শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কেউ বিদেশে, কেউ পলাতক থেকে নিয়ন্ত্রণ করছেন ঢাকার অপরাধজগৎ
শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কেউ কারাগারে বসে, কেউ বিদেশে থেকে ঢাকার অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন। এই নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে তাঁদের সহযোগীরা প্রতিপক্ষের সঙ্গে বিরোধে জড়াচ্ছেন, ঘটাচ্ছেন খুনখারাবিও। সম্প্রতি জামিনে মুক্তি পাওয়া শীর্ষ সন্ত্রাসী তারিক সাঈদ মামুনের ওপর হামলার ঘটনায় ঢাকার অপরাধজগৎ নতুন করে আলোচনায় এসেছে। কারাবন্দী আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমনের সহযোগীরা ওই হামলা চালিয়েছেন বলে তদন্তসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানিয়েছেন।
গত ১৮ সেপ্টেম্বর মামুনের ওপর হামলার এক দিন আগে আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী নাঈম আহমেদ টিটন জামিনে মুক্তি পান। দুই দশক তিনি কারাবন্দী ছিলেন। টিটন শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের শ্যালক। টিটনের মুক্তির চার দিন পর ২২ সেপ্টেম্বর জামিনে মুক্তি পান আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী খোরশেদ আলম রাসু। কারাগার থেকে বেরিয়ে আসার পর তাঁরা নতুন করে আরও কোনো সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন কি না, তা নিয়ে উদ্বেগ রয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, বিভিন্ন সরকারি দপ্তরে টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ, জমি-বাড়ি দখল, কেব্ল টিভি ও ঝুট ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ, ব্যবসায়ীসহ বিভিন্ন ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে চাঁদা আদায়কে কেন্দ্র করেই মূলত বিরোধে জড়ান শীর্ষ সন্ত্রাসীরা। তাঁরা কারাগারে বা বিদেশে অবস্থান করলেও তাঁদের স্থানীয় সহযোগীরা এখনো সক্রিয়। ওই সহযোগীদের নির্দেশনা দিয়ে ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় অপরাধমূলক কর্মকাণ্ড করিয়ে চলেছেন তাঁরা।
ঢাকার অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়টি গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে ব্যাপক আলোচনায় এসেছিল। পরে ২০০১-০২ সালে এই সন্ত্রাসীদের আধিপত্য আরও বেড়ে যায়। এ পটভূমিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ২০০১ সালের ২৬ ডিসেম্বর ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর একটি তালিকা তৈরি করে। যাঁরা ঢাকার বিভিন্ন এলাকার অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, তাঁদের ওই তালিকায় রাখা হয়। এই সন্ত্রাসীদের ধরিয়ে দিতে এক লাখ টাকা করে পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়েছিল। আর ২০০২ সালে তাঁদের ধরতে সাঁড়াশি অভিযান চালিয়েছিল সেনাবাহিনী। সে সময় পাঁচ শীর্ষ সন্ত্রাসী ধরা পড়েছিলেন। একজন গণপিটুনিতে মারা যান। আর অন্যরা ভারতে পালিয়ে যান। তাঁদের মধ্যে দুজন সেখানে ধরা পড়েছিলেন।
তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসীদের কে কোথায়
২০০১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের করা শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় যাঁদের নাম ছিল, তাঁরা হলেন কালা জাহাঙ্গীর, মোল্লা মাসুদ, পিচ্চি হান্নান, সুব্রত বাইন, প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, আমিনুর রসুল সাগর ওরফে টোকাই সাগর, হারিস আহমেদ, খোরশেদ আলম রাসু, পিচ্চি হেলাল, আলাউদ্দিন, কামাল পাশা, নাঈম আহমেদ টিটন, লিয়াকত, আরমান, জাফর আহমেদ মানিক, খন্দকার তানভীরুল ইসলাম জয়, ইমাম হোসেন ওরফে ফ্রিডম ইমাম, ফ্রিডম সোহেল, মো. আব্বাস আলী ওরফে কিলার আব্বাস, ভিপি হান্নান, শামীম ওরফে আগা শামীম, মশিউর রহমান ও আবদুল জব্বার মুন্না।
তাঁদের মধ্যে নাঈম আহমেদ টিটন ও খোরশেদ আলম রাসু গত মাসে জামিনে মুক্ত হন। এরপর তাঁরা কোথায় আছেন, সে তথ্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে নেই। বর্তমানে কারাগারে আছেন মো. আব্বাস আলী, পিচ্চি হেলাল, ফ্রিডম সোহেল, আরমান, মশিউর রহমান ও কামাল পাশা। তাঁদের মধ্যে মো. আব্বাস আলী কারাগারে থেকেও মিরপুর ও ভাসানটেক এলাকার অপরাধজগতের আধিপত্য ধরে রেখেছেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র জানিয়েছে।
ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের একাধিক সূত্র থেকে জানা গেছে, বিদেশে পলাতক শীর্ষ সন্ত্রাসীদের মধ্যে জাফর আহমেদ মানিক যুক্তরাষ্ট্র ও মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করেন। সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় তাঁর যাতায়াত আছে। তানভীরুল ইসলাম ওরফে জয় দুবাই আছেন বলে প্রচার আছে। সুব্রত বাইন, আগা শামীম, জব্বার ও ফ্রিডম ইমাম ভারতে আছেন বলে জানা গেছে। প্রকাশ বিশ্বাস ও হারিস আহমেদ ইউরোপের বিভিন্ন দেশে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। টোকাই সাগর যুক্তরাষ্ট্রে আছেন। হান্নান ইউরোপের কোনো একটি দেশে আছেন।
মোল্লা মাসুদ ২০১৫ সালে ভারতে ধরা পড়েন বলে দেশটির বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছিল। পরে তিনি জামিনে মুক্ত হন এবং ভারতেই অবস্থান করছেন বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
২০০২ সালে সেনাবাহিনীর সাঁড়াশি অভিযান শুরুর পর লিয়াকত কলকাতা পালিয়ে যান। পরে সেখানে তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। মুক্তির পর দেশে ফিরেছিলেন লিয়াকত। ২০০৮ সালে লিয়াকতকে ধানমন্ডিতে তাঁর শ্বশুরের বাসা থেকে সাদা পোশাকের একদল লোক ধরে নিয়ে যায়। এরপর থেকে তাঁর আর কোনো খোঁজ নেই।
শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তালিকায় থাকা কালা জাহাঙ্গীর ব্যাপক আলোচিত ছিলেন। মহাখালীর সাততলা বস্তিতে ছিল তাঁর আস্তানা। সে সময় তাঁর ‘গডফাদার’ হিসেবে আলোচনায় এসেছিলেন তেজগাঁও অঞ্চলের তৎকালীন বিএনপি নেতা লুৎফর রহমান ওরফে এল রহমান।
কালা জাহাঙ্গীর ও তাঁর সহযোগীরা ‘ভাড়াটে খুনি’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ২০০৩ সালের পর কালা জাহাঙ্গীর হঠাৎ ‘উধাও’ হয়ে যান। ২০০৩-০৫ সালে সংবাদপত্রে প্রকাশিত বিভিন্ন প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গুলিতে কালা জাহাঙ্গীরের মৃত্যু হওয়ার দাবি করে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও তাঁর পরিবার। তবে এ মৃত্যু নিয়ে এখনো রহস্য কাটেনি। এমনও দাবি করা হয়েছিল, ২০০৩ সালের ডিসেম্বরে কালা জাহাঙ্গীর নিজেই মাথায় গুলি চালিয়ে আত্মহত্যা করেন।
২০০২ সালে রামপুরায় গণপিটুনিতে মারা যান শীর্ষ সন্ত্রাসী আলাউদ্দিন। পরে ২০০৪ সালের ২৬ জুন র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন পিচ্চি হান্নান। তিনি ছিলেন রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও আশপাশের এলাকার অপরাধজগতের একচ্ছত্র নিয়ন্ত্রক।
পিচ্চি হান্নানের মৃত্যুর চার মাস পর নভেম্বরে ঢাকায় র্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে প্রাণ হারান নারায়ণগঞ্জের সন্ত্রাসী মমিন উল্লাহ ডেভিড। এ ঘটনাও তখন ব্যাপক আলোচনার জন্ম দিয়েছিল।
দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীর সংঘাতে প্রাণ গেল ভুবন চন্দ্রের
শীর্ষ সন্ত্রাসী সানজিদুল ইসলাম ইমন ও তারিক সাঈদ মামুন গত শতকের নব্বইয়ের দশকের শেষের দিকে ঢাকার কামরাঙ্গীরচর, হাজারীবাগ, ধানমন্ডি, মোহাম্মদপুর ও তেজগাঁও অঞ্চলের আতঙ্ক ছিলেন। ওই সময় পুলিশের করা একাধিক সন্ত্রাসীর তালিকায় তাঁদের নাম ছিল।
১৯৯৯ সালের ১৬ মার্চ প্রথম আলোর একটি সংবাদের শিরোনাম ছিল—‘সন্ত্রাসী ইমন-মামুন বহাল তবিয়তে’। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, ১৯৯৭ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারি রাতে মোহাম্মদপুরে হিমেল নামের এক যুবককে খুন করে মোহাম্মদপুরের দুর্ধর্ষ সন্ত্রাসী জোসেফের সঙ্গে ইমন ও মামুনের সম্পর্কের মারাত্মক অবনতি ঘটে। হিমেল ছিলেন জোসেফের বন্ধু। সর্বশেষ ইমন-মামুন বাহিনী জোসেফের বড় ভাই সাঈদ আহমেদ টিপু ও তাঁর বন্ধু ইমরানকে হত্যা করে। চিত্রনায়ক সোহেল চৌধুরী হত্যায় ইমন ও মামুন জড়িত বলে পুলিশের তদন্তে উঠে এসেছে। গত প্রায় দুই দশক কারাগারে থেকেও তাঁরা এলাকার অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডের নেতৃত্ব ধরে রেখেছিলেন।
পুলিশের তেজগাঁও অঞ্চলের একাধিক কর্মকর্তা জানান, ইমন কারাগারে থেকেই সহযোগীদের মাধ্যমে অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করছিলেন। তাঁর স্ত্রী লীনাও এ কাজে যুক্ত ছিলেন। এতে মামুনের আধিপত্য কমে আসে। সম্প্রতি মামুন জামিনে মুক্ত হয়ে পুরো এলাকায় একক নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। এতে দুই বন্ধুর মধ্যে শত্রুতা তৈরি হয়।
এর জেরে গত ১৮ সেপ্টেম্বর রাতে ঢাকার তেজগাঁওয়ে মামুনের প্রাইভেট কার লক্ষ্য করে এলোপাতাড়ি গুলি ছোড়েন ইমনের সহযোগীরা। একপর্যায়ে ইমন গাড়ি থেকে নেমে পালাতে গেলে ধারালো অস্ত্র দিয়ে তাঁকে কুপিয়ে আহত করেন হামলাকারীরা। ওই হামলায় মামুন বেঁচে গেলেও সন্ত্রাসীদের ছোড়া গুলিতে ভুবন চন্দ্র শীল নামের এক নিরপরাধ ব্যক্তি প্রাণ হারিয়েছেন। তিনি ওই সময় সেখান দিয়ে ভাড়া করা মোটরসাইকেলে করে আরামবাগের বাসায় ফিরছিলেন।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশিদ বলেন, গোলাগুলির ঘটনার (১৮ সেপ্টেম্বরের) পর আধিপত্য বিস্তার নিয়ে ইমন-মামুনের দ্বন্দ্বের বিষয়টি উঠে এসেছে। পুরো ঘটনা তদন্ত করা হচ্ছে।
ঢাকার কোন এলাকার অপরাধজগতে কার নিয়ন্ত্রণ
২০০১ সালে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যে ২৩ শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকা করে, তাঁদের বাইরে আরও অনেকে বিভিন্ন সময় ঢাকার বিভিন্ন এলাকার অপরাধজগতে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁদের নামও পুলিশের তালিকায় শীর্ষ সন্ত্রাসী হিসেবে যুক্ত হয়। তাঁদেরও কেউ কেউ কারাগারে থেকে বা বিদেশে থেকে ঢাকার বিভিন্ন এলাকা নিয়ন্ত্রণ করছেন। তাঁদের মধ্যে অন্যতম জিসান আহমেদ। দুই দশকের বেশি সময় ধরে তিনি বিদেশে রয়েছেন। তাঁর ভারতীয় পাসপোর্ট রয়েছে বলে একাধিক সূত্রে জানা যায়। সূত্রমতে, ডমিনিক রিপাবলিকানেরও একটি পাসপোর্ট রয়েছে তাঁর।
পুলিশের একটি সূত্র বলছে, দুবাইয়ে থেকে জিসান খিলগাঁও, রামপুরা, বাড্ডা ও গুলশানের একটি অংশের অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করেন। তাঁর বিরুদ্ধে ছয়টি হত্যাসহ অন্তত আটটি মামলা রয়েছে। এর মধ্যে ২০০৩ সালে রাজধানীর মালিবাগের একটি হোটেলে গোয়েন্দা পুলিশের দুই কর্মকর্তাকে গুলি করে হত্যার ঘটনায় তিনি জড়িত থাকার অভিযোগ আছে।
অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ সন্ত্রাসীর তালিকায় থাকা মানিক বিদেশে থেকেই নিয়ন্ত্রণ করছেন মতিঝিল ও শাহজাহানপুর এলাকা। ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মতিঝিল, শাহজাহানপুর ও খিলগাঁও এলাকার আধিপত্য বিস্তার নিয়ে জিসান ও মানিকের মধ্যে দীর্ঘ সময় ধরে বিরোধ ছিল। তাঁদের দ্বন্দ্ব ছিল মূলত রাজউক (রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ), গণপূর্তসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের টেন্ডার নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে। তবে ২০১৭ সালের পর এসব এলাকার নিয়ন্ত্রণ তাঁদের হাতছাড়া হয়। এসব জায়গার নিয়ন্ত্রণ চলে যায় যুবলীগের তৎকালীন দুই নেতা ইসমাইল হোসেন সম্রাট ও খালেদ ভূঁইয়ার হাতে। এ পরিস্থিতিতে জিসান ও মানিক নিজেদের মধ্যকার বিরোধ মিটিয়ে ফেলেন। দুজন মিলে সম্রাট ও খালেদকে হত্যার পরিকল্পনা করেন। আগ্নেয়াস্ত্র একে-২২ দিয়ে তাঁদের হত্যার জন্য বিশেষ ‘অ্যাসাইনমেন্ট’ও দেওয়া হয়েছিল দুজনকে।
মতিঝিল অঞ্চলের অপরাধের ওপর দীর্ঘ সময় নজর রাখা এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, জিসান ও মানিকের দুই সহযোগী একে-২২-সহ ধরা পড়ার পর খালেদ ও সম্রাটকে হত্যার পরিকল্পনার কথা জানা যায়। পরে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় সম্রাট ও খালেদ গ্রেপ্তার হলে আবারও অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ চলে যায় জিসান ও মানিকের হাতে। পরে আধিপত্য বিস্তার নিয়ে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ জাহিদুল ইসলাম টিপুর সঙ্গে তাঁদের বিরোধ তৈরি হয়। এর জেরে গত বছরের ২৪ মার্চ ভাড়াটে খুনি দিয়ে টিপুকে হত্যা করা হয়।
এ হত্যা মামলার তদন্তে যুক্ত আছেন ডিএমপির গোয়েন্দা শাখার (ডিবি) অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) শাহিদুর রহমান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে একাধিক সন্ত্রাসী দলের আধিপত্য বিস্তারের নানা তথ্য-উপাত্ত মামলার তদন্তে উঠে এসেছে। হত্যার পরিকল্পনায় দুজন শীর্ষ সন্ত্রাসীর নামও এসেছে।
এর আগে ২০১৩ সালের ৩ আগস্ট মতিঝিল অঞ্চলের অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে যুবলীগ নেতা রিয়াজুল হক খান মিল্কীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। পুলিশের ভাষ্য, এ হত্যাকাণ্ডের অন্যতম পরিকল্পনাকারী ছিলেন তৎকালীন যুবলীগ নেতা সাখাওয়াত হোসেন চঞ্চল। মতিঝিল অঞ্চলের টেন্ডার, চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণের দ্বন্দ্বের জেরে এ হত্যার ঘটনা ঘটে। চঞ্চল এখন যুক্তরাষ্ট্রে আছেন বলে জানা গেছে।
ঢাকার অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন সময় আরও অনেকের নাম উঠে এসেছে। মিরপুর এলাকার অপরাধজগতের নিয়ন্ত্রণ যাঁদের হাতে, তাঁদের অন্যতম শাহাদাত হোসেন। পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী শাহাদাত ভারতে অবস্থান করছেন বলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে। কমলাপুর, গোপীবাগ, মানিকনগর ও ওয়ারী এলাকার অপরাধজগৎ যে কজন নিয়ন্ত্রণ করেন, নাসির উদ্দিন তাঁদের অন্যতম। তিনি দীর্ঘদিন ইতালিতে পালিয়ে ছিলেন। সম্প্রতি তিনি দেশে ফিরে যুবলীগ নেতা–কর্মীদের কাছে ভিড়েছেন বলে জানা গেছে।
এদিকে কারাগারে থেকে রামপুরার একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করছেন পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী শাহজাদা। কারাগারে থাকা আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী ইয়াসিন খান ওরফে কাইল্লা পলাশ রামপুরা এলাকার অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করছেন। তিনি কারাবন্দী থেকেও সন্তানের বাবা হয়ে ব্যাপক আলোচিত হয়েছিলেন। কারাগারে থাকা আরেক শীর্ষ সন্ত্রাসী মো. আসলাম হোসেন ওরফে সুইডেন আসলাম কারাগারে থেকে তেজগাঁওয়ের একটি অংশ নিয়ন্ত্রণ করছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে।
সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় আনতে কী করা হচ্ছে
সন্ত্রাসীদের তৎপরতা পর্যবেক্ষণ করেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বিদেশে পলাতক সন্ত্রাসীরা এক দেশে অবস্থান করেন না। তাঁদের অবস্থান সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায় না। এমনকি তাঁরা এক দেশে থেকে ভিপিএন (ভার্চ্যুয়াল প্রাইভেট নেটওয়ার্ক) ব্যবহার করে বাংলাদেশের সহযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। ফলে প্রযুক্তির সহায়তা নিয়েও তাঁদের সঠিক অবস্থান সব সময় জানা সম্ভব হয় না। এটা একটা সীমাবদ্ধতা। আবার অবস্থান জানা গেলেও তাঁদের ফিরিয়ে দেওয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো সহায়তা করতে চায় না।
পুলিশের এক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, বিদেশে বাংলাদেশি অপরাধীরা অনেক সময় ধরা পড়লেও পুলিশ ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের সমন্বয়ের অভাবে তাঁদের ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয় না। যেমন ২০১৯ সালে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ইন্টারপোলের সদস্যদের হাতে গ্রেপ্তার হন শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান। কিন্তু দ্রুত উদ্যোগ নিতে না পারায় তিনি জামিনে মুক্ত হয়ে যান। এ কারণে তাঁকে দেশে ফিরিয়ে আনা যায়নি।
শীর্ষ সন্ত্রাসীদের তালিকায় থাকা প্রকাশ কুমার বিশ্বাস, সুব্রত বাইন, তানভীরুল ইসলাম, মোল্লা মাসুদ ও টোকাই সাগরের বিরুদ্ধে ইন্টারপোলের রেড নোটিশ জারি করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে তানভীরুল ভারতীয় পাসপোর্ট নিয়ে মালয়েশিয়ায় অবস্থান করছেন বলে বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে।
অপরাধীদের বিদেশ থেকে ফিরিয়ে আনা ও ইন্টারপোলের সঙ্গে তথ্য বিনিময় করে বাংলাদেশ পুলিশের ন্যাশনাল সেন্ট্রাল ব্যুরো (এনসিবি)। শীর্ষ সন্ত্রাসীদের ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে জানতে চাইলে এনসিবির সহকারী মহাপরিদর্শক (এআইজি) শরীফ মোস্তাফিজুর রহমান কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি।
র্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন প্রথম আলোকে বলেন, কারাগার ও দেশের বাইরে থেকে যে সন্ত্রাসীরা অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছেন, তাঁদের বিষয়ে নজরদারি করা হয়। কারাগার থেকে নির্দেশ দেওয়ার তথ্য পেলে কারা কর্তৃপক্ষকে বিষয়টি জানানো হয়। পাশাপাশি সন্ত্রাসী দলের কোনো সদস্যের বিষয়ে তথ্য সংগ্রহ করে আইনের আওতায় আনা হয়।
অপরাধজগতের প্রভাব সম্পর্কে জানতে চাইলে পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) ও সংসদ সদস্য নূর মোহাম্মদ প্রথম আলোকে বলেন, আন্ডারওয়ার্ল্ডের (অপরাধজগৎ) প্রভাব যে একেবারেই নেই, তা তো নয়। যাঁরা তাঁদের নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁরা তো রয়েই গেছেন। এ কারণে সেটার প্রভাবও রয়েছে।
আইনি নোটিশ ও ব্যাখ্যা : কারাবন্দী মো. আব্বাস আলীকে পুলিশের নথিতে ‘কিলার আব্বাস’ হিসেবে উল্লেখ করা আছে। পুলিশের সেই নথির বরাতেই তাঁর নাম এই প্রতিবেদনে ‘কিলার আব্বাস’ লেখা হয়েছিল। এ বিষয়ে তাঁর পক্ষ থেকে আইনজীবী মো. বদরুল ইসলাম (জুয়েল) লিখিতভাবে জানিয়েছেন, তাঁর মক্কেলের প্রকৃত নাম মো. আব্বাস আলী। গণমাধ্যমে তাঁর নাম ‘কিলার আব্বাস’ হিসেবে উল্লেখ করার ঘটনায় আইনি প্রতিকার চেয়ে হাইকোর্টে একটি রিট আবেদন করা হয়েছে, সেটি বিচারাধীন। তাছাড়া মো. আব্বাস আলী কারাবন্দী থেকেও মিরপুর ও ভাসানটেক এলাকার অপরাধজগতের আধিপত্য ধরে রেখেছেন বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্র যে তথ্য দিয়েছে, তা সত্য নয় বলে দাবি করেছেন তাঁর আইনজীবী।