরিদর্শক (তদন্ত) শেখ আমিনুল বাশার প্রথম আলোকে বলেন, চক্রের প্রধান ফজলুল হক। সবুজবাগের দক্ষিণগাঁও এলাকায় তাঁর একটি রিকশার গ্যারেজ রয়েছে। পাশাপাশি তাঁর ডেকোরেটরের ব্যবসা রয়েছে। জিজ্ঞাসাবাদের বরাত দিয়ে তিনি বলেন, দেড় মাস আগে আহসান হাবিবের পাশের বাসায় একটি বিয়ের অনুষ্ঠানে আলোকসজ্জার কাজ করেন ফজলুল। ওই সময় তিনি আহসান হাবিবের সেই গাড়ি দেখেন। পরে তাঁর ভায়রা কামালকে নিয়ে ডাকাতির পরিকল্পনা করেন।
গত ২০ জুলাই সাতজন মিলে ফজলুলের গ্যারেজে বসে ডাকাতির পরিকল্পনা করেন। তারপর তাঁরা আহসান হাবিবের বাসার আশপাশের পুরো এলাকা রেকি করেন। ২৫ জুলাই রাত ১১টার দিকে তাঁরা আবারও ফজলুলের গ্যারেজে এক হন। দিবাগত রাত দুইটার দিকে ডাকাতির উদ্দেশ্যে বের হন।

আরও পড়ুন

মামলার তদন্তের সঙ্গে যুক্ত কর্মকর্তারা জানান, আহসান হাবিবের বাসা একতলা। সেখানে তিনি স্ত্রী ও এক ছেলেকে নিয়ে বসবাস করেন। ডাকাত দলের সদস্যরা প্রাচীর টপকে ভেতরে ঢোকেন। বাড়ির উঠানে এক ঘণ্টা অবস্থানের পর তাঁরা কলাপসিবল গেট কেটে ভেতরে ঢোকেন। ঘরের মূল দরজা ভাঙেন শাবল দিয়ে। ডাকাত দলের সদস্যরা আহসান হাবিবকে প্রথমে বেঁধে ফেলেন। পরে তাঁর ছেলেকেও বাঁধা হয়। আহসান হাবিবের স্ত্রীকে চড়থাপ্পড় দিয়ে চাবি নিয়ে আলমারি খুলে তিন লাখ টাকা ও আট ভরি স্বর্ণালংকার লুট করে পালিয়ে যান।

ব্যাংক কর্মকর্তা শাহ আহসান হাবিব প্রথম আলোকে বলেন, পাশের বাসায় বিয়ের অনুষ্ঠানে আলোকসজ্জার সময় ফজলুল তাঁর বাসায় এসেছিলেন। ছাদে গিয়ে আলোকসজ্জার কাজও করেছেন। গ্রেপ্তারের পর তাঁকে দেখে তিনি চিনতে পেরেছেন। তিনি বলেন, যে গাড়ির কথা বলা হচ্ছে, সেটি তিনি ২০২০ সালে পদোন্নতি পাওয়ার পর ব্যাংক থেকে দেওয়া হয়েছে। এটি সরকারি সম্পত্তি।

ভিন্ন পেশার আড়ালে ডাকাতি

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা সবুজবাগ থানার উপপরিদর্শক (এসআই) মাসুদ জমাদ্দার। তিনি জানান, আহসান হাবিবের বাসায় কোনো ক্লোজড সার্কিট (সিসি) টেলিভিশন ক্যামেরা নেই। আশপাশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ সংগ্রহ করে ডাকাত দলের সদস্যদের চিহ্নিত করা হয়। পরে তথ্যপ্রযুক্তির সহায়তায় চক্রের সাত সদস্যকে গ্রেপ্তার করা হয়।

এসআই মাসুদ জমাদ্দার জানান, ১০ আগস্ট ঢাকার বিভিন্ন এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় তিনজনকে। তাঁরা হলেন ডাকাতির দুই পরিকল্পনাকারী ফজলুল হক ও কামাল এবং ডাকাত দলের সদস্য ইসমাইল হোসেন ইউসুফ। এরপর ১৩ আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয় আলম হোসেনকে। ১৬ আগস্ট গ্রেপ্তার করা হয় বাদশাহ সরদার ও রমজান আলীকে। ডাকাত দলের সদস্যদের সহায়তাকারী হিসেবে মাহবুব নামের একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

আরও পড়ুন

পুলিশ জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার সাতজনই বিভিন্ন পেশায় নিয়োজিত বলে জানিয়েছেন। ফজলুল হকের রিকশার গ্যারেজ রয়েছে। কামাল ও বাদশাহ রিকশাচালক। ইসমাইল হোসেন ভ্রাম্যমাণ কাপড় বিক্রেতা। আলম বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে মুরগি বিক্রি করেন। রমজান আলী নারায়ণগঞ্জে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। আর মাহবুব ভ্যানচালক।

এসআই মাসুদ জমাদ্দার বলেন, এসব পেশার আড়ালে তাঁরা বিভিন্ন এলাকায় ঘুরে তথ্য সংগ্রহের পর বাসাবাড়িতে ডাকাতির লক্ষ্য ঠিক করেন। তাঁরা মূলত ঢাকার আশপাশের এলাকাতেই ডাকাতি করেন। এসআই জানান, ডাকাতির সোনা ডেমরার সারুলিয়ার স্বর্ণ ব্যবসায়ী বীরেন্দ্রনাথের কাছে বিক্রি করা হয়। ডাকাত দলের সদস্যদের গ্রেপ্তারের খবর পেয়ে তিনি পালিয়ে গেছেন।