সিআইডির এসআইয়ের নেতৃত্বে অপহরণকারী চক্র

ব্যবসায়ীকে অপহরণ করে সোয়া পাঁচ লাখ টাকা মুক্তিপণ আদায়ে গ্রেপ্তার পাঁচজন। তাঁরা হলেন বাঁ সিআইডির এসআই রেজাউল করিম, কনস্টেবল আবু সাঈদ, মো. ইমন সরদার, আব্দুল্লাহ আল ফাহিম ও মো. শরীফ হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

‘আমি সিআইডির ওসি রবিউল বলছি, আপনার নাম কি মোস্তাফিজ? আগামীকাল দুপুরের মধ্যে মালিবাগে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) কার্যালয়ে এসে দেখা করবেন’—ফোনে এভাবে ডাকা হয়েছিল ব্যবসায়ী মোস্তাফিজুর রহমানকে। পরদিন রাজধানীর ভাটারা এলাকার বাসা থেকে সিআইডি পরিচয়ে তাঁকে ধরে নিয়ে যান কয়েকজন ব্যক্তি। পূর্বাচলের একটি এলাকায় আটকে নির্যাতন করে তাঁর কাছ থেকে ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়।

গত অক্টোবরের এ ঘটনায় মোস্তাফিজুরের দায়ের করা মামলা তদন্ত করে পাঁচজনকে গ্রেপ্তার করেছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) একজন উপপরিদর্শক (এসআই) ও একজন কনস্টেবল রয়েছেন। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, সিআইডির এসআই রেজাউল করিম (৩৯) ও কনস্টেবল আবু সাঈদ (৩২) এই অপহরণকারী চক্রের নেতৃত্ব দিতেন। তাঁরা সিআইডি পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে ডেকে অপহরণ করে পূর্বাচলের নির্জন এলাকায় নিয়ে যেতেন। সেখানে আটকে নির্যাতন করে অপহরণের শিকার ব্যক্তির কাছ থেকে লাখ লাখ টাকা আদায় করতেন।

গ্রেপ্তার চক্রের অপর তিন সদস্য হলেন আবদুল্লাহ আল ফাহিম (২১), মো. শরীফ হোসেন (২৬) ও মো. ইমন সরদার (২১)। তাঁদের মধ্যে আবদুল্লাহ আল ফাহিম ভুক্তভোগী মোস্তাফিজুরের বন্ধু, শরীফ এসআই রেজাউলের ব্যক্তিগত গাড়িচালক। আর ইমন একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে চাকরি করেন। মোস্তাফিজুর রহমানকে অপহরণ করে টাকায় নেওয়ার কথা স্বীকার করে ইমন আদালতে জবানবন্দি দিয়েছেন।

ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও ডিবি প্রধান হারুন অর-রশীদ আজ সোমবার সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ভুক্তভোগী মোস্তাফিজুর রহমান গত ৩১ অক্টোবর ভাটারা থানায় তাঁকে অপহরণের পর নির্যাতন করে টাকা আদায়ের ঘটনায় মামলা করেন। ওই মামলা তদন্ত করে ডিবি প্রথমে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাঁদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে সিআইডির এসআই রেজাউল ও কনস্টেবল সাঈদকে গ্রেপ্তার করা হয়। তিনি বলেন, এই পুলিশ সদস্যরা দীর্ঘদিন ধরে এই অপরাধ করে আসছেন।

তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রেজাউল নিজেকে সিআইডির ওসি রবিউল পরিচয় দিয়ে বিভিন্ন অভিযোগের কথা বলে ব্যবসায়ী ও চাকরিজীবীদের ফোন করে দেখা করতে বলতেন। দেখা করতে এলে তাঁকে অপহরণ করা হতো। আর দেখা করতে না এলে ওই ব্যক্তির মুঠোফোনের সর্বশেষ অবস্থান জেনে তাঁর বাসায় হানা দিতেন। তখন এসআই রেজাউলের গায়ে সিআইডি লেখা জ্যাকেট, কোমরে ওয়াকিটকি ও পিস্তল থাকত। কনস্টেবল সাঈদও সিআইডির জ্যাকেট পরে থাকতেন।

সিআইডির মুখপাত্র পুলিশ সুপার আজাদ রহমান আজ প্রথম আলোকে বলেন, অপরাধে জড়িত এই দুই সিআইডি সদস্যকে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। তদন্ত শেষে তাঁদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

মামলার বাদী মোস্তাফিজুর রহমান জানান, তিনি ‘বায়িং হাউসের’ ব্যবসার সঙ্গে জড়িত। বাবার চিকিৎসার জন্য সম্প্রতি জমি বিক্রি করে ৬ লাখ ২৫ হাজার টাকা তাঁর ব্যাংক অ্যাকাউন্টে রেখেছিলেন। তাঁর এক পরিচিত ব্যক্তির মাধ্যমে এই টাকার খবর পান সিআইডির দুই সদস্য। এর কয়েক দিন পর ৭ অক্টোবর এসআই রেজাউল ওসি পরিচয় দিয়ে তাঁকে ফোন করেন।

মোস্তাফিজুর প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি সিআইডি কার্যালয়ে গিয়ে দেখা না করায় তাঁরা গত ৮ অক্টোবর আমার ভাটারার বাসায় এসে জোর করে আমাকে তুলে নেন। পরে পূর্বাচলের নির্জন এলাকায় আটকে প্রায় আট ঘণ্টা রেখে নির্যাতন করেন। ২০ লাখ টাকা না দিলে আমাকে হত্যার হুমকি দেন। নির্যাতনের একপর্যায়ে বলি, আমার অ্যাকাউন্টে ছয় লাখ টাকা আছে। পরদিন নিকুঞ্জ এলাকার একটি ব্যাংক থেকে আমাকে দিয়ে পাঁচ লাখ টাকা তুলে নেন রেজাউল ও তাঁর সহযোগীরা।’ তিনি বলেন, টাকা নেওয়ার পর তাঁকে ছেড়ে দেওয়ার আগে দুটি খালি চেক নেন তাঁরা।
গ্রেপ্তার ইমন গত ৩ ডিসেম্বর ঢাকার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন।

আদালত সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে ইমন বলেছেন, সিআইডির এসআই রেজাউলের নির্দেশে তিনি আবদুল্লাহ আল ফাহিমের কাছ থেকে মোস্তাফিজুর রহমানের ফোন নম্বর সংগ্রহ করেন। ওই ফোন নম্বরের সূত্র ধরে পরে মোস্তাফিজের অবস্থান চিহিৃত করে তাঁরা তাঁর বাসায় যান। মোস্তাফিজকে অপহরণ করে পূর্বাচলে নিয়ে মারধর করেন এসআই রেজাউল। পরে মোস্তাফিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে প্রথম তিন লাখ এবং পরে দুই বার এক লাখ করে দুই লাখ টাকা তুলে নেন তাঁরা। পরে মুঠোফোনে আরও ২০ হাজার টাকা নিয়ে তাঁকে ছেড়ে দেওয়া হয়।