নির্যাতনের শিকার মাত্র ১% নারী পুলিশের সহায়তা চান

নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে পুলিশি সক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা শীর্ষক মতবিনিময় সভায় বক্তারা। রোববার রাজধানীর তেজগাঁওয়ে উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষেছবি: প্রথম আলো

সামাজিক সংস্কার ও সংস্কৃতি, বিচারপ্রক্রিয়া সহজ ও স্বচ্ছন্দ না হওয়ায় নির্যাতনের শিকার হয়েও বিচার চাইতে অনাগ্রহ দেখান নারীরা। নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে প্রতিকার দিতে অনেকগুলো আইন থাকলেও তার যথাযথ প্রয়োগ নেই। ফলে পারিবারিক, শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হলেও মাত্র ২ দশমিক ৬ শতাংশ নারী পুলিশের কাছে, বেসরকারি সংস্থা (এনজিও) ও গ্রাম্য সালিসে বিচার চান। এর মধ্যে পুলিশের কাছে আইনি সহায়তা চান বা মামলা করেন মাত্র ১ দশমিক ১ শতাংশ নারী। রোববার ঢাকা মহানগর পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগ আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এসব তথ্য উঠে আসে।
রাজধানীর তেজগাঁওয়ে উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের কার্যালয়ের সম্মেলনকক্ষে ‘নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে পুলিশি সক্ষমতা ও সীমাবদ্ধতা’ শিরোনামে মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। সভায় বক্তারা বলেন, নারী নির্যাতন প্রতিরোধে একদিকে সমাজে পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি বদলাতে হবে। অন্যদিকে বিচারপ্রক্রিয়া দ্রুত করতে মামলা দ্রুত করা, অভিযোগের দ্রুত তদন্ত, মেডিকেল প্রতিবেদন ও ডিএনএ পরীক্ষা দ্রুত করা, সাক্ষী আনা এবং বিচার কার্যক্রম দ্রুত করতে হবে। সাক্ষী ও ভুক্তভোগীকেও সুরক্ষা দিতে হবে। পুলিশের জনবল বাড়াতে হবে এবং নারীবান্ধব পুলিশ গঠনে উদ্যোগ নিতে হবে।

মতবিনিময় সভায় মাওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান ও পুলিশবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মুহাম্মদ উমর ফারুক বিভিন্ন সময়ে নারী ও শিশু নির্যাতনের মামলা নিয়ে তাঁর করা গবেষণার তথ্য তুলে ধরে বলেন, নির্যাতনের শিকার নারীদের ২ দশমিক ৬ শতাংশ পুলিশ, এনজিও ও সালিসে বিচার চাইছেন। আর ১ শতাংশের কিছু বেশি অংশ পুলিশের কাছে গিয়ে মামলা করেন। বিচারপ্রক্রিয়ার ধীরগতি এবং যথাযথভাবে আইন প্রয়োগ না হওয়ায় যাঁরা বিচার চাইছেন, তাঁদেরও খুব কমসংখ্যক রায় পাচ্ছেন। শুধু ধর্ষণের ক্ষেত্রেই রায়ের হার মাত্র ১ শতাংশ। নারী নির্যাতন কমাতে শুধু অভিযুক্ত ব্যক্তিদের শাস্তি নিশ্চিত করলেই হবে না। ভুক্তভোগীকে পরিপূর্ণ ন্যায়বিচার পাইয়ে দিতে তাঁর প্রয়োজন অনুযায়ী সহায়তা দিতে হবে। রাষ্ট্র ও অভিযুক্ত ব্যক্তির কাছ থেকে তাঁকে ক্ষতিপূরণ দিতে আইনি ব্যবস্থা নিতে হবে।

বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাসুদা রেহানা বেগম বলেন, নারী নির্যাতনের মামলাগুলোকে জেন্ডার লেন্সে (লিঙ্গভিত্তিক দৃষ্টিতে) না দেখলে ন্যায়বিচার নিশ্চিত হবে না। ধর্ষণের মামলার ক্ষেত্রে ডিএনএ পরীক্ষা বাধ্যতামূলক করায় দীর্ঘসূত্রতা আরও বেড়েছে। কারণ, ডিএনএ ল্যাব অনেক কম। ল্যাবের সংখ্যা বাড়ানো প্রয়োজন। দীর্ঘসূত্রতার কারণে মামলা করেও ফল তুলতে পারছেন না নারীরা। ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টার (ওসিসি) থেকে যেন মামলা করা থেকে শুরু করে সব সেবা এক জায়গা থেকে পাওয়া যায়, সেটা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব পরিবর্তনে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানান তিনি।
বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) সহকারী পরিচালক তাপসী রাবেয়া বলেন, অপরাধের ঘটনা যেখানে ঘটে, শুধু সেখানেই নয়, যেকোনো জায়গা থেকে ভুক্তভোগী মামলা করা ও পরিচালনা করতে পারেন। উচ্চ আদালত এ নির্দেশনা দিলেও এখনো অনেক পুলিশ কর্মকর্তা বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন। তাঁরা তাঁদের থানার আওতাভুক্ত এলাকা না হলে মামলা নিতে চান না। এ সম্পর্কে আরও সচেতনতা সৃষ্টির আহ্বান জানান তিনি।

সভায় পুলিশের দুজন তদন্ত কর্মকর্তা জানান, মামলার পর মেডিকেল, ফরেনসিক ও ডিএনএ প্রতিবেদন পেতেই কয়েক মাস চলে যায়। এ কারণে মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতেও দেরি হয়।
তবে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে স্থাপিত ওসিসির সমন্বয়কারী চিকিৎসক সাবিনা ইয়াসমীন বলেন, পুলিশকে মেডিকেল প্রতিবেদন দিতে কখনো তাঁরা দেরি করেন না। যদি কোনো কারণে প্রতিবেদন পেতে দেরি হয়, তাহলে তাঁদের যেন অবহিত করা হয়। তাঁর মতে, এখন পুলিশ অনেক বেশি নারীবান্ধব। ওসিসিতে ভুক্তভোগী এলে পুলিশকে জানানোর সঙ্গে সঙ্গে পুলিশ ব্যবস্থা নেয়।
উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগের তথ্য অনুসারে, ২০০৯ সালে ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার নামে নারী ও শিশুদের সহায়তা দেওয়া শুরু হয়। স্থাপনের পর থেকে এ পর্যন্ত ২ হাজার ৮৬টি মামলা করা হয়েছে। পারিবারিক বিরোধ নিয়ে অভিযোগ এসেছে ২ হাজার ৬০৪টি।

সভাপতির বক্তব্যে উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগ, ঢাকার উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) হুমায়রা পারভীন বলেন, নারী ও শিশুদের সহায়তায় পুলিশের সদিচ্ছার কোনো অভাব নেই। এ প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন থানা থেকে মামলা স্থানান্তর হয়ে আসে। অনেক সময় ভুক্তভোগী মামলা করতে দেরি করেন, আলামত সংরক্ষণ করতে পারেন না। ফলে মামলার তদন্ত অনেক ক্ষেত্রে বাধাগ্রস্ত হয়। বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের মতামত নিয়ে তাঁরা তাঁদের সেবার মানকে আরও বাড়াতে চান।
সভায় আরও বক্তব্য দেন দলিত ওমেন ফোরামের সাধারণ সম্পাদক মনি রানী দাস, হিজড়া জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি শোভা সরকার, নাগরিক উদ্যোগের কর্মসূচি ব্যবস্থাপক নাদিরা পারভীন, অ্যাসোসিয়েশন ফর কারেকশন অ্যান্ড সোশ্যাল রিক্ল্যামেশন অ্যান্ড সার্টিফায়েড ইনস্টিটিউটের (এসিএসআর) মহাসচিব জাকির হোসেন, ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওসিসির আইনজীবী ফাহমিদা আখতারসহ বিভিন্ন গণমাধ্যমকর্মী।
সভাটি সঞ্চালনা করেন উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশন বিভাগ, ঢাকার অতিরিক্ত উপপুলিশ কমিশনার ইয়াসমিন সাইকা পাশা।