ক্যাসিনো–কাণ্ডের ৫ মামলার তদন্ত শেষ হবে কবে

মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে বহিষ্কৃত যুবলীগ নেতা সম্রাট ও খালেদের দুটিসহ পাঁচ মামলার তদন্তে গতি নেই।

ইসমাইল হোসেন, খালেদ মাহমুদ

চার বছর আগে ক্যাসিনো-কাণ্ডের ঘটনায় যুবলীগের বহিষ্কৃত নেতা ইসমাইল হোসেন চৌধুরী ওরফে সম্রাট, খালেদ মাহমুদ ভূঁইয়াসহ গ্রেপ্তার ১৩ জনের বিরুদ্ধে মোট ৫৭টি মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে ৫২টি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। তবে মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে সম্রাট ও খালেদের বিরুদ্ধে একটি করে দুটি ও জ্ঞাত আয়–বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে আওয়ামী লীগের বহিষ্কৃত নেতা এনামুল হক ওরফে এনু, রুপন ভূঁইয়াসহ তিনজনের বিরুদ্ধে করা তিন মামলাসহ মোট পাঁচ মামলার তদন্ত চার বছরেও শেষ হয়নি।

* গ্রেপ্তার ১৩ জনের বিরুদ্ধে মোট মামলা হয় ৫৭টি। ৫২টি মামলার অভিযোগপত্র জমা। * অনেকেই জামিনে মুক্ত হয়ে দলে ফেরার উপায় খুঁজছেন।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি সম্রাট, একই সংগঠনের সহসভাপতি এনামুল হক ওরফে আরমান, ওই সংগঠনের সাংগঠনিক সম্পাদক খালেদ মাহমুদসহ ১৩ জনকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। তাঁদের বিরুদ্ধে পুলিশ, র‍্যাব ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) মোট ৫৭টি মামলা করে। এর মধ্যে অস্ত্র, মাদক, বৈদেশিক মুদ্রা নিয়ন্ত্রণ, বিশেষ ক্ষমতা ও মানি লন্ডারিং আইনে ৩৪টি মামলা করে পুলিশ ও র‍্যাব। এ ছাড়া জ্ঞাত আয়–বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে ১২ জনের বিরুদ্ধে মোট ২৩টি মামলা করে দুদক। সিআইডি, দুদক, র‍্যাব ও ডিএমপির গোয়েন্দা বিভাগ (ডিবি) তদন্ত শেষে ৫২ মামলার অভিযোগপত্র দেয়। এর মধ্যে দুদকের ২৩টি মামলার মধ্যে ২০টির অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এনু, রুপনসহ তিনজনের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়–বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে করা বাকি তিন মামলার তদন্ত শেষ হয়নি।

সম্রাট ও খালেদের বিরুদ্ধে মানি লন্ডারিং আইনে করা মামলার তদন্ত করছে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি)। তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, সম্রাটের বিরুদ্ধে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় ১৯৫ কোটি টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। হুন্ডির মাধ্যমে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় পাচার করা টাকার বড় অংশই সম্রাট ক্যাসিনোতে খরচ করেছেন। ২০১১ সালের ২৭ ডিসেম্বর থেকে ২০১৯ সালের ৯ আগস্ট পর্যন্ত তিনি শুধু সিঙ্গাপুরেই গেছেন ৩৫ বার। একই সময়ে মালয়েশিয়ায় গেছেন তিনবার।

ক্যাসিনো–কাণ্ডে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মামলার তদন্তে যে দক্ষতা ও পেশাগত উৎকর্ষের দরকার, সেটা নিয়ে সব সময় প্রশ্ন ছিল।
ড. ইফতেখারুজ্জামান, নির্বাহী পরিচালক, টিআইবি

মানি লন্ডারিং মামলার তদন্ত তদারক কর্মকর্তা সিআইডির ইকোনমিক স্কোয়াডের বিশেষ পুলিশ সুপার মো. হুমায়ুন কবির প্রথম আলোকে বলেন, সম্রাটের পাচার করা অর্থের বিষয়ে তথ্য চেয়ে গত বছরের অক্টোবরে সিঙ্গাপুর ও মালয়েশিয়ায় চিঠি পাঠানো হয়েছিল। সেই চিঠির জবাব না পাওয়ায় তাঁরা মামলার অভিযোগপত্র জমা দিতে পারছেন না।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে গ্রেপ্তার মোট ১৩ জনের মধ্যে যুবলীগের নেতা সম্রাট, খালেদ মাহমুদ, কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সাবেক সভাপতি কাজী শফিকুল আলম কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হয়েছেন। গ্রেপ্তারের পর দল থেকে তাঁদের বহিষ্কার করা হয়। তবে সাম্প্রতিক সময়ে দল থেকে বহিষ্কৃত কাউকে কাউকে দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। আরও অনেকেই দলে ফিরে আসতে পারেন বলে আলোচনা আছে।

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়া সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের যুগ্ম সম্পাদক এ কে এম মমিনুল হক ওরফে ক্যাসিনো সাঈদ এরই মধ্যে গতকাল মঙ্গলবার ঢাকায় এক অনুষ্ঠানে হকি ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব ফিরে পেয়েছেন।

ক্যাসিনো–কাণ্ডে গ্রেপ্তার নেতাদের জামিনে মুক্ত হয়ে আগের অবস্থানে ফিরে আসার চেষ্টার সঙ্গে এসব মামলার তদন্তের ধীরগতির সম্পর্ক রয়েছে বলে বিভিন্ন মহলে আলোচনা আছে।

ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাব, ঢাকা ওয়ান্ডারার্স ক্লাব, গুলিস্তানে মুক্তিযোদ্ধা ক্লাব, মতিঝিলের দিলকুশা ক্লাব, মোহামেডান স্পোর্টিং ক্লাব, ভিক্টোরিয়া স্পোর্টিং ক্লাব ও কলাবাগান ক্লাবে এখনো তালা ঝুলতে দেখা গেছে। এসব ক্লাবেই ক্যাসিনো চলত।

সেই ‘শুদ্ধি অভিযান’

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে ঢাকার ক্লাবপাড়ায় অবৈধ ক্যাসিনো-বাণিজ্য করে অল্প সময়ে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের কিছু নেতার কোটি কোটি টাকার মালিক হয়ে যাওয়ার বিষয়টি আলোচনায় আসে। ওই বছরের ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকা মহানগর যুবলীগ দক্ষিণের বহিষ্কৃত সাংগঠনিক সম্পাদক ও ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাবের সভাপতি খালেদ মাহমুদকে গ্রেপ্তারের মধ্য দিয়ে ঢাকায় ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান শুরু হয়। এই অভিযান আওয়ামী লীগের ভেতরে ‘শুদ্ধি অভিযান’ হিসেবেও পরিচিতি পায়। গ্রেপ্তার ঠেকাতে যুবলীগ নেতা সম্রাট তাঁর দখল করে নেওয়া রাজধানীর কাকরাইলে ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টার ভবনে দলবল নিয়ে কিছুদিন অবস্থান করেন। এরপর হঠাৎই তিনি আত্মগোপনে যান।

২০১৯ সালের ৬ অক্টোবর র‍্যাব সম্রাট, তার সংগঠনের সহসভাপতি ও চলচ্চিত্র প্রযোজক আরমানকে কুমিল্লার দেবীদ্বার থেকে গ্রেপ্তার করে। ওই দিন কাকরাইলের ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টারে সম্রাটের কার্যালয়ে অভিযান চালিয়ে অবৈধ পিস্তল-গুলি, মাদক ও বন্য প্রাণীর চামড়া উদ্ধার করা হয়। সেদিন র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত বন্য প্রাণী সংরক্ষণ আইনে সম্রাটকে ছয় মাসের কারাদণ্ড দিয়ে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠান। গ্রেপ্তারের পর সম্রাট ও আরমানের বিরুদ্ধে রমনা থানায় মাদকদ্রব্য ও অস্ত্র আইনে দুটি মামলা করা হয়। পরে সম্রাটের বিরুদ্ধে জ্ঞাত আয়–বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও মানি লন্ডারিং আইনে একটি করে মামলা করা হয়। মানি লন্ডারিং আইনে ছাড়া সম্রাটের বিরুদ্ধে হওয়া বাকি তিন মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। আর তাঁর ‘ক্যাশিয়ার’ হিসেবে পরিচিত আরমানের বিরুদ্ধে দুই মামলার অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়।

২০১৯ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত চলা অভিযানে সম্রাট, আরমান, খালেদ মাহমুদ, কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের সভাপতি ও কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য কাজী শফিকুল আলম ওরফে ফিরোজ, যুবলীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান, যুবলীগের নেতা ও বিতর্কিত ঠিকাদার জি কে (গোলাম কিবরিয়া) শামীম ছাড়াও অনলাইন ক্যাসিনো কারবারি সেলিম প্রধানসহ অন্যদের গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। পরের বছর (২০২০) জানুয়ারিতে গেন্ডারিয়া থানা আওয়ামী লীগের নেতা দুই ভাই এনামুল হক ওরফে এনু ও রুপন ভূঁইয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেছেন, কাকরাইলে ভূঁইয়া ট্রেড সেন্টার দখল করে সেখান থেকে মতিঝিলসহ আশপাশের এলাকার চাঁদাবাজি, সরকারি কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের ঠিকাদারিসহ অপরাধজগৎ নিয়ন্ত্রণ করতেন। তাঁর জন্য ক্যাসিনো থেকে টাকা তোলার দায়িত্বে ছিলেন তৎকালীন ওয়ার্ড কাউন্সিলর এ কে এম মমিনুল হক ওরফে ক্যাসিনো সাঈদ ও যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদ। এসব টাকার হিসাব রাখতেন আরমান। সম্রাট গ্রেপ্তার হলে র‍্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত ২০২১ সালের ২২ সেপ্টেম্বর ৯ তলা ভবনটি দুই মালিকের কাছে বুঝিয়ে দেন। ওই ভবনের নাম এখন ‘লতিফ সেন্টার’।

কারাগারে প্রায় তিন বছর আটক থাকাকালে সম্রাটের পুরো সময়টা কাটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালে। গত বছরের ২২ আগস্ট কারাগার থেকে সম্রাট জামিনে মুক্ত হন। অতিসম্প্রতি যুবলীগের এক নেতা প্রথম আলোকে বলেন, জামিনে মুক্ত হওয়ার পর সম্রাট এখন রাজধানীর বাসাতেই আছেন। তাঁর হৃদ্‌যন্ত্রে পেসমেকার বসানো। তাই মাঝেমধ্যে হাসপাতালে চিকিৎসা নেন।

আটকে আছে অভিযোগপত্র

ফকিরেরপুল ইয়ংমেনস ক্লাবে ক্যাসিনোবিরোধী অভিযান চালানোর পর ওই রাতে যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদকে অস্ত্রসহ তার গুলশানের বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। মানি লন্ডারিং, অস্ত্র, মাদক আইন এবং জ্ঞাত আয়–বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে খালেদ মাহমুদের বিরুদ্ধে মোট সাতটি মামলা করা হয়েছিল। এর মধ্যে গত বছর দেওয়া ছয়টি অভিযোগপত্রের মধ্যে চারটির অভিযোগ গঠন হয়েছে। মানি লন্ডারিং আইনে করা মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।

জানতে চাইলে সিআইডির বিশেষ পুলিশ সুপার হুমায়ুন কবির বলেন, খালেদের বিরুদ্ধে মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর ও থাইল্যান্ডে টাকা পাচারের তথ্য পাওয়া গেছে। এ বিষয়ে ওই সব দেশের সংশ্লিষ্ট দপ্তরে তথ্য চেয়ে চিঠি চালাচালি করলেও কোনো ফল হয়নি। তাই খালেদ মাহমুদের বিরুদ্ধে তদন্ত শেষ হলেও অভিযোগপত্র দেওয়া যাচ্ছে না।

শফিকুলের তিন মামলায় বিচার চলছে

২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর কলাবাগান ক্রীড়াচক্রের ভেতরে চেয়ারম্যান কাজী শফিকুল আলম ওরফে ফিরোজের কক্ষে অভিযান চালিয়ে অস্ত্র, ইয়াবা, জুয়াখেলার সরঞ্জাম কয়েনসহ তাঁকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। তাঁর বিরুদ্ধে ধানমন্ডি থানায় অস্ত্র, মাদক ও মানি লন্ডারিং আইনে তিনটি পৃথক মামলা করা হয়। এসব মামলার অভিযোগপত্র দেওয়ার পর আদালতে এখন সেগুলোর বিচার কার্যক্রম চলছে। শফিকুল আলম কৃষক লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ছিলেন।

যুবলীগের সেই কাজী আনিস

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের মধ্যে আলোচনায় আসেন যুবলীগের কেন্দ্রীয় দপ্তর সম্পাদক কাজী আনিসুর রহমান। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ও গণমাধ্যমে তাঁর দুর্নীতির চিত্র উঠে আসে। ২০০৫ সালে আনিস কেন্দ্রীয় যুবলীগের কার্যালয়ে পিয়ন হিসেবে যোগ দেন। সাত বছর পর বনে যান কেন্দ্রীয় যুবলীগের দপ্তর সম্পাদক। প্রভাবশালী নেতাদের ব্যবহার করে বনে যান কোটিপতি। আনিস যুবলীগের সাবেক এক শীর্ষ নেতার ‘ক্যাশিয়ার’ ছিলেন বলে প্রচার আছে।

২০১৯ সালে ক্যাসিনো-কাণ্ডসহ নানা অপরাধ এবং অবৈধ সম্পদ গড়ার অভিযোগে আনিসুরকে গ্রেপ্তার করা হয়। পরে যুবলীগ থেকে তাঁকে বহিষ্কার করা হয়। অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদক তাঁর বিরুদ্ধে মামলা করে। সেই মামলার বিচার এখন চলছে।

এনু ও রুপনের দুই মামলার তদন্তের গতি ধীর

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানে গেন্ডারিয়ায় স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতা দুই ভাই এনু ও রুপন ভূঁইয়ার বাড়ি-ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে দুই দফা অভিযান চালিয়ে প্রায় ৩২ কোটি টাকা, ৯ কেজি সোনা এবং ৫ কোটি ১৫ লাখ টাকার স্থায়ী আমানত (এফডিআর) ও একটি পিস্তল উদ্ধার করে র‍্যাব। ২০২০ সালের জানুয়ারিতে তাঁদের গ্রেপ্তার করা হয়।

দুই ভাইয়ের বিরুদ্ধে বিশেষ ক্ষমতা আইন, মানি লন্ডারিং আইন ও জ্ঞাত আয়–বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মোট ৯টি মামলা হয়েছিল। এর মধ্যে সাত মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। ২০২১ সালের ২৫ এপ্রিল মানি লন্ডারিং আইনের একটি মামলায় আদালত তাঁদের ১১ বছর করে কারাদণ্ড দেন। বাকি ছয় মামলার বিচার কার্যক্রম চলছে।

জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মামলাগুলোর অবস্থা জানতে চেয়ে গত রোববার যোগাযোগ করা হলে দুদকের উপপরিচালক (জনসংযোগ) আরিফ সাদিক প্রথম আলোকে বলেন, এনু ও রুপনের এ মামলাগুলো সম্পর্কে তথ্য নেই তাঁর কাছে। তবে মামলা দুটির তদন্ত চলছিল বলে দুদকের আরেকটি সূত্র জানিয়েছে। কিন্তু তদন্ত শেষ হতে কত দিন লাগবে, সে সম্পর্কে স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি।

ক্যাসিনো–কাণ্ডের মামলা হয়নি

ক্যাসিনোবিরোধী অভিযানের সময় সাত সশস্ত্র দেহরক্ষী নিয়ে চলাফেরা করা জি কে শামীম আলোচনায় আসেন। এরপর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হলেও তাঁর বিরুদ্ধে ক্যাসিনো–কাণ্ডের কোনো মামলা হয়নি।

২০১৯ সালের ২০ সেপ্টেম্বর গুলশানের নিকেতনের জি কে শামীমের ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে অভিযান চালিয়ে ২ কোটি টাকা, প্রায় পৌনে ২০০ কোটি টাকার স্থায়ী আমানত (এফডিআর), অবৈধ অস্ত্র ও মদ উদ্ধার করা হয়। ওই ঘটনায় জি কে শামীমের বিরুদ্ধে মাদক, মানি লন্ডারিং ও জ্ঞাত আয়বহির্ভূত অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে মোট তিনটি মামলা হয়েছিল। সব কটি মামলায় অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।

তদন্ত-সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, গ্রেপ্তারের সময় তাঁর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান প্রায় দুই হাজার কোটি টাকার বিভিন্ন সরকারি ভবনের নির্মাণকাজ করছিল। গ্রেপ্তারের পর তাঁর সঙ্গে করা সব নির্মাণ চুক্তি বাতিল করে সরকারের বিভিন্ন সংস্থা।

আয়েশে অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান

গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগার-১–এ ডিভিশন পেয়ে আয়েশে আছেন অনলাইন ক্যাসিনোর হোতা সেলিম প্রধান। ১৫ মাস আগে তাঁকে ক্যাটাগরি-২-এর ভিআইপি বন্দী হিসেবে ডিভিশন দেওয়ার কথা জানিয়েছে কারাগার। ২০১৯ সালে গ্রেপ্তার হওয়ার পর দুই বছর তিনি কারাগারে সাধারণ বন্দী হিসেবে ছিলেন।

২০১৯ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে থাই এয়ারওয়েজের একটি উড়োজাহাজ থেকে নামিয়ে এনে সেলিম প্রধানকে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। তাঁর বিরুদ্ধে গুলশান থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ, মানি লন্ডারিং প্রতিরোধ আইনে দুটি ও অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদক আরেকটি মামলা করে। গত বছরে তিন মামলায় তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে।

সেলিম প্রধানের বিরুদ্ধে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় দেওয়া অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, সেলিম প্রধান নিজ বাসায় নিয়মিত মদ ও মাদকের আসর বসাতেন।

তবে তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ডিভিশন পাওয়া সেলিম প্রধান মাধ্যমিক পাসও করেননি। অনলাইন ক্যাসিনোর অবৈধ কারবার করে বিপুল অর্থের মালিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে সেলিম মিয়া বনে যান সেলিম প্রধান। তাঁর নিরাপত্তায় থাকত অস্ত্রধারী সদস্য।

কারাবিধি অনুযায়ী রাজনৈতিক ও সামাজিকভাবে মর্যাদাসম্পন্ন ব্যক্তিদের কারাগারে ডিভিশন দেওয়া হয়। কারাবিধির ৬১৭ (২)-এ বলা হয়েছে, নাগরিকত্ব–নির্বিশেষে সামাজিক মর্যাদা, শিক্ষা এবং অভ্যাসের কারণে জীবনমান উন্নত মানের, এমন বন্দীরা ডিভিশন-২ পাওয়ার যোগ্য হবেন।

জানতে চাইলে কাশিমপুর কারাগার-১–এর জ্যেষ্ঠ কারা তত্ত্বাবধায়ক শাহজাহান আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, সেলিম প্রধানের পক্ষ থেকে কারাগারে ডিভিশন চেয়ে আদালতে আবেদন করা হয়েছিল। এরপর আদালত কারাবিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নিতে আদেশ দেন। এরপর থেকে তিনি ডিভিশনে আছেন।

দল করলে পার পাওয়া যায়

দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ক্যাসিনো–কাণ্ডে গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মামলার তদন্তের যে দক্ষতা ও পেশাগত উৎকর্ষের দরকার, সেটা নিয়ে সব সময় প্রশ্ন ছিল। এখন বিদেশ থেকে তথ্য পাওয়ার বিলম্বের নামে ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে যুক্ত এসব আসামিকে একধরনের সুরক্ষা দেওয়া হচ্ছে। আবার ক্যাসিনো–কাণ্ডের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিরা দলে পুনর্বাসিত হচ্ছেন। এর বার্তা হলো, যত ধরনের অপরাধ করা হোক না কেন, দল করলে পার পাওয়া যায়।