মতিঝিলে আ.লীগ নেতা খুন
দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ ৩৪ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র
হত্যার পরিকল্পনায় ছিলেন ৩০ জন। বাস্তবায়ন করেন ৪ জন। হত্যাকাণ্ডে সরাসরি অংশ নেন ৩ জন।
আওয়ামী লীগের নেতা জাহিদুল ইসলাম ওরফে টিপুকে হত্যা মামলায় বিদেশে পলাতক দুই শীর্ষ সন্ত্রাসীসহ ৩৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। গতকাল রোববার আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়।
তদন্তসংশ্লিষ্ট ডিবির কর্মকর্তারা বলেন, মতিঝিলকেন্দ্রিক চাঁদাবাজি ও রাজনৈতিক আধিপত্য—এ দুই কারণে তাঁকে হত্যা করা হয়। হত্যার পরিকল্পনায় বিদেশে পলাতক দুই শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসান আহমেদ ও জাফর আহমেদ ওরফে মানিকসহ ৩০ জনের নাম এসেছে। আর হত্যাকাণ্ড সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন তিনজন। সুমন শিকদার ওরফে মুসা পুরো বিষয়টি সমন্বয় করেন।
আদালত সূত্র জানায়, জাহিদুল হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ইতিমধ্যে জামিনে বেরিয়ে গেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন রাকিবুর রহমান, ইয়াসির আরাফাত, ইশতিয়াক আহম্মেদ, মশিউর রহমান ও আরিফুর রহমান (এক্সেল সোহেল)।
ডিবি বলছে, দীর্ঘ ১৪ মাস ধরে তদন্ত করে গুলি করে হত্যার ঘটনায় কয়জন অংশ নিয়েছিলেন, পরিকল্পনায় কারা ছিলেন, হত্যাকাণ্ডে কার কী ভূমিকা ছিল—সেসব তথ্যপ্রমাণ জোগাড় করা হয়েছে। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, হত্যার পরিকল্পনা থেকে বাস্তবায়নে একেকজনের একেক ধরনের ভূমিকা ছিল। এ হত্যায় সরাসরি অংশ নিয়েছিলেন ‘শুটার’ মাসুম মোহাম্মদ ওরফে আকাশ, তাঁর বন্ধু মোল্লা শামীম ও পলাশ ওরফে কাল্লা পলাশ। বাকিরা সবাই ছিলেন এ হত্যার পরিকল্পনাকারী।
ডিবির মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার রাজীব আল মাসুদ গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, জাহিদুল হত্যার ঘটনায় ৩৪ জনকে অভিযুক্ত করে আদালতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। চাঁদাবাজি নিয়ন্ত্রণ ও আধিপত্য বিস্তার নিয়ে দ্বন্দ্বের জেরে তাঁকে হত্যা করা হয়।
গত বছরের ২৪ মার্চ রাতে রাজধানীর শাহজাহানপুরে মতিঝিল থানা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক জাহিদুলকে গুলি করে হত্যা করা হয়। সে সময় ঘটনাস্থলে রিকশায় বসে থাকা কলেজছাত্রী সামিয়া আফনান ওরফে প্রীতিও (২২) গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান। এ ঘটনায় জাহিদুলের স্ত্রী ফারহানা ইসলাম শাহজাহানপুর থানায় হত্যা মামলা করেন। মামলাটি তদন্ত করছে ডিবির মতিঝিল বিভাগ।
তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, ঘটনার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ডিবি ‘শুটার’ মাসুম মোহাম্মদ আকাশকে গ্রেপ্তার করে। পরে তাঁর জবানবন্দিতে মূল পরিকল্পনাকারী সুমন শিকদারের (মুসা) নাম আসে। ডিবি ওমান থেকে গ্রেপ্তার করে গত বছরের জুনে ঢাকায় আনার পর আদালতে জবানবন্দি দেন মুসা। তাঁর জবানবন্দিতে এই হত্যায় জড়িত ১৬ জনের নাম উঠে আসে। তাঁদের অধিকাংশই ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও তার অঙ্গসংগঠনের রাজনীতির সঙ্গে যুক্ত। পুলিশ ও র্যাবের হাতে গ্রেপ্তার হন ২৫ আসামি। তবে অজ্ঞাত কারণে মারুফ আহমেদ ও গোলাম আশরাফ তালুকদারকে গ্রেপ্তার করা হয়নি।
আদালত সূত্র জানায়, জাহিদুল হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ইতিমধ্যে জামিনে বেরিয়ে গেছেন। তাঁদের মধ্যে রয়েছেন রাকিবুর রহমান, ইয়াসির আরাফাত, ইশতিয়াক আহম্মেদ, মশিউর রহমান ও আরিফুর রহমান (এক্সেল সোহেল)।
তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, সুমন হত্যাকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে জবানবন্দিতে আদালতে যাঁদের নাম এসেছিল, পুলিশের তদন্তেও তাঁদের সংশ্লিষ্টতা পাওয়া গেছে।
জবানবন্দিতে সুমন বলেন, গত বছরের ১৫ জানুয়ারি তিনি ঢাকা মহানগর দক্ষিণ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক গোলাম আশরাফ তালুকদারের ছোট ভাই টিটুকে ফোন দেন। তিনি তাঁকে বায়তুল মোকাররমের প্রধান ফটকের বিপরীত পাশে অবস্থিত ‘রুফটপ’ রেস্তোরাঁয় থাকতে বলেন। সেদিনই তিনি সেখানে যান। সেখানে আশরাফ, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের (ডিএসসিসি) ১০ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মারুফ আহমেদ ওরফে মনসুর, মতিঝিল থানা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি সোহেল শাহরিয়ার ওরফে রানা, ১০ নম্বর ওয়ার্ড যুবলীগের বহিষ্কৃত সভাপতি মারুফ রেজা ওরফে সাগর, মোল্লা রানা, এক্সেল সোহেল, আমিনুল ওরফে আমিনুর, বাবুল তালকুদার, রিফাত, টিটু ও খাইরুলকে দেখতে পান। বৈঠকে ঠিকাদারি ও স্কুলে ভর্তি-বাণিজ্য নিয়ে কথা শুরু হয়। একপর্যায়ে সোহেল শাহরিয়ার রেগে গিয়ে বলেন, জাহিদুল টেন্ডারের মধ্যস্থতা করেন। কিন্তু তাঁদের কাছে এসবের সঠিক হিসাব দেন না। বৈঠকে রিফাতের মুঠোফোন দিয়ে দুবাইয়ে থাকা মানিককে ফোন দেন সোহেল শাহরিয়ার। তিনি জিসানকেও এই বৈঠকে ভার্চ্যুয়ালি যোগ দেওয়ার জন্য মানিককে বলেন। এরপর জিসান ও মানিক উভয়ে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে বৈঠকে যোগ দেন। তাঁরা জাহিদুলের কর্মকাণ্ড নিয়ে রাগারাগি করেন। এ সময় খালেদ ও জাহিদুলের লোকদের এলাকাছাড়া করতে নির্দেশ দেন জিসান। আশরাফ-মারুফের উদ্দেশে জিসান ও মানিক বলেন, জাহিদুলকে মেরে ফেলতে হবে। জাহিদুল না থাকলে সবাই সুবিধা পাবেন।
সুমন জবানবন্দিতে আরও বলেন, বৈঠকে অংশ নেওয়া রবিনকে দুই দিনের মধ্যে দুই লাখ টাকা ব্যবস্থার দায়িত্ব দেন মারুফ। তবে সোহেল শাহরিয়ার এক্সেল সোহেলকে তিন লাখ, মারুফকে পাঁচ লাখ, রবিনকে দুই লাখ, বাবুলকে তিন লাখ ও টিটুকে পাঁচ লাখ টাকা জোগাড় করতে বলেন। এই টাকা জাহিদুল হত্যায় ব্যবহার করা হবে বলে জানানো হয়।
মামলার তদন্ত ও অভিযোগপত্র নিয়ে জাহিদুলের স্ত্রীর ফারহানা ইসলাম গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘আওয়ামী লীগ, যুবলীগ ও ছাত্রলীগের সাবেক ও বর্তমান নেতা-কর্মীরা এ হত্যার সঙ্গে জড়িত। অভিযোগ পত্রে যাঁদের নাম এসেছে, আমি তাঁদের ফাঁসির দাবি জানাই।’