বেশি ভিক্ষা পেতে মেয়ের পায়ে পলিথিন বেঁধে পুড়িয়ে দিতেন তিনি: পিবিআই

প্রতীকী ছবি

বইখাতার বদলে ১১ বছরের মেয়েটির হাতে ভিক্ষার থালা তুলে দিয়েছিলেন তিনি। বেশি ভিক্ষা পেতে মেয়ের পায়ে পলিথিন বেঁধে আগুনে পুড়িয়ে ক্ষত করে দিতেন। সেই সঙ্গে মেয়েকে শিখিয়েছিলেন শারীরিক প্রতিবন্ধীর অভিনয়।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) তদন্ত ও মেয়েটির আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ চট্টগ্রামের বিচারক ফেরদৌস আরা আদালতে ১০ পৃষ্ঠার তদন্ত প্রতিবেদনটি গত মাসে জমা দেন পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো উপপরিদর্শক (এসআই) মো. জাহেদুজ্জামান চৌধুরী। এই ট্রাইব্যুনালে শিশু মামলার বিচার হয়ে থাকে।

ট্রাইব্যুনালের সরকারি কৌঁসুলি খন্দকার আরিফুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, শিশুটিকে অপহরণের অভিযোগে তার মা হোসনে আরা বেগমের ট্রাইব্যুনালে করা মামলার তদন্ত করতে গিয়ে পিবিআই এসব তথ্য পায়।পিবিআই বলছে, হোসনে আরা বেগম ও শিশুটির নয় বছরের আরেক ভাইও ভিক্ষা করে।

মেয়েটি মায়ের জিম্মায় যেতে রাজি হয়নি। আদালতের নির্দেশে তাকে বর্তমানে চট্টগ্রামের ফরহাদাবাদে মহিলা ও শিশু কিশোরী নিরাপদ হেফাজতিদের আবাসনকেন্দ্রে (সেফ হোম) রাখা হয়েছে।

পিবিআই আরও বলছে, মেয়েটির বয়স যখন তিন বছর, তখন তার বাবা মারা যান। তারা দুই ভাই ও এক বোন। মেয়েটি ভাইবোনদের মধ্যে দ্বিতীয়। তাদের স্থায়ী কোনো ঠিকানা নেই। ফুটপাতে ভিক্ষুক মায়ের সঙ্গে বেড়ে ওঠা শিশুটির। বড় ভাই তাদের ছেড়ে চলে গিয়েছে।

মেয়েটি গত ১ জুন চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট মেহনাজ রহমানের খাস কামরায় দুই পৃষ্ঠার জবানবন্দি দিয়েছে। আদালত সূত্র বলছে, মেয়েটি বলেছে, নগরের প্রবর্তক মোড় বদনা শাহ মাজার গেটে সে মায়ের সঙ্গে ভিক্ষা করত। বেশি ভিক্ষা পেতে ওই হোসনে আরা বেগম মেয়েটির পায়ে পলিথিন পেঁচিয়ে পুড়িয়ে ক্ষত করে দিতেন। আর ভিক্ষার টাকায় তিনি ছক্কা (লুডু) খেলতেন। ছোট ভাইয়ের চিকিৎসার জন্য হোসনে আরা বেগম গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে মেয়েটিকে একটি বাসায় কাজে দেয়। পরে আবার তাকে ভিক্ষা করার জন্য নিয়ে আসতে চায়। কিন্তু মেয়েটি মায়ের কাছে যেতে চায়নি।

পিবিআই বলছে, এতে ক্ষিপ্ত হয়ে হোসনে আরা বেগম এ বছরের ২৭ এপ্রিল নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল-৭ শিশুটিকে অপহরণের অভিযোগে মামলা করেন। এতে বলা হয়, বদনাশাহ মাজারের সামনে থেকে তার মেয়েকে মাইক্রোবাসে করে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয়। এতে আসামি করা হয় মেয়েটি যে বাসায় কাজ করত, সেই বাসার রাশেদুল আলম ও তাঁর স্ত্রী ফারজানা আলী চৌধুরীকে। মামলাটি পিবিআইকে তদন্তের নির্দেশ দেন আদালত।

শুরু থেকে পিবিআই এস আই জাহেদুজ্জামান এটি তদন্ত করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শিশুটিকে অহরণের অভিযোগ করা হলেও ঘটনাস্থলের ক্লোজ সার্কিট (সিসি) ক্যামেরায় দেখা যায়, শিশুটিকে ওই দম্পতির কাছে তুলে দেন হোসনে আরা বেগম। এ কারণে ওই দম্পতিকে জড়িত নন উল্লেখ করে প্রতিবেদন দেওয়া হয়েছে আদালতে। এ ছাড়া কোনো সাক্ষ্য প্রমাণ দিতে পারেননি ওই নারী।

একই কথা বলেছেন চট্টগ্রামের ফরহাদাবাদে মহিলা ও শিশু কিশোরী নিরাপদ হেফাজতিদের আবাসনকেন্দ্র (সেফ হোম) উপতত্ত্বাবধায়ক মোহাম্মদ আলমগীর। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, শিশুটির বাম পায়ে ক্ষতের দাগ রয়েছে। শিশুটির মায়ের কাছে যেতে চায় না জানিয়েছে।

হোসনে আরা বেগম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার মেয়ে আসতে না চাওয়ায় মামলা করেছি।’ অপহরণের মামলা কেন করলেন—এমন প্রশ্নের জবাবে বলেন, ‘এত কিছু বুঝি না।’বেশি ভিক্ষা পাওয়ার জন্য মেয়ের পায়ে ক্ষত সৃষ্টি করে ব্যান্ডেজ লাগিয়ে দেওয়ার বিষয়ে মেয়ের আদালতে জবানবন্দির বিষয়ে তিনি বলেন, ‘দুর্ঘটনায় পায়ে এ রকম দাগ হয়েছে । পুড়িয়ে দিইনি। সংসার চালানোর মতো রোজগারের ব্যবস্থা হলে (চাকরি কিংবা ক্ষুদ্র ব্যবসা) আর ভিক্ষাবৃত্তি করবেন না জানান হোসনে আরা বেগম।’


নগরের বদনা শাহ মাজার এলাকায় গত বুধবার গিয়ে সাতজন ভিক্ষুকের সঙ্গে কথা হয়। তাঁরা বলেছেন, শিশুটির পায়ে প্রায়ই ব্যান্ডেজ লাগিয়ে ভিক্ষা করাতেন তার মা।

সমাজসেবা অধিদপ্তর চট্টগ্রামের উপপরিচালক ফরিদুল আলম বলেছেন, ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান কর্মসূচির আওতায় এনে ওই নারীকে কাজের ব্যবস্থা করা হবে।

আইনি সহায়তা দেওয়া সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) আইন উপদেষ্টা এবং সাবেক জেলা ও দায়রা জজ রেজাউল করিম বলেছেন, শিশুকে ভিক্ষা বৃত্তিতে জড়িত ও অঙ্গহানি করা আইনত অপরাধ। ওই নারীকে কারের ভিক্ষুক পুনর্বাসন ও বিকল্প কর্মসংস্থান কর্মসূচি আওতায় এনে কাজের ব্যবস্থা করে দেওয়া উচিত।