ডার্ক ওয়েব থেকে মাদক কিনে বিট কয়েনে অর্থ পরিশোধ

এসব মাদকের উৎস ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশ
ছবি: সংগৃহীত

ডার্ক ওয়েব (ইন্টারনেটের অন্ধকার জগৎ) থেকে অপপ্রচলিত নানা ধরনের ভয়ংকর মাদক কিনে দেশে নিয়ে আসছে কারবারিরা। এসব মাদকের অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে বিট কয়েনে (ক্রিপ্টোকারেন্সি বা ডিজিটাল মুদ্রা)। মাদকসংক্রান্ত এক মামলার তদন্তে এমন তথ্য উঠে এসেছে বলে জানিয়েছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর (ডিএনসি)।

ডিএনসির কর্মকর্তারা জানান, গত জানুয়ারির শেষের দিকে এক মাদক কারবারির ব্যবহৃত মুঠোফোন ও ল্যাপটপের ফরেনসিক পরীক্ষার প্রতিবেদন আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। ওই প্রতিবেদনে ডার্ক ওয়েব থেকে মাদক কেনা ও লেনদেনসংক্রান্ত বিস্তারিত তথ্য উঠে এসেছে।

এর আগে গত বছরের ৫ জুলাই ঢাকার বসুন্ধরা আবাসিক এলাকা থেকে দশমিক ৭৫ গ্রাম (১৩৮টি রঙিন প্রিন্টেড ব্লট পেপার স্ট্রিপ) এলএসডিসহ (লাইসার্জিক অ্যাসিড ডাইথ্যালামাইড) নাজমুল ইসলাম নামের এক মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) পরীক্ষাগারে তাঁর মুঠোফোন ও ল্যাপটপ পরীক্ষা করা হয়।

নাজমুলের বিরুদ্ধে করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা দক্ষিণ অঞ্চলের সহকারী পরিচালক সুব্রত সরকার প্রথম আলোকে বলেন, নাজমুল ঢাকার একটি বড় মাদক চক্রের সক্রিয় সদস্য। তিনি ডার্ক ওয়েব থেকে বিট কয়েন দিয়ে বিদেশ থেকে এলএসডি নিয়ে আসতেন। ২০২০ সালেও তিনি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে জামিনে মুক্ত হয়ে তিনি আবারও মাদক কারবারে যুক্ত হন। তিনি মূলত অনলাইন নেটওয়ার্কের মাধ্যমে উচ্চবিত্ত শ্রেণির মাদকসেবীদের কাছে এলএসডি সরবরাহ করতেন।

আরও পড়ুন

আলোচনায় এলএসডি, ডিওবি

২০২১ সালের ১৫ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র হাফিজুর রহমান নিজের গলায় ছুরি চালিয়েছিলেন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তাঁর মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে দেশে এলএসডির অস্তিত্ব থাকার কথা প্রথমবারের মতো জানতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তদন্তে বেরিয়ে আসে, বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্জন হল এলাকায় হাফিজুরের তিন বন্ধু তাঁকে এলএসডি সেবন করান। এর প্রতিক্রিয়া শুরু হলে তিনি শুধু একটি শর্টস পরে সেখান থেকে বেরিয়ে যান। এরপর ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের সামনে এক ডাব বিক্রেতার ভ্যানে রাখা দা নিয়ে তিনি নিজের গলায় আঘাত করেন।

ডার্ক ওয়েবে পরিচয় গোপন করে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ ও নিষিদ্ধ পণ্য কেনা যায়। এ কারণে সারা বিশ্বেই ডার্ক ওয়েব অপরাধীদের কাছে জনপ্রিয়। পণ্য কেনাবেচায় ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করা হয়। ক্রেতা-বিক্রেতা একে অপরকে চেনে না। আবার ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন করায় এ–সম্পর্কিত কোনো তথ্যও থাকে না।

এলএসডির অস্তিত্ব পাওয়ার মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে ২০২১ সালের ২১ নভেম্বর খুলনায় পাওয়া যায় ডিওবি। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর প্রথমে আসিফ আহমেদ ও অর্ণব কুমার শর্মা নামের দুই তরুণকে গ্রেপ্তার করে। পরে ঢাকা থেকে তাঁদের সহযোগী একটি কুরিয়ার সার্ভিসের কর্মী মামুনুর রশীদকেও গ্রেপ্তার করা হয়।

এ ধরনের মাদক মনের ওপর প্রভাব ফেলে, কখনো কখনো ভীতিকর অনুভূতি তৈরি করে
ছবি: সংগৃহীত

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা উত্তর অঞ্চলের সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ডার্ক ওয়েব থেকে ক্রিপ্টোকারেন্সি দিয়ে দুই তরুণ পোল্যান্ড থেকে ২০০ ব্লট ডিওবি (ডাইমেথক্সিব্রোমো অ্যাম্ফিটামিন) এনেছেন। তাঁদের কাছ থেকে উদ্ধার করা হয় ৯০ ব্লট ডিওবি।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তাদের ভাষ্য, এলএসডি ও ডিওবি কৃত্রিম মাদক, যা পরীক্ষাগারে তৈরি। মাদক দুটি দেশে অপ্রচলিত এবং খুবই ভয়ংকর। এসব মাদকের উৎস ইউরোপ ও আমেরিকার বিভিন্ন দেশ। এ ধরনের মাদক মনের ওপর প্রভাব ফেলে, কখনো কখনো ভীতিকর অনুভূতি তৈরি করে। নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না।

মাদকের পাশাপাশি ডার্ক ওয়েবে বিভিন্ন ধরনের অপরাধে যুক্ত থাকে অপরাধীরা। গত বছরের নভেম্বরে পুলিশের একটি বিশেষায়িত সংস্থা দেশে তিনজনকে গ্রেপ্তার করে, যাঁরা ডার্ক ওয়েব থেকে শিশু পর্নোগ্রাফির ভিডিও কিনতেন। সেই ভিডিও তাঁরা অনলাইনে অর্থের বিনিময়ে অন্যদের সরবরাহ করতেন।

বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ ইউনিটের মাধ্যমে ডার্ক ওয়েবে অপরাধীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে। তারা কী ধরনের পোস্ট দিচ্ছে, তাদের কনটেন্ট (আধেয়) কী—এসব তথ্য ও ডেটা বিশ্লেষণ করে অপরাধ ও অপরাধীদের সম্পর্কে ধারণা নেয়। সেই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তারা অনেক অপরাধীকে শনাক্ত করে।
বিএম মইনুল হোসেন, সহযোগী অধ্যাপক, তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক জাফরুল্ল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করে ডার্ক ওয়েব থেকে যাঁরা মাদক নিয়ে এসেছেন, তাঁদের অনেকেই আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তবে ডার্ক ওয়েবে সক্রিয় অপরাধীদের শনাক্ত করতে প্রযুক্তিগত সক্ষমতার ঘাটতি রয়েছে। প্রযুক্তিগত সক্ষমতা বৃদ্ধিসহ মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরকে আধুনিকায়নের একটি প্রকল্প এরই মধ্যে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে।

আরও পড়ুন

বিশেষ ইউনিট করা যেতে পারে

ফরেনসিক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, নাজমুল ল্যাপটপে বিশেষ ব্রাউজার ব্যবহার করে ডার্ক ওয়েবে প্রবেশ করতেন। তাঁর মুঠোফোনেও গ্লোবাল ভিপিএন ব্যবহার করে মাদক কেনার তথ্য পাওয়া গেছে। মুঠোফোনে বিন্যান্স (binance) অ্যাপে বিটকয়েনে লেনদেনসংক্রান্ত বার্তাও ছিল। বিন্যান্স হলো এমন একটি মাধ্যম, যেখানে ক্রিপ্টোকারেন্সি কেনাবেচা হয়। তাঁর হোয়াটসঅ্যাপ আইডিতে বিভিন্ন ধরনের মাদকের ছবি, মাদকসংক্রান্ত আর্থিক লেনদেনের তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে।

২০২১ সালের ১৫ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যবিজ্ঞান ও গ্রন্থাগার ব্যবস্থাপনা বিভাগের ছাত্র হাফিজুর রহমান নিজের গলায় ছুরি চালিয়েছিলেন। পরে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। তাঁর মৃত্যুর ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে দেশে এলএসডির অস্তিত্ব থাকার কথা প্রথমবারের মতো জানতে পারে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী।

ডার্ক ওয়েবকে ইন্টারনেটের একটি অন্ধকার জগৎ উল্লেখ করে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, স্বাভাবিক প্রক্রিয়ায় এসব ওয়েবসাইটে প্রবেশ করা যায় না। ডার্ক ওয়েবে পরিচয় গোপন করে বিভিন্ন ধরনের অবৈধ ও নিষিদ্ধ পণ্য কেনা যায়। এ কারণে সারা বিশ্বেই ডার্ক ওয়েব অপরাধীদের কাছে জনপ্রিয়। পণ্য কেনাবেচায় ক্রিপ্টোকারেন্সি ব্যবহার করা হয়। ক্রেতা-বিক্রেতা একে অপরকে চেনেন না। আবার ক্রিপ্টোকারেন্সিতে লেনদেন করায় এ–সম্পর্কিত কোনো তথ্যও থাকে না। এর ফলে প্রযুক্তিতে এগিয়ে থাকা দেশগুলোও ডার্ক ওয়েবে সক্রিয় অপরাধীদের শনাক্তে হিমশিম খাচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক বিএম মইনুল হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, বিশ্বের বিভিন্ন দেশ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিশেষ ইউনিটের মাধ্যমে ডার্ক ওয়েবে অপরাধীদের গতিবিধি পর্যবেক্ষণ করে। তারা কী ধরনের পোস্ট দিচ্ছে, তাদের কন্টেন্ট (আধেয়) কী—এসব তথ্য ও ডেটা বিশ্লেষণ করে অপরাধ ও অপরাধীদের সম্পর্কে ধারণা নেয়। সেই তথ্যের ওপর ভিত্তি করে তারা অনেক অপরাধীকে শনাক্ত করে।

মইনুল হোসেন আরও বলেন, আবার পণ্য কেনার পর ক্রিপ্টোকারেন্সিতে অর্থ পরিশোধ করার সময় তারা ঠিকানা ব্যবহার করে। সেসব ঠিকানা ভুয়া হলেও সংশ্লিষ্ট তথ্য ও ডেটা বিশ্লেষণ করে অনেক সময় অপরাধী পর্যন্ত পৌঁছানো যায়। সুতরাং ডার্ক ওয়েবে অপরাধী শনাক্তে নজরদারি করতে প্রযুক্তিতে দক্ষ ব্যক্তিদের সমন্বয়ে বিশেষ ইউনিট করা যেতে পারে।

আরও পড়ুন