প্রযুক্তির ফাঁদ পাতছেন মানব পাচারকারীরা

ফেসবুকে বেশ কটি গ্রুপ সক্রিয়। নারী ও শিশু পাচারে বেড়েছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহার।

শিশু ও মানবপাচারপ্রতীকী ছবি

শরীয়তপুরের নড়িয়া উপজেলার দক্ষিণ লোনসিং গ্রামের নাছিমা বেগমের ছেলে কামাল মুন্সি (৩০) ইতালি যাওয়ার জন্য তিন বছর আগে বাড়ি ছেড়েছিলেন। গত ২৯ জুন কামালের সঙ্গে তাঁর পরিবারের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। ওই দিন ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে ইতালির উদ্দেশে যাত্রা করেছিলেন তিনি। চলতি মাসের শুরুতে এক দালাল নাসিমা বেগমকে জানান, ভূমধ্যসাগর পাড়ি দেওয়ার সময় কামাল মারা গেছেন। তাঁর লাশ এখন তিউনিসিয়ায়। ছেলের লাশ আনার জন্য দালালেরা মায়ের কাছে টাকা দাবি করছেন।

শুরুতে স্থানীয় দালালের মাধ্যমে কামালের পরিবার চার লাখ টাকা দিয়েছিল। পরে লিবিয়ায় অবস্থানরত বাংলাদেশের আরেক দালালের মাধ্যমে কয়েক দফায় অন্তত ১০ লাখ টাকা পাঠায় কামালের পরিবার। মূলত ইমো ও হোয়াটসঅ্যাপ ব্যবহার করে শরীয়তপুরের ওই তরুণের পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ করেছেন দালালেরা।

মানব পাচার নিয়ে দেশ-বিদেশের সাম্প্রতিক নানা বিশ্লেষণে বলা হচ্ছে, শুধু বাংলাদেশ নয়, পাচারকারীরা বিশ্বজুড়েই মানব পাচারের ঝুঁকিতে থাকা মানুষগুলোকে চিহ্নিত, নিয়ন্ত্রণ ও তাদের দুর্বলতার সুযোগ নিতে এখন প্রযুক্তি ব্যবহার করছেন। গত বছর বাংলাদেশের এক তরুণীকে ভারতে পৈশাচিক নির্যাতনের একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর মানব পাচারকারীদের হাতে প্রযুক্তির অপব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক পরিসরে আলোচনা হচ্ছে।

আমাদের প্রযুক্তির শক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানব পাচারকারীদের প্রতিহত করার পাশাপাশি তাঁদের ফাঁদ থেকে লোকজনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি মানব পাচারে বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িতদের বিচার করতে হবে।
মো. তারিকুল ইসলাম, পরিচালক (বাংলাদেশ), জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ার

প্রতিবছরের মতো এবারও মানব পাচার প্রতিরোধের বিষয়টি সামনে রেখে ৩০ জুলাই সারা বিশ্বে পালিত হচ্ছে মানব পাচারবিরোধী দিবস। এ বছর মানব পাচারবিরোধী দিবসের প্রতিপাদ্য হচ্ছে ‘প্রযুক্তির ব্যবহার এবং অপব্যবহার’।

বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রাম জানিয়েছে, ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের নারী ও শিশু পাচার দমনে কাজ করতে গিয়ে তারা একটি গবেষণা করেছে। ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের জেমস পি গ্রান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথের সহায়তায় পরিচালিত ওই গবেষণার প্রতিবেদনে দেখা গেছে, পাচারকারীরা সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে সংকটে থাকা পরিবারের শিশু-কিশোরীদের পাচারের টার্গেট করছেন। ভূমধ্যসাগর হয়ে ইউরোপে লোক পাঠানো কিংবা ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের নারী ও শিশু পাচার—সব ক্ষেত্রেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ব্যবহার বেড়েছে।

ব্র্যাকের ওই গবেষণায় দেখে গেছে, গত কয়েক বছরে পাচারের ক্ষেত্রে ফেসবুকসহ নানা রকম সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম অনেক বেশি ব্যবহৃত হচ্ছে। অনেক ক্ষেত্রেই তরুণীদের চাকরি, নায়িকা বা মডেল বানানোর প্রলোভন দেখিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। পরে তাঁদের মানব পাচার চক্রের কাছে বিক্রি করে দেওয়া হয়।

নারী পাচারের বিষয়টি নতুন করে সামনে এসেছে গত বছর ভারতে বাংলাদেশি তরুণীকে পৈশাচিক নির্যাতনের একটি ভিডিও ভাইরাল হওয়ার পর। এ ঘটনায় ভারতের পুলিশ ছয়জনকে গ্রেপ্তার করে, যার মধ্যে রয়েছেন ঢাকার মগবাজারের বাসিন্দা রিফাদুল ইসলাম ওরফে টিকটক হৃদয়। এদিকে ঘটনার পর নারী পাচারে জড়িত থাকার অভিযোগে দুটি চক্রের ১২ জনকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ও র‌্যাব। শুধু এই দুই চক্র পাঁচ বছরে প্রায় দুই হাজার নারীকে ভারতে পাচার করেছে বলে পুলিশ ও র‌্যাব দাবি করেছে। বাংলাদেশ থেকে কতজন নারী ও শিশু ভারতে পাচার হয়, তার কোনো সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। তবে ভারতে পাচার হওয়া প্রায় দুই হাজার নারীকে গত ১০ বছরে আইনি প্রক্রিয়ার মাধ্যমে দেশে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।

অন্যদিকে ভূমধ্যসগর পাড়ি দিয়ে যত লোক ইউরোপে প্রবেশের চেষ্টা করছে, বাংলাদেশ এখন সেই তালিকায় তৃতীয়। ২০২২ সালের প্রথম ছয় মাসে অন্তত ১২ হাজার ৬৩৬ জন বাংলাদেশি এভাবে ইউরোপে প্রবেশ করেছেন। আর গত এক যুগে ইউরোপে প্রবেশ করেছেন প্রায় ৬৫ হাজার বাংলাদেশি। এই পাচারের ক্ষেত্রেও সামাজিক যোগাযোগের নানা মাধ্যম ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষত ফেসবুকে লিবিয়া টু ইতালি নামে একাধিক গ্রুপ রয়েছে।

প্রযুক্তির ইতিবাচক ব্যবহার

মানব পাচারে যেমন প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে, তেমনি এই পাচার থেকে বাঁচতেও ব্যবহৃত হচ্ছে প্রযুক্তি। গত ফেব্রুয়ারিতে ভারতের বেঙ্গালুরু থেকে গাজীপুরের দশম শ্রেণির ছাত্রী শিল্পী আক্তারকে উদ্ধার করা হয়েছিল এই প্রযুক্তি ব্যবহার করেই।

সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পরিচয়ের সূত্র ধরে এক তরুণের হাত ধরে জানুয়ারির শেষ সপ্তাহে ঢাকায় এসেছিল ওই ছাত্রী। বেশ কয়েক দিন পর মাকে ফোন করে সে জানায়, তাদের কয়েকজনকে ভারতে পাচার করা হয়েছে। পরে পাচারকারীরা শিল্পীর ছবি ও ভিডিও পাঠিয়ে জানায়, তাকে দেশে ফেরত পাঠানো হচ্ছে। ওই তরুণীর পরিবার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পাওয়া ছবি ও ভিডিও সঙ্গে সঙ্গে পুলিশের কাছে দিয়ে আইনি ব্যবস্থার অনুরোধ জানায়। পরে স্থানীয় পুলিশ সীমান্তের ওপারে পুলিশ এবং আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সহায়তায় তাকে উদ্ধার করে দেশে ফিরিয়ে আনে।

মামলা হলেও বিচারে দীর্ঘসূত্রতা

মানব পাচার প্রতিরোধে সরকার ২০১২ সালে মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইন করে। এই আইনে ১৩ হাজারের বেশি মানুষকে পাচারের অভিযোগে ২০১২ থেকে ২০২২ সালের জুন পর্যন্ত ৬ হাজার ৫২০টি মামলা হয়েছে। এতে আসামি সাড়ে ৩১ হাজারের বেশি। কিন্তু ৬ হাজার ৫২০টি মামলার মধ্যে গত ১০ বছরে মাত্র ৭২৮টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে মাত্র ৫০টি মামলায় মাত্র ৯৬ জনের সাজা হয়েছে। বাকিরা অব্যাহিত পেয়ে গেছেন। বাকি প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার মামলা চলমান। অর্থাৎ মামলা নিষ্পত্তির হার ১১ শতাংশ। আর সাজা হয়েছে ২ শতাংশের কম।

এমন একজন বিচারপ্রার্থী নওগাঁর বাবু। মানব পাচার প্রতিরোধ আইনে মামলাটি তিনি করেছিলেন ২০১২ সালের ৭ এপ্রিল। এই মামলায় গ্রেপ্তার আসামি জামিনে ছাড়া পেয়েছেন। ৯ বছরেও মামলার বিচার শেষ হয়নি।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক মানব পাচার প্রতিরোধবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান জাস্টিস অ্যান্ড কেয়ারের এদেশীয় পরিচালক মো. তারিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে মানব পাচারকারীরা লোকজনকে প্রতারণার ফাঁদে ফেলছেন। এমন এক প্রেক্ষাপটে আমাদের প্রযুক্তির শক্তিকে কাজে লাগিয়ে মানব পাচারকারীদের প্রতিহত করার পাশাপাশি তাঁদের ফাঁদ থেকে লোকজনের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে। সর্বোপরি মানব পাচারে বিভিন্ন পর্যায়ে জড়িতদের বিচার করতে হবে।’