আদালতের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে এখন ক্লান্ত: ২৩ বছর আগে নিহত ছাত্রলীগ নেতার ভাই

২০০০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম নগরের পাঁচলাইশ শুলকবহর এলাকার বাসায় ঢুকে ছাত্রলীগ নেতা পুলক বিশ্বাসকে গুলি করে সন্ত্রাসীরা
ছবি: সংগৃহীত

২৩ বছর আগে বাসায় ঢুকে চট্টগ্রাম নগর ছাত্রলীগের এক নেতাকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। ইসলামী ছাত্রশিবিরের দুর্ধর্ষ ক্যাডার হিসেবে পরিচিত সাজ্জাদ আলী খান ও তাঁর সহযোগীরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটান বলে পুলিশের তদন্তে উঠে আসে। তবে প্রায় দুই যুগ হতে চললেও এ মামলার বিচারপ্রক্রিয়া এখনো সাক্ষ্য গ্রহণ পর্যায়ে রয়ে গেছে। এর মধ্যে গত মাসে তদন্ত কর্মকর্তা পুলিশের পরিদর্শক তৌহিদ কবির মারা গেছেন। কিন্তু এত দিনেও তাঁর সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি।

এদিকে আসামিদের মধ্যে মাত্র একজন কারাগারে আছেন। আরেকজন জামিনে। আর দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে পরিচিত শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ ও হাবিব খান রয়েছেন বিদেশে।
এ অবস্থায় এই হত্যাকাণ্ডের বিচার পাওয়ার আশা ছেড়ে দিয়েছে ছাত্রলীগের নেতা নিহত পুলক বিশ্বাসের পরিবার। মামলার বাদী ও নিহত ব্যক্তির ভাই রূপক বিশ্বাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘আদালতের বারান্দায় ঘুরতে ঘুরতে এখন আমি ক্লান্ত। কবে, কোথায়, কার কাছে গেলে বিচার পাব, জানি না।’

নিহত পুলক বিশ্বাস নগরের পাঁচলাইশ শুলকবহর ওয়ার্ড ছাত্রলীগের নেতা ছিলেন। এ ছাড়া তিনি নগরের এমইএস কলেজ ছাত্রলীগের সঙ্গেও জড়িত ছিলেন।

২০০০ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি নগরের পাঁচলাইশ শুলকবহর এলাকার আবদুল হামিদ সড়কের বাসায় ঢুকে পুলককে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। তাঁর বুকে ও পিঠে ছয়টি গুলি করা হয়। ঘটনার পরপরই বিক্ষুব্ধ ছাত্রলীগের নেতা–কর্মীরা নগরের মির্জারপুল, জিইসি মোড়সহ কয়েকটি স্থানে সড়কে ব্যারিকেড দেন। এ ঘটনায় পুলকের বড় ভাই রূপক বিশ্বাস বাদী হয়ে পাঁচলাইশ থানায় মামলা করেন। তদন্ত শেষে ২০০২ সালের ১৭ জুন পুলিশ আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। এতে বলা হয়, পূর্ববিরোধের জেরে পুলককে গুলি করে হত্যা করা হয়।

২০০৫ সালের ১৭ জানুয়ারি চার আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে এ মামলার বিচার শুরু হয়। আসামিদের মধ্যে শিবির ক্যাডার সাজ্জাদ ও হাবিব ছাড়াও রয়েছেন আলমগীর ওরফে বাইট্টা আলমগীর ও মাসুদ কামাল। সাজ্জাদ ও হাবিব দীর্ঘদিন ধরে পলাতক। পুলিশ সূত্র জানায়, সাজ্জাদ ভারতে আর হাবিব দুবাইয়ে পলাতক আছেন। এর মধ্যে সাজ্জাদকে দেশে ফিরিয়ে আনতে ২০২১ সালে নগর পুলিশ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমে সেই দেশে চিঠি দেয়। কিন্তু এখনো তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনা যায়নি। তাঁদের দুজনের বিরুদ্ধে সাতটি করে মামলা রয়েছে। অপর আসামিদের মধ্যে আলমগীর কারাগারে আছেন। আর মাসুদ কামাল জামিনে।

আদালত সূত্র জানায়, বর্তমানে চট্টগ্রামের জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালে হত্যা মামলাটি বিচারাধীন রয়েছে। অভিযোগ গঠনের পর থেকে ১৮ বছরে সাক্ষ্য গ্রহণের জন্য তারিখ পড়েছে ৬১ বার। চলতি বছরের ১৯ জানুয়ারি, ২০ ফেব্রুয়ারি, ১১ এপ্রিল, ৪ জুন ও ৮ আগস্ট তারিখ থাকলেও সাক্ষী না আসায় সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি।

মামলায় মোট সাক্ষী ১৩ জন। সাক্ষ্য গ্রহণ হয়েছে বাদীসহ মাত্র তিনজনের। সর্বশেষ গত বছরের ১২ অক্টোবর একজনের সাক্ষ্য গ্রহণ হয়। আগামী ৫ অক্টোবর মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তৌহিদ কবিরের সাক্ষ্য গ্রহণের দিন রয়েছে। কিন্তু গত ২৩ জুন হার্ট অ্যাটাকে তৌহিদ কবির মারা যান বলে তাঁর স্ত্রী রোজিনা আক্তার জানিয়েছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, সাক্ষ্য দিতে কয়েকবার গিয়েছিলেন, তবে সাক্ষ্য গ্রহণ হয়নি।

এত বছরেও কেন মামলা নিষ্পত্তি করা যায়নি জানতে চাইলে জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি মো. জাহাঙ্গীর আলম প্রথম আলোকে বলেন, ধার্য দিনে সাক্ষীদের হাজির করা যায় না। সমন পেয়েও অনেকে আসেন না। ব্যক্তিগতভাবে যোগাযোগ করে অনেক সাক্ষীকে হাজির করা হচ্ছে। এত দিন হওয়ায় মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির চেষ্টা চলছে।

সাক্ষীদের হাজির করার দায়িত্ব পুলিশের। জানতে চাইলে নগর পুলিশের অতিরিক্ত উপকমিশনার (প্রসিকিউশন) কামরুল হাসান বলেন, সাক্ষীদের মধ্যে যেসব পুলিশ সদস্য আছেন, তাঁরা নানা জায়গায় বদলি হয়েছেন। তাঁদের তালিকা করে মামলার ধার্য দিনে আদালতে হাজির করা হচ্ছে। এ মামলা নিষ্পত্তির জন্য দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে।

মামলার বিচারপ্রক্রিয়ায় ধীরগতি নিয়ে হতাশ বাদী রূপক বিশ্বাস। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘এত বছর দল ক্ষমতায়। তারপরও ভাই হত্যার বিচার হয়নি। দ্রুত বিচার শেষ হবে, সেই আশায় নিয়মিত আদালতে গিয়ে মামলার খোঁজ নিতাম। এখন আর পারি না। কত দিন, কত বছর আদালতের বারান্দায় ঘুরব?’

এত বছরেও ছাত্রলীগ নেতা পুলক বিশ্বাস হত্যার বিচার না হওয়া তাঁদের জন্য লজ্জার বলে উল্লেখ করেন নগরের ওমরগণি এমইএস কলেজ ছাত্রলীগের সাবেক জিএস ও মহানগর ছাত্রলীগের দপ্তর সম্পাদক আরশেদুল আলম। আজ সোমবার সন্ধ্যায় তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘ছাত্রলীগের নিবেদিত প্রাণ ছিলেন পুলক। তাঁর বৃদ্ধ মা, ভাইকে কোনো জবাব দিতে পারি না আমরা।’