ঢাকায় ওসির আটতলা বাড়িসহ বিপুল সম্পদ

রাজধানীর বছিলায় আটতলা বাড়ি, কেরানীগঞ্জসহ বিভিন্ন এলাকায় রমনা থানার ওসির একাধিক প্লট রয়েছে।

রাজধানীর বছিলা গার্ডেন সিটির ই ব্লকের ২০ নম্বরের এই বাড়ির মালিক রমনা থানার ওসি মনিরুল ইসলাম। সম্প্রতি তোলা ছবি
প্রথম আলো

ঢাকায় আটতলা বাড়ি করেছেন। বানাচ্ছেন আরেকটি ডুপ্লেক্স বাড়ি। ঢাকার কেরানীগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জে তাঁর রয়েছে চারটি প্লট। বাড়ি, প্লটসহ এই বিপুল সম্পদের মালিক ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) রমনা থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মনিরুল ইসলাম। রাজধানীর মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটিতে এক মুক্তিযোদ্ধার বাড়ি দখলেরও অভিযোগ রয়েছে তাঁর বিরুদ্ধে।

সরকারি একটি সংস্থার তদন্ত প্রতিবেদনের সূত্র ধরে প্রথম আলোর অনুসন্ধানে ওসি মনিরুলের এসব অবৈধ সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেছে। তবে পুলিশ সূত্র বলছে, যতটুকু তথ্য পাওয়া গেছে, তাঁর সম্পদের পরিমাণ এর চেয়ে অনেক বেশি।

পুলিশের একজন পরিদর্শক হয়ে ওসি মনিরুল কীভাবে এত সম্পদের মালিক হয়েছেন, তা নিয়ে পুলিশ বিভাগে আলোচনা চলছে। বর্তমানে তিনি নবম গ্রেডে ২২ হাজার টাকা স্কেলে সাকল্যে সর্বোচ্চ ৫০ থেকে ৭০ হাজার টাকা বেতন পান। অনিয়ম ও দুর্নীতির মাধ্যমে তিনি এই সম্পদের মালিক হয়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা ধারণা করছেন।

জানা যায়, ১৯৯২ সালে উপপরিদর্শক (এসআই) পদে পুলিশের চাকরিতে যোগ দেন মনিরুল ইসলাম, যখন এই পদটি তৃতীয় শ্রেণির ছিল। ২০১২ সালে পদোন্নতি পেয়ে পুলিশ পরিদর্শক হন। প্রায় ৩০ বছরের চাকরিজীবনে বেশির ভাগ সময় ঢাকা রেঞ্জে ছিলেন। তাঁর বাড়ি রাজবাড়ীর পাংশা উপজেলায়।

বছিলায় আটতলা বাড়ি

অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওসি মনিরুল ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় এসআই ও পরিদর্শক হিসেবে দুই দফায় প্রায় ৪ বছর ৮ মাস কাজ করেন। ওই সময় তিনি রাজধানীর বছিলায় চার কাঠা জমিতে আটতলা বাড়ি করেন। গত ২৫ জুন ওই বাড়িতে কথা হয় বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক শামছুল আলমের সঙ্গে। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভবনে ১৩টি ফ্ল্যাট আছে। এর চারটিতে ওসি মনিরুল ও তাঁর ভাইদের পরিবার থাকে। তিনি থাকেন তৃতীয় তলায়।

আটতলা বাড়িটির মালিকানা প্রসঙ্গে ওসি মনিরুল প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, বাড়িটি তাঁর একার নয়। ভাইদের সঙ্গে মিলে করেছেন।

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জে চার প্লট

দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানায় থাকাকালে নামে–বেনামে একাধিক প্লটের মালিক হন মনিরুল। ওই এলাকার জিতু মিয়ার মালিকানাধীন আবাসন প্রতিষ্ঠান বেয়ারা হাউজিংয়ে চার ও তিন কাঠার দুটি প্লট কেনেন তিনি। তিন কাঠার প্লটে ডুপ্লেক্স বাড়ির কাজ চলছে। গত ২ জুলাই হাউজিংয়ে ক্রেতা পরিচয়ে কথা হয় জমি কেনাবেচায় জড়িত মো. আবদুল কুদ্দুস মিয়ার সঙ্গে। তিনি বলেন, ওসি মনিরুল কেরানীগঞ্জ থানায় থাকতে এখানে প্লট কেনেন। তিনি চার কাঠার প্লটটি বিক্রি করে দেবেন বলে জানিয়েছেন। এর দাম ৫২ লাখ টাকা চাওয়া হচ্ছে। সর্বশেষ ২ আগস্ট প্রথম আলোর প্রতিবেদক পরিচয়ে আবদুল কুদ্দুস মিয়ার সঙ্গে কথা হয়। তিনি বলেন, দুটি প্লটের একটি প্লট এখনো ওসি মনিরুলের নামে আছে। অন্যটির কথা জানেন না।

ওসি মনিরুলের নামে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের আলী আকবর নগর এলাকার তেঘরিয়া মৌজায় ১০ কাঠার একটি প্লট রয়েছে। এই প্লটে একটি টিনশেড ঘর করে আলফা বলপেন নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া দেওয়া হয়েছে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রতিষ্ঠানটির এক কর্মচারী প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওসি স্যারের কাছ থেকে ভাড়া নিয়ে ঘরটি আমরা গুদাম হিসেবে ব্যবহার করছি।’

মনিরুল ইসলামের নামে দক্ষিণ কেরানীগঞ্জ থানার নতুন বাক্তারচর গ্রামের শেষ সীমানায় ও মুন্সিগঞ্জের সিরাজদিখান থানার বালুচর গ্রামে চরপানিয়া মৌজায় ভেনাস লেকভিউ আবাসন প্রকল্পে ৬০ শতক জমি রয়েছে। সম্প্রতি প্রকল্প এলাকায় কথা হয় একাধিক ব্যক্তির সঙ্গে। তাঁরা বলেন, এই প্রকল্পের মালিক সাবেক ইউনিয়ন পরিষদের সদস্য জব্বার মিয়া। এতে রমনা থানার ওসি ছাড়াও আরও কয়েকজন পুলিশ সদস্যের জমি রয়েছে।

গত ২৩ জুলাই ক্রেতা সেজে মুঠোফোনে কথা হয় আবাসন প্রকল্পের মালিক জব্বার মিয়ার সঙ্গে। তিনি তাঁর প্রকল্পে রমনার ওসি মনিরুলের ৬০ শতাংশ জমি থাকার বিষয়টি নিশ্চিত করেন।

কেরানীগঞ্জ ও মুন্সিগঞ্জে চারটি প্লট সম্পর্কে জানতে চাইলে মনিরুল দাবি করেন, ‘এসব জায়গায় আমার কোনো প্লট নেই।’

পুলিশ বিভাগ সূত্র জানায়, সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন না করা, কর্মমূল্যায়ন ভালো না থাকা এবং মামলাসংক্রান্ত গাফিলতির কারণে মনিরুলের বিরুদ্ধে একাধিকবার বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। তবে বেশির ভাগ সময়ই তাঁকে কেবল তিরস্কার করা হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধার জমি দখলের অভিযোগ

অভিযোগ রয়েছে, ২০০৫ সালে মোহাম্মদপুর হাউজিং সোসাইটিতে মুক্তিযোদ্ধা ও তথ্য মন্ত্রণালয়ের সাবেক জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব সরোজ কান্তি সরকারের ছয় কাঠার জমি দখল করেন মনিরুল ইসলাম। তখন তিনি এসআই ছিলেন। ওই জায়গায় তাঁর ভাই শফিকুল ইসলাম পরিবার নিয়ে থাকেন।

সরেজমিন গত ২৫ জুন দেখা গেছে, মোহাম্মপুর হাউজিং সোসাইটির ৭ নম্বর রোডের সব প্লটে বহুতল ভবন। ব্যতিক্রম ২৯ নম্বর বাড়িটি। এর মূল ফটক বন্ধ। প্লটে আধা পাকা তিনটি টিনশেড ঘর রয়েছে।

বাড়ির আশপাশের একাধিক বাসিন্দা প্রথম আলোকে বলেন, তাঁরা এটিকে ওসি স্যারের বাড়ি নামে চেনেন। তবে তাঁরা বলেন, এই জমি নিয়ে ঝামেলা চলছে। সম্প্রতি বাড়ির ফটকের দুই পাশে দুটি দোকান করে ভাড়া দিয়েছেন ওসি মনিরুল। নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক দোকানি প্রথম আলোকে বলেন, মাঝেমধ্যে ওই বাড়িতে ‘রমনা থানা’ লেখা গাড়ি আসে।

মোহাম্মদপুর ভূমি অফিস সূত্র জানায়, জমির প্রকৃত মালিক সরোজ কান্তি সরকার। তাঁর মৃত্যুর পর উত্তরাধিকার সূত্রে জমির মালিক তাঁর সন্তানেরা।

সরোজ কান্তির ছেলে জ্যোতিষ সরকার গত ১৪ জুলাই প্রথম আলোর কাছে অভিযোগ করেন, ‘২০০৫ সালে মনিরুল আমাদের জমিটি দখল করেন। আমরা এ ঘটনায় আইজিপির অভিযোগ সেলে লিখিত অভিযোগ দিয়েছি। ২০১৫ সালে মনিরুলের তিন ভাইসহ নয়জনকে বিবাদী করে ঢাকা যুগ্ম জেলা জজ আদালতে মামলা করেছি। মামলাটি এখনো মীমাংসা হয়নি।’

জ্যোতিষ সরকার বলেন, ‘করোনা মহামারি শুরুর পর দুটি আবাসন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানকে আমার কাছে পাঠিয়েছিলেন ওসি মনিরুল। আমি তাঁদের সঙ্গে বসতে রাজি হইনি।’

অভিযোগ প্রসঙ্গে রমনা থানার ওসি মনিরুল ইসলাম ২৩ জুলাই প্রথম আলোকে বলেন, ‘ওই জায়গা নিয়ে মামলা চলছে। সেখানে আমার ভাই পরিবার নিয়ে থাকেন।’

ওসির বিরুদ্ধে বাড়ি দখলের অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেলে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে বলে মত দিয়েছেন পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মোহাম্মদ নুরুল হুদা। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর বিরুদ্ধে দেওয়ানি বা ফৌজদারি অভিযোগ পাওয়া গেলে বিষয়টি আদালতের ও প্রশাসনের নজরে আনতে হবে। পুলিশ বলে নয়, যেখানে ক্ষমতা থাকে, সেখানে ক্ষমতা অপব্যবহারের আশঙ্কা থাকে। কেউ যদি কারও সম্পদ দখল করেন, সেটি দেওয়ানি অপরাধ। তদন্ত করে সাক্ষ্য–প্রমাণ পাওয়া গেলে তাঁর বিরুদ্ধে বিভাগী ব্যবস্থা নেওয়া যেতে পারে।

রমনা থানার ওসির বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ প্রসঙ্গে জানতে ডিএমপির কমিশনার মোহা. শফিকুল ইসলামের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করেও তাঁকে পাওয়া যায়নি। পরে তাঁর মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠালেও গতকাল বৃহস্পতিবার পর্যন্ত কোনো উত্তর দেননি।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, একজন পুলিশ কর্মকর্তা ক্ষমতার অপব্যবহার করে, মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে বিপুল সম্পদের মালিক হয়ে যে অপরাধ করেছেন, সে জন্য দুর্নীতি দমন কমিশনের (দুদক) উচিত স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত করে তাঁর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া। পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে শুধু তাঁকে বদলি নয়, জবাবদিহির আওতায় এনে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে।

প্রতিবেদন তৈরিতে সহায়তা করেছেন প্রতিনিধি, কেরানীগঞ্জ (ঢাকা)