স্বজনদের চাকরি দিতে ‘উদার’ অধ্যক্ষ

বনপাড়া আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ইমদাদুল হক তাঁর স্ত্রী, স্ত্রীর বড় ভাই, ছেলেসহ ৯ আত্মীয়কে নিয়মবহির্ভূতভাবে চাকরি দিয়েছেন।

প্রতীকী ছবি

ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট উপজেলার বনপাড়া আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ মো. ইমদাদুল হকের বিরুদ্ধে আত্মীয়স্বজনকে নিয়মবহির্ভূতভাবে চাকরি দেওয়া, একাধিক ব্যক্তির কাছ থেকে টাকা নিয়েও চাকরি না দেওয়াসহ একাধিক অভিযোগ পাওয়া গেছে। এসব ঘটনায় মামলাও হয়েছে।

প্রতিষ্ঠানটির একাধিক সূত্র জানিয়েছে, অধ্যক্ষ মো. ইমদাদুল হক তাঁর স্ত্রী, স্ত্রীর বড় ভাই, ছেলেসহ ৯ আত্মীয়কে নিয়মবহির্ভূতভাবে চাকরি দিয়েছেন। ভুক্তভোগী একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা হয় এই প্রতিবেদকের। তাঁদের অভিযোগ, চাকরি দেওয়ার কথা বলে উপজেলার এক তরুণীকে নিজের ছেলের সঙ্গে বিয়ে দেন অধ্যক্ষ। একপর্যায়ে চাকরি দেওয়ার কথা বলে তাঁর কাছ থেকে পাঁচ লাখ টাকাও নেন। পরে তাঁর ছেলে ওই তরুণীকে তালাক দেন।

এ ছাড়া পাঁচজনের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের অর্থ নিয়ে নিজ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে এমপিওভুক্ত (মান্থলি পেমেন্ট অর্ডার) হওয়ার জন্য আবেদন করেন অধ্যক্ষ। প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হওয়ার পর তাঁদের প্রতিষ্ঠান থেকে বাদ দেওয়া হয়।

তিনি চাকরি দেওয়ার কথা বলে ১০ লাখ টাকা নিয়েছেন। কিন্তু প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত হওয়ার পর আমাকে বাদ দিয়ে দিয়েছেন।
সরিফুল আলম, জনৈক চাকরিপ্রার্থী

এর মধ্যে টাকা ফেরত ও ন্যায়বিচার চেয়ে অধ্যক্ষ ও তাঁর ছেলের বিরুদ্ধে গত বছরের ১৬ আগস্ট ময়মনসিংহ আদালতে মামলা করেন ভুক্তভোগী তরুণী। মামলাটি চলমান রয়েছে। একই সঙ্গে গত বছরের ২২ ডিসেম্বর জেলা শিক্ষা কার্যালয় ও দুর্নীতি দমন কমিশনে লিখিত অভিযোগ দেন তিনি। মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, গত বছরের ১ জুলাই বনপাড়া আদর্শ স্কুল অ্যান্ড কলেজটি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে এমপিওভুক্ত হয়। এরপর তাঁকে চাকরি না দিয়ে কৌশলে বাবার বাড়ি পাঠিয়ে দেওয়া হয়। বিয়ের ৪৪ দিনের মাথায় তাঁকে একতরফাভাবে তালাক দেন অধ্যক্ষের ছেলে।

সব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন অধ্যক্ষ ইমদাদুল হক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, আত্মীয়স্বজনের সবাইকে নিয়ম মেনে চাকরি দেওয়া হয়েছে। ওই তরুণীর মামলার বিষয়টি ইতিমধ্যে মীমাংসা করা হয়েছে। তাঁর কাছ থেকে কোনো টাকা নেওয়া হয়নি। এ ছাড়া অন্যরা যেসব অভিযোগ করেছেন, সেগুলো ঠিক নয়।

ওই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে অনেকেই শত্রুতা করছেন বলে দাবি করেন ব্যবস্থাপনা কমিটির সভাপতি মজিবুর রহমান। তিনি বলেন, ‘ওই তরুণীকে অধ্যক্ষ তাঁর ছেলের সঙ্গে বিয়ে দিয়েছিলেন। পরে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। এটা নিয়ে মামলায় হয়েছে। এখন শুনছি বিষয়টি নাকি মীমাংসা হয়ে গেছে। চাকরি দেওয়া নিয়ে অর্থ লেনদেন বিষয়টি আমার জানা নেই। যখন নিয়োগ হয়েছে, তখন আমি সভাপতির দায়িত্বে ছিলাম না।’

তবে কোনো মীমাংসা হয়নি বলে দাবি করেছেন ভুক্তভোগী তরুণী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিয়ে হওয়ার পর ল্যাব সহকারী পদে চাকরি দেওয়ার কথা বলে পাঁচ লাখ টাকা চেয়েছিলেন অধ্যক্ষ মো. ইমদাদুল হক। বাবার জমি বন্ধক রেখে, হালের গরু ও ধান বিক্রি করে সব মিলিয়ে পাঁচ লাখ টাকা দিয়েছি। এর এক মাস পর চাকরি না দিয়ে কৌশলে আমাকে বাবার বাড়িতে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। এরপর তাঁর ছেলে তালাকের কাগজ পাঠায়। আমি চাকরি ফেরত ও আমার সঙ্গে করা প্রতারণার বিচার চেয়ে আদালতের মামলা করেছি।’

ওই তরুণী আরও বলেন, ‘অধ্যক্ষ তাঁর আত্মীয়দের জাল সনদ তৈরি করে চাকরি দিয়েছেন। আমাকেও জাল সনদ করে দিতে চেয়েছিলেন।’

প্রতিষ্ঠানটিতে বর্তমানে অধ্যক্ষসহ নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকের জন্য শিক্ষক রয়েছেন ৩৩ জন। এ ছাড়া কর্মচারী রয়েছেন ১১ জন।

প্রতিষ্ঠানটির একাধিক ব্যক্তি নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, অধ্যক্ষ মো. ইমদাদুল হক তাঁর স্ত্রী ইসমতারা অফিস সহায়ক পদে, স্ত্রীর বড় ভাই সহকারী শিক্ষক (আইসিটি) মোস্তফা কামাল ও ছেলে ইমরুল কায়েস ল্যাব সহকারী পদে, ছোট বোন আয়সা খাতুনকে কৃষি শিক্ষক ও বোনজামাই আজিজুল হককে সহকারী শিক্ষক (বাংলা) পদে, দুই ভাগনির মধ্যে শেফালি বেগমকে ল্যাব সহকারী পদে ও ঝরনা আক্তারকে অফিস সহায়ক পদে, ভাগনিজামাই তরিকুল ইসলামকে নৈশপ্রহরী পদে এবং বোনের ছেলে আবু নাঈমকে পরিচ্ছন্নতাকর্মী পদে চাকরি দিয়েছেন।

১৯৯৯ সালে উপজেলার ধুরাইল ইউনিয়নে ৫০ শতক জমিতে বনপাড়া স্কুল অ্যান্ড কলেজ নির্মাণ করা হয়। পরে ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠানটি নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয় হিসেবে এমপিওভুক্ত হয়।

ভুক্তভোগী একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ওই সময় নিম্নমাধ্যমিকের শিক্ষক দিয়ে প্রতিষ্ঠানটি পরিচালনা করতেন অধ্যক্ষ। কাগজে–কলমে প্রভাষক, শিক্ষক, ল্যাব সহকারী, অফিস সহকারী, পিয়ন, নৈশপ্রহরী ও আয়া পদে লোক রয়েছে দেখিয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে এমপিওভুক্ত করার জন্য আবেদন করেন তিনি।

ওই সময় ইতিহাস বিষয়ের প্রভাষক পদে মো. সরিফুল আলম, সহকারী শিক্ষক পদে রাইহানা ইয়াসমিন, মোফাজ্জল হোসেন, মো. রেজাউল ও ল্যাব সহকারী পদে সাবিনা ইয়াসমিনকে নিয়োগ দেওয়ার কথা বলে তাঁদের কাছ থেকে মোটা অঙ্কের টাকা নেন অধ্যক্ষ।

পরে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে এমপিওভুক্তির জন্য আবেদন করেন তিনি। ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠানটি মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে এমপিওভুক্ত হয়। এরপর ওই পাঁচজনকে চাকরি থেকে বাদ দেওয়া হয়। পরে অর্থের বিনিময়ে অধ্যক্ষ এসব পদে অন্য ব্যক্তিদের চাকরি দেন।

এ ঘটনায় গত ৫ জানুয়ারি চাকরি থেকে বাদ পড়া মো. সরিফুল আলম প্রতিকার চেয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক কাছে আবেদন করেন।

চাকরি দেওয়ার কথা বলে অধ্যক্ষ ১০ লাখ টাকা নিয়েছেন দাবি করে সরিফুল আলম বলেন, ‘২০১৪ সাল থেকে আমি অধ্যক্ষের কথা অনুযায়ী প্রতিষ্ঠানের উন্নয়নে বিভিন্ন কাজ করেছি। তিনি চাকরি দেওয়ার কথা বলে ১০ লাখ টাকা নিয়েছেন।

কিন্তু প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত পাওয়ার পর আমাকে বাদ দিয়ে দিয়েছেন। আমার জায়গায় অর্থের বিনিময়ে অন্য একজনকে চাকরি দিয়েছেন। আমি প্রতিকার চেয়ে মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তরে আবেদন করেছি।’