১০ বছর আগে হেফাজতে ইসলামের ঢাকা অবরোধকে কেন্দ্র করে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় রাজধানীসহ সারা দেশে মোট ৮৩টি মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে ২১ মামলার অভিযোগপত্র ও ২টিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে। বাকি ৬০ মামলার তদন্ত এখন থেমে আছে।
হেফাজতে ইসলাম বলছে, সরকারের সঙ্গে তাদের আলোচনা চলছে। তারা আশা করে, মামলাগুলো প্রত্যাহার করা হবে। তবে পুলিশ সূত্র বলছে, মামলাগুলোর কী হবে, তা নিয়ে ‘ওপরের’ সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় রয়েছে তারা। নথিপত্র অনুযায়ী মামলাগুলো ‘তদন্তাধীন’।
২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারিতে রাজধানীর শাহবাগে গণজাগরণ মঞ্চের আন্দোলন চলাকালে কথিত নাস্তিক-ব্লগারদের শাস্তিসহ ১৩ দফা দাবি নিয়ে হঠাৎ আলোচনায় আসে কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। ওই বছরের ৫ মে ঢাকার ছয়টি প্রবেশমুখে অবরোধ কর্মসূচি শেষে মতিঝিলের শাপলা চত্বরে অবস্থান নেন সংগঠনের হাজার হাজার কর্মী-সমর্থক। রাতে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সমন্বিত অভিযানের মুখে তাঁরা ছত্রভঙ্গ হয়ে যান।
জামিন বিচারিক প্রক্রিয়া, জজ সাহেব যাঁকে মনে করেন তাঁকে জামিন দিতে পারেন। বিচারকাজ তো চলছে।
তার আগে হেফাজতের কর্মসূচি ঘিরে পল্টন ও মতিঝিল এলাকায় ব্যাপক ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। পরদিন ৬ মে চট্টগ্রামের হাটহাজারী, নারায়ণগঞ্জ, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, লক্ষ্মীপুর, কক্সবাজারসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে হেফাজতের কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ হয়। দুই দিনে ৩৯ জন নিহত হন। সারা দেশে এসব ঘটনায় হওয়া ৮৩ মামলায় এজাহারে ৩ হাজার ৪১৬ জনের নাম উল্লেখ করে আসামি করা হয়। হেফাজত ছাড়াও ইসলামী ঐক্যজোট, জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী ছাত্রশিবির, নেজামে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, খেলাফত আন্দোলন, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বিএনপি, যুবদল ও ছাত্রদলের নেতা-কর্মীদের মামলাগুলোতে আসামি করা হয়।
যোগাযোগ করা হলে গত বুধবার রাতে হেফাজতে ইসলামের কেন্দ্রীয় যুগ্ম মহাসচিব ও মুখপাত্র মুহিউদ্দিন রব্বানী প্রথম আলোকে বলেন, ‘মামলাগুলো আগের অবস্থায়ই আছে। আমরা স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর (আসাদুজ্জামান খান) সঙ্গে মামলা প্রত্যাহারের ব্যাপারে সাক্ষাৎ করেছিলাম। তিনি আশ্বস্ত করেছেন, এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নেবেন।’ তিনি দাবি করেন, ২০২১ সালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমন উপলক্ষে সারা দেশে হেফাজতের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলো প্রত্যাহারের বিষয় নিয়েও আলোচনা হয়েছে।
মুহিউদ্দিন রব্বানী আরও বলেন, ‘আশ্বাসের সঙ্গে আমরা বাস্তবতার মিল পাচ্ছি। হেফাজতের অনেক কর্মী ইতিমধ্যে জামিনে বেরিয়ে গেছেন। দুই দিন আগেও দুজন কর্মী জামিনে মুক্ত হয়েছেন।’
১০ বছর আগে দেশের বিভিন্ন জেলায় ৮৩টি মামলা হয়েছিল। ২১টিতে অভিযোগপত্র, ২টিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান গতকাল শুক্রবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘জামিন বিচারিক প্রক্রিয়া, জজ সাহেব যাঁকে মনে করেন তাঁকে জামিন দিতে পারেন। বিচারকাজ তো চলছে।’ তিনি বলেন, ‘যদি কেউ ইননোসেন্ট (নির্দোষ) হয়ে থাকেন, তাঁরা বলতেছেন তাঁরা ইননোসেন্ট, সেগুলো আমরা দেখছি যাচাই-বাছাই করে, যাঁরা ইননোসেন্ট, সেভাবেই ব্যবস্থা হচ্ছে।’
২০১৩ সালের তাণ্ডবের ঘটনায় শুধু রাজধানীতেই মামলা হয়েছে ৫৩টি। এ ছাড়া নারায়ণগঞ্জ, চট্টগ্রাম, বাগেরহাট, সাতক্ষীরা, কক্সবাজার ও লক্ষ্মীপুরে আরও ৩০টি মামলা হয়। তখন হেফাজতের মহাসচিব জুনায়েদ বাবুনগরীসহ (প্রয়াত আমির) কয়েকটি দল ও সংগঠনের শীর্ষস্থানীয় ৮৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, সারা দেশের ৮৩ মামলার মধ্যে ঢাকার ৪টি ও ঢাকার বাইরের ১৭টি মামলার অভিযোগপত্র এবং ২টিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন (ফাইনাল রিপোর্ট) দিয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে ১৫টি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছিল ২০১৪ সালেই। এ বিষয়ে গত বৃহস্পতিবার পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র (সহকারী মহাপরিদর্শক-গণমাধ্যম ও জনসংযোগ) মো. মনজুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, হেফাজতের বিরুদ্ধে হওয়া মামলাগুলোর এখনো তদন্ত চলছে। যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে বাকি মামলারও অভিযোগপত্র দেওয়া হবে।
যে মামলাগুলোর অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে, সেগুলোর মধ্যে চারটি বাগেরহাটের। ঢাকার ঘটনাকে কেন্দ্র করে ২০১৩ সালের ৫ ও ৬ মে বাগেরহাটে হেফাজতের কর্মীদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষে দুজন নিহত হন, যাঁরা হেফাজতের কর্মী ছিলেন। এ ঘটনায় জেলার ফকিরহাটে চারটি ও বাগেরহাট সদর থানায় দুটি মামলা করে পুলিশ। এতে হেফাজত, জামায়াত ও স্থানীয় বিএনপির ৮৮ জন নেতা-কর্মীসহ ১০-১২ হাজার জনকে অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। বাগেরহাটের জেলা পুলিশ সূত্র জানায়, এই ছয় মামলার মধ্যে এর আগে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে চারটির। এর মধ্যে ফকিরহাট থানায় করা একটি মামলার রায়ে ২০১৯ সালে প্রায় ৪০০ আসামি খালাস পান। মামলাটিতে সাক্ষীর অভাবে সবাই খালাস পেয়েছেন বলে জানিয়েছে পুলিশ সূত্র। দুটিতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়।
ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্র জানায়, ঢাকার বিভিন্ন থানায় হেফাজতের বিরুদ্ধে করা ৫৩ মামলার মধ্যে মাত্র ৪টির অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। বাকি ৪৯ মামলার মধ্যে ৩৩টি থানা-পুলিশ তদন্ত করছে। মামলাগুলোর তদন্তের তত্ত্বাবধান করছেন ডিএমপির যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব বিজয় তালুকদার। গত বুধবার রাতে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, মামলাগুলো এখনো তদন্তাধীন।
বাকি ১৬টি মামলা তদন্ত করছে ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি)। এ ব্যাপারে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ বৃহস্পতিবার প্রথম আলোকে বলেন, তদন্ত শেষে যেকোনো দিন মামলাগুলোর অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হবে।
হেফাজতের মামলাগুলোর তদন্ত শেষ করতে পুলিশ উদ্যোগী হয়েছিল ২০২১ সালে। ওই বছরের মার্চে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী ও বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশ সফরে আসেন। সে সময় তাঁর সফরের বিরোধিতা করে মাঠে নামে হেফাজত। ঢাকা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, চট্টগ্রাম, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সিগঞ্জ ও কিশোরগঞ্জে হেফাজত ও পুলিশের মধ্যে সংঘর্ষ, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে ১৯ জন নিহত, পুলিশসহ ৫০০ জন আহত হন।
নরেন্দ্র মোদির সফর ঘিরে সহিংসতার পর তখনকার ডিএমপি কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে (২০২১ সালে) বলেছিলেন, পুরোনো মামলাগুলো দ্রুত নিষ্পত্তি করতে পুলিশ সদর দপ্তরের নির্দেশনা এসেছে।
এদিকে বৃহস্পতিবার বর্তমান ডিএমপি কমিশনার খন্দকার গোলাম ফারুক প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৩ সালে শাপলা চত্বরে সহিংস ঘটনায় ডিএমপিতে হওয়া মামলার মধ্যে ৪৯টি তদন্তাধীন। এসব মামলার তদন্ত শেষ করতে তাঁরা কাজ করছেন।