ছিনতাইকারীদের কবলে পড়া ঢাবি অধ্যাপকের মুখে ভয়ানক পরিস্থিতির বিবরণ

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক গত ১৫ জানুয়ারি রাতে টেকনিক্যাল মোড় থেকে ক্যাম্পাসে নিজের বাসায় আসার সময় সিএনজি অটোরিকশার মধ্যে ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েনছবি: প্রতীকী

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক পেশাগত কাজে গত ১৪ জানুয়ারি গিয়েছিলেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। কাজ শেষে পরদিন বিকেলে একটি বাসে ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হন। রাত ১০টা ৫ মিনিটে বাস থেকে ঢাকার টেকনিক্যাল মোড়ে নামে তিনি। এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে যাওয়ার জন্য যানবাহন খুঁজতে থাকেন। একপর্যায়ে ২৫০ টাকা ভাড়ায় একটি সিএনজিচালিত অটোরিকশা ঠিক করেন।

অধ্যাপককে নিয়ে অটোরিকশাটি যখন জাতীয় হৃদ্‌রোগ ইনস্টিটিউট পার হয়ে গণভবনের সামনে আসে, তখন রাত ১০টা ৫৫ মিনিট। হঠাৎ গণভবনের সামনে এসে থেমে যায় অটোরিকশাটি।

হঠাৎ গাড়ি থেমে যাওয়ায় অধ্যাপক চালককে জিজ্ঞাসা করেন, ‘কী হয়েছে? গাড়িটি থামানো হলো কেন?’ জবাবে চালক বলেন, ইঞ্জিনে ত্রুটি দেখা দিয়েছে। তিনি গাড়িটি সচল করার চেষ্টা করছেন। চালকের কথায় আশ্বস্ত হয়ে অধ্যাপক অটোরিকশার ভেতর মুঠোফোন দেখছিলেন। হঠাৎ অটোরিকশার কাছে আসেন তিন ব্যক্তি। দুজনের বয়স চল্লিশের কাছাকাছি। আরেকজনের বয়স ত্রিশোর্ধ্ব।

কোনো কথা না বলে তিনজন অটোরিকশার দরজা খুলে অধ্যাপকের পাশে বসেন। একজন তাঁর মুখ চেপে ধরেন। আরেকজন গলায় ধারালো চাকু ধরে অধ্যাপককে বলেন, ‘তুই চিৎকার করলে গলা কেটে নামিয়ে দেব।’ ভয়ে তখন ওই অধ্যাপক চোখ বন্ধ করেন।

যান্ত্রিক ত্রুটির অজুহাত দেখিয়ে যে চালক গাড়ি থামান, তিনি আবার গাড়িটি সচল করেন। অটোরিকশাটি গণভবনের সামনের মোড় থেকে ঘুরিয়ে শেরেবাংলা নগর এলাকার দিকে চলতে থাকে।

এ ঘটনায় বেশ কয়েক দিন মানসিক সমস্যায় ভুগেছেন বলে জানান ওই অধ্যাপক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যখন আমি ছিনতাইকারীদের হাতে আটক হলাম, আমার সবকিছু কেড়ে নেওয়া হলো, গলায় আমার চাকু ধরল, বারবার আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে, তখন আমার মাথায় কেবল মৃত্যুচিন্তা ভর করেছিল। পরে নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা ঠান্ডা রাখতে সক্ষম হই। ছিনতাইকারীরা আমাকে যা করতে বলেছে, সেটিই করেছি।’

গলায় চাকু ধরে তিনজন ছিনতাইকারী প্রথমে অধ্যাপকের মুঠোফোনটি কেড়ে নেন। এরপর তাঁর কোলে থাকা ব্যাগটি কেড়ে নেন তাঁরা।

ছিনতাইকারীদের কবল থেকে বেঁচে ফেরা ওই অধ্যাপক গত ৪ মার্চ প্রথম আলোর কাছে এ ঘটনার বিস্তারিত তুলে ধরেন। এ ঘটনায় শেরেবাংলা নগর থানায় একটি মামলা দায়ের করেছেন বলে জানিয়েছেন তিনি।

‘দুই লাখ টাকা দিবি, নইলে তোকে মেরে ফেলব’

মুঠোফোন ও ব্যাগপত্র কেড়ে নেওয়ার পর অধ্যাপকের উদ্দেশে একজন ছিনতাইকারী বলেন, ‘আমাদের কাছে খবর আছে, তোর কাছে পাঁচ লাখ টাকা আছে। টাকাগুলো কোথায়?’ ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে যাওয়া অধ্যাপক তখন ওই ছিনতাইকারীদের বলেন, তিনি একজন শিক্ষক। পাঁচ লাখ টাকা তাঁর কাছে নেই।

অধ্যাপক যখন ছিনতাইকারীকে এ কথা বলেন, তখন আরেকজন ছিনতাইকারী ক্ষিপ্ত হন। তিনি অধ্যাপকের উদ্দেশে বলেন, ‘তুই এখনই দুই লাখ টাকা দিবি, নইলে তোর গলা কেটে দেব।’

ছিনতাইকারীর এ কথা শুনে আরও ভয় পেয়ে যান ওই অধ্যাপক। তিনি ছিনতাইকারীদের বলেন, ‘যত টাকাপয়সা আমার কাছে রয়েছে, তা তো আপনাদের কাছেই রয়েছে।’ অধ্যাপকের এ কথা শুনে আরও ক্ষিপ্ত হন ছিনতাইকারীরা। যেভাবেই হোক দুই লাখ টাকা এনে দেওয়ার জন্য ছিনতাইকারীরা অধ্যাপককে চাপ দিতে থাকেন। একপর্যায়ে অধ্যাপক ছিনতাইকারীদের কাছ থেকে নিজের মুঠোফোন নেন। তিনি তাঁর এক আত্মীয়কে ফোন করেন। ওই আত্মীয়কে বলেন, ‘আমি একটা বিকাশ নম্বর দিচ্ছি। এখনই এক লাখ বিকাশ করো।’

এ কথা বলার পরপরই অধ্যাপকের হাত থেকে মুঠোফোন কেড়ে নেন একজন ছিনতাইকারী। তখন ছিনতাইকারীদের দেওয়া বিকাশ নম্বরে ৪৫ হাজার টাকা পাঠান অধ্যাপকের ওই আত্মীয়। বিকাশে টাকা আসার পর অধ্যাপক ছিনতাইকারীদের উদ্দেশে বলেন, ‘ভাই, আপনারা তো টাকা পেয়েছেন। এবার আমাকে ছেড়ে দেন।’

অধ্যাপকের ওই কথা শোনার পর একজন ছিনতাইকারী বলতে থাকেন, ‘আপনার মোবাইলে এত ফোন আসে ক্যান, আপনি কিসের স্যার?’

তখন অধ্যাপক নিজের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় ছিনতাইকারীদের কাছে তুলে ধরেন। যে তিনজন ছিনতাইকারী অধ্যাপককে শুরুতে ‘তুই’ বলে সম্বোধন করেছিলেন, তাঁরা তখন তাঁকে ‘স্যার’ বলে ডাকতে থাকেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই অধ্যাপক মনে করেন, নাগরিকের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব পুলিশের। একজন নাগরিকের মনে যদি আতঙ্ক থাকে, চলাচল করতে ভয় পান, সেটি উদ্বেগজনক।  

একজন ছিনতাইকারী ওই অধ্যাপকে উদ্দেশে বলেন, ‘স্যার, আমরা আপনাকে নামিয়ে দিচ্ছি। আপনি গাড়ি থেকে নেমে পেছনে ফিরে তাকাবেন না। আপনি যদি পেছনে ফিরে তাকান, তাহলে আপনার অনেক বড় ক্ষতি হবে। আমাদের লোক আপনাকে ফলো (অনুসরণ) করবে।’

প্রায় ৪৫ মিনিট অধ্যাপককে জিম্মি করে অটোরিকশাটি শেরেবাংলানগর এলাকা ঘুরে এক পর্যায়ে সংসদ ভবনের সামনে আসে। তখন রাত সাড়ে ১১টার বেশি।

হঠাৎ করে তখন ওই তিন ছিনতাইকারী অধ্যাপককে অটোরিকশা থেকে নামিয়ে দেন। তখন সংসদ ভবনের সামনে নিরূপায় হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন অধ্যাপক। তাঁর পকেটে কোনো টাকা নেই। হতবিহ্বল ওই অধ্যাপক কীভাবে বাড়ি ফিরবেন, তা নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েন। একপর্যায়ে ইঞ্জিনচালিত একটি রিকশা নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসের বাসার উদ্দেশে রওনা হন। মধ্যরাতে বাসায় পৌঁছানোর পর স্ত্রীর কাছ থেকে টাকা নিয়ে রিকশাওয়ালার ভাড়া পরিশোধ করেন তিনি।

এ ঘটনায় বেশ কয়েক দিন মানসিক সমস্যায় ভুগেছেন বলে জানান ওই অধ্যাপক। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘যখন আমি ছিনতাইকারীদের হাতে আটক হলাম, আমার সবকিছু কেড়ে নেওয়া হলো, গলায় আমার চাকু ধরল, বারবার আমাকে মেরে ফেলার হুমকি দিচ্ছে, তখন আমার মাথায় কেবল মৃত্যুচিন্তা ভর করেছিল। পরে নিজেকে সামলে নিয়ে মাথা ঠান্ডা রাখতে সক্ষম হই। ছিনতাইকারীরা আমাকে যা করতে বলেছে, সেটিই করেছি।’

এ ঘটনায় এখনো ছিনতাইকারীদের কেউ গ্রেপ্তার না হওয়ায় হতাশা জানিয়ে ভুক্তভোগী অধ্যাপক প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি মামলায় ছিনতাইকারীদের দেওয়া বিকাশ নম্বর উল্লেখ করেছিলাম। কেন পুলিশ ছিনতাইকারীদের ধরতে পারছে না, সেটি বোধগম্য নয়।’

কেন ছিনতাইকারীদের ধরা হচ্ছে না, জানতে চাইলে শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মোহাম্মদ গোলাম আযম প্রথম আলোকে বলেন, ‘স্যারের সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। স্যারকে জিম্মি করে যারা টাকা আদায় করেছে, তাঁদের চিহিৃত করার কাজ চলছে।’

ছিনতাইকারীদের আইনের আওতায় আনার দাবি জানিয়ে অধ্যাপক প্রথম আলোকে বলেন, ‘সংঘবদ্ধ যে ছিনতাইকারীরা আমাকে জিম্মি করে টাকা আদায় করল, তারা যদি বিচারের আওতায় না আসে, তাহলে একই অপরাধ করতেই থাকবে। ছিনতাইকারীদের হাতে অনেকে খুন হচ্ছে। আমি ভাগ্যগুনে সেদিন বেঁচে ফিরেছি।’

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওই অধ্যাপক মনে করেন, নাগরিকের জানমাল রক্ষার দায়িত্ব পুলিশের। একজন নাগরিকের মনে যদি আতঙ্ক থাকে, চলাচল করতে ভয় পান, সেটি উদ্বেগজনক।