খুন করে লাশ ফেলে যাওয়ার পথে পুলিশের চোখে ধুলো দিলেও পরে ধরা

দ্বীন ইসলাম (বাঁয়ে) ও নিজাম ওরফে মিজানছবি: সংগৃহীত

দ্বীন ইসলাম (৩০) নিজেকে রাজধানীর একটি সরকারি হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতাকর্মীর পরিচয় দিতেন। এই পরিচয়ের আড়ালে তিনি তাঁর সহযোগীদের নিয়ে ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা ছিনতাই করে আসছিলেন। এ কাজ করতে গিয়ে তাঁরা এক অটোরিকশাচালককে খুন করেছেন।

খুন হওয়া ব্যক্তির নাম মো. নয়ন (২০)। তাঁকে হত্যার পর লাশ গুম করা হয়। তাঁর চালানো অটোরিকশাটি ছিনিয়ে নেয় চক্রটি। ঘটনার দিন ১৪ মে যাত্রাবাড়ীর ধলপুরে নিরাপত্তাচৌকিতে ছিনতাই করা অটোরিকশার কাঠের কাঠামো ও হুড নিয়ে দ্বীন ইসলামসহ দুজন পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়েন। কিন্তু তাঁরা তখন রেহাই পেয়ে যান। তবে দ্বীন ইসলামদের শেষ রক্ষা হয়নি। তিনিসহ চক্রের চার সদস্যকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁদের দুজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

গতকাল মঙ্গলবার পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার মোহাম্মদ ইকবাল হোসাইন প্রথম আলোকে বলেন, দ্বীন ইসলাম অটোরিকশা ছিনতাই চক্রের নেতা। তিনি তাঁর সহযোগীদের নিয়ে অটোরিকশা ছিনতাই করে ভাঙারির দোকানে বিক্রি করে আসছিলেন। দ্বীন ইসলামের বিরুদ্ধে রাজধানীর যাত্রাবাড়ী থানায় ছিনতাই ও চুরির একাধিক মামলা রয়েছে।

নিরাপত্তাচৌকিতে পুলিশের মুখে

পুলিশ জানায়, ১৪ মে রাতে যাত্রাবাড়ী থানা-পুলিশ ধলপুরে নিরাপত্তাচৌকি বসিয়ে তল্লাশি করছিল। এ সময় রাশেদ মিয়া নামের এক যুবকের রিকশায় যাচ্ছিলেন দ্বীন ইসলাম। তাঁর সঙ্গে ছিল একটি অটোরিকশার কাঠের কাঠামো ও হুড। সন্দেহ হলে তাঁদের থামিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ।

দ্বীন ইসলাম নিজেকে মুগদা মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতালের পরিচ্ছন্নতাকর্মীর পরিচয় দেন। তিনি দাবি করেন, ময়লার ভাগাড়ে রিকশার কাঠামো ও হুড পরিত্যক্ত অবস্থায় পেয়েছেন।

পুলিশ অটোরিকশার কাঠামো ও হুডে লেখা মুঠোফোন নম্বরে ফোন দেয়। মালিক এসে কাঠামো ও হুড বুঝে নেন। জিজ্ঞাসাবাদ শেষে দ্বীন ইসলাম ও রাশেদকে ছেড়ে দেয় পুলিশ। ছাড়ার আগে তাঁদের ছবি তুলে রাখে।

অজ্ঞাত যুবকের লাশ উদ্ধার

১৮ মে জাতীয় জরুরি সেবা ৯৯৯ নম্বরে ফোন পেয়ে যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশ মাতুয়াইলের একটি শণখেত থেকে হাত-পা ও মুখ বাঁধা অবস্থায় অজ্ঞাত এক যুবকের লাশ উদ্ধার করে। লাশটিতে পচন ধরে গিয়েছিল।

যুবকের আঙুলের ছাপ মিলিয়ে তাঁর নাম-পরিচয় জানতে পারে পুলিশ। নয়ন নামের এই ব্যক্তির পরিচয় জানার পর তাঁর পরিবারকে খবর দেওয়া হয়। তাঁরা থানায় এসে নয়নের লাশ শনাক্ত করেন।

পরিবার জানায়, নয়ন পেশায় অটোরিকশাচালক ছিলেন। থাকতেন যাত্রাবাড়ী থানার শেখদির মল্লিক ভিলা-২-এ। বাবার নাম বাবুল হোসেন।

এ ঘটনায় সন্দেহ থেকে পুলিশ প্রথমে রিকশাচালক রাশেদকে আটক করে। পরে দ্বীন ইসলামকে ধরা হয়। পুলিশ জানায়, জিজ্ঞাসাবাদে তিনি অটোরিকশা ছিনিয়ে নিয়ে নয়নকে হত্যা করে তাঁর লাশ গুম করার কথা স্বীকার করেন। পরে আদালতে স্বীকারোক্তি দেন।

যেভাবে রহস্য উদ্‌ঘাটন

ব্যাটারিচালিত অটোরিকশার খুন হওয়া চালক মো. নয়ন
ছবি: সংগৃহীত

পরিবারের সঙ্গে কথা বলে পুলিশ জানতে পারে, ১৪ মে সন্ধ্যায় যাত্রাবাড়ীর স্বপন মৃধা রোডের গ্যারেজ থেকে অটোরিকশা নিয়ে বের হন নয়ন। তিনি আর বাসায় ফেরেননি। নয়ন নিখোঁজ থাকার বিষয়ে তাঁর পরিবার ১৬ মে যাত্রাবাড়ী থানায় লিখিত অভিযোগ দেয়।

যাত্রাবাড়ী থানার উপপরিদর্শক (এসআই) হোসেন জায়েদ গতকাল বিকেলে প্রথম আলোকে বলেন, নয়নের নিখোঁজ থাকা, তাঁর চালানো অটোরিকশার হদিস না পাওয়ার তথ্য জানার পর ধলপুরের নিরাপত্তাচৌকির (১৪ মে রাতের) ঘটনাটি তাঁর মাথায় আসে। তুলে রাখা ছবির সঙ্গে মিলিয়ে প্রথমে রাশেদকে আটক করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদে রাশেদ বলেন, এক ভাঙারি দোকান থেকে এগুলো নিয়ে তাঁর রিকশায় উঠেছিলেন দ্বীন ইসলাম। এ তথ্যের ভিত্তিতে পুলিশ আজিজুল হক নামের ব্যক্তির ভাঙারির দোকানে অভিযান চালায়। সেখান থেকে দ্বীন ইসলামের বিক্রি করা অটোরিকশার চারটি ব্যাটারি, তিনটি চাকা, একটি মোটর ও একটি পাদানি জব্দ করা হয়। আজিজুলকে গ্রেপ্তার করা হয়। ১৯ মে জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জের শ্বশুরবাড়ি থেকে দ্বীন ইসলামকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

নয়নের লাশ উদ্ধারের ঘটনায় ১৯ মে তাঁর মা রিনা বেগম যাত্রাবাড়ী থানায় হত্যা মামলা করেন। এই মামলায় দ্বীন ইসলামকে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করে পুলিশ। তিনি নয়ন হত্যায় জড়িত থাকার কথা স্বীকার করে ঘটনার বর্ণনা দেন।

পরে নয়নের তথ্যের ভিত্তিতে তাঁর সহযোগী মমিনুল হক ওরফে মকবুলকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। সর্বশেষ গতকাল গ্রেপ্তার করা হয় তাঁর আরেক সহযোগী নিজাম ওরফে মিজানকে। গ্রেপ্তার দ্বীন ইসলাম ও আজিজুল ইতিমধ্যে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। গ্রেপ্তার চারজনই এখন কারাগারে।

জবানবন্দি

২২ মে আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন দ্বীন ইসলাম ও আজিজুল। পুলিশ সূত্র জানায়, জবানবন্দিতে দ্বীন ইসলাম বলেন, ১৪ মে তিনি, নিজাম ও মমিনুল মিলে অটোরিকশা ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা করেন। সেদিন রাত সাড়ে ৯টার দিকে তাঁরা মাতুয়াইলের গ্রিন মডেল টাউনে ঘুরতে যাবেন বলে যাত্রাবাড়ীর কাজলার ঢাল থেকে ৮০ টাকায় নয়নের অটোরিকশাটি ভাড়া নেন। নিজাম আগেই তাঁর বাসা থেকে একটি গামছা ও দড়ি নিয়ে আসেন।

অটোরিকশাটি মাতুয়াইলের গ্রিন মডেল টাউনে পৌঁছালে নিজাম অটোরিকশাচালক নয়নের গলায় গামছা পেঁচিয়ে তাঁকে নিচে ফেলে দেন। দ্বীন ইসলাম ও মমিনুল মিলে নয়নের হাত-পা ও মুখ রশি দিয়ে বেঁধে ফেলেন। পরে তাঁরা নয়নকে শ্বাসরোধে হত্যা করেন। নয়নের লাশ গ্রিন মডেল টাউনের সীমানাপ্রাচীরের ভেতরের শণখেতে ফেলে দেন তাঁরা। এরপর অটোরিকশাটি নিয়ে যান গোলাপবাগে ভাঙারি দোকানি আজিজুলের কাছে। তাঁরা অটোরিকশাটির বিভিন্ন যন্ত্রাংশ ১২ হাজার টাকায় বিক্রি করেন। দ্বীন ইসলাম তিন হাজার টাকা নেন। বাকি টাকা অন্যরা ভাগ করে নেন।

অটোরিকশার কাঠের কাঠামো ও হুড ভাঙারির দোকানে বিক্রি হয়নি। সেগুলোই রিকশায় করে নিয়ে যাওয়ার পথে ধলপুরে নিরাপত্তাচৌকিতে পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদের মুখে পড়েছিলেন দ্বীন ইসলাম। পরে দ্বীন ইসলাম তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে জামালপুরে চলে যান।

নয়নের বাবা বাবুল হোসেন পেশায় ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী। তিনি রাজধানীর গুলিস্তানের ফুটপাতে জুতা বিক্রি করেন। গতকাল বিকেলে যোগাযোগ করা হলে তিনি প্রথম আলোকে বলেন, নয়নের সাত মাস বয়সী একটি সন্তান আছে। নয়ন ও তাঁর আয়েই সাত সদস্যের পরিবারটি চলছিল। ছেলেকে হারিয়ে এখন তিনি অসহায় হয়ে পড়েছেন। তিনি তাঁর ছেলের হত্যাকারীদের ফাঁসি চান।