রাতে ট্রাক নিয়ে ঘুরে ডাকাতি করেন তাঁরা

গ্রেপ্তার বাপ্পি ভান্ডারি, জালাল হাওলাদার ও আল আমিন
ছবি: সংগৃহীত

রাত তিনটা। রাজধানীর কাফরুল এলাকায় একটি নির্মাণাধীন ভবনের সামনে থামল একটি ট্রাক। সেটি থেকে নামলেন সাত–আটজন ব্যক্তি। বালুর ট্রাক এসেছে বলে ওই ভবনের নিরাপত্তাকর্মীকে ঘুম থেকে ডেকে তুললেন। নিরাপত্তাকর্মী তাঁর কক্ষের দরজা খুলতেই হাত–পা ও মুখ বেঁধে ফেলা হলো। তারপর ভবনে থাকা পাঁচ টন লোহার রড ট্রাকে তুলে পালিয়ে গেলেন তাঁরা। রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ভাটারার নতুনবাজার এলাকার একটি দোকানের সামনে গিয়ে থামে ট্রাকটি। তাঁদের কাছ থেকে রডগুলো অল্প দামে কিনে নেন দুই ব্যবসায়ী।

ডাকাতির এই ঘটনা গত ৫ জানুয়ারির। রাজধানীর মিরপুর, গুলিস্তান, বনানী, গুলশানসহ বিভিন্ন এলাকার সিসি ক্যামেরার ৩৫০টি ফুটেজ দেখে এই ডাকাত দলের সদস্যদের শনাক্ত করে পুলিশ। পরে ঢাকা, কেরানীগঞ্জ ও নারায়ণগঞ্জে  অভিযান চালিয়ে গত শনি ও সোমবার নয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে কাফরুল থানা–পুলিশ। তাঁদের মধ্যে তিনজন ডাকাতিতে সরাসরি জড়িত। বাকিরা ডাকাতির মালামাল কেনাবেচার সঙ্গে জড়িত বলে জানিয়েছে পুলিশ। গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত একটি ট্রাক, ৩১৫ কেজি রড এবং ৩ লাখ ৯৩ হাজার টাকা উদ্ধার করা হয়েছে।

পুলিশ বলছে, এই ডাকাত দলের প্রধান ইব্রাহিম নামের এক ব্যক্তি। তাঁর বাড়ি বরগুনার আমতলী উপজেলায়। পরিবার নিয়ে থাকেন নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লায়। পেশায় ট্রাকচালক। দিনে ট্রাক চালান, আর রাতে সেই ট্রাক দিয়ে ঢাকার উপকণ্ঠে বিভিন্ন এলাকায় নির্মাণসামগ্রী ও মালবাহী গাড়িতে ডাকাতি করেন তিনি ও তাঁর সহযোগীরা। ১২ বছর ধরে প্রতি সপ্তাহে ডাকাতি করে আসছেন। ইব্রাহিমের বিরুদ্ধে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন থানায় ছয়টি চুরি ও ছিনতাইয়ের মামলা রয়েছে। একাধিকবার গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারেও ছিলেন তিনি।

পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ডাকাত দলের গ্রেপ্তার সদস্যরা জানিয়েছেন, তাঁদের ভাড়া করা ট্রাক দিয়ে ঢাকার রাস্তায় চলন্ত মালবাহী গাড়িকে চাপ দিয়ে রাস্তার পাশে থামান। পরে চালক ও সহকারীকে নামিয়ে দিয়ে গাড়িটি নিয়ে পালিয়ে যান। আবার কখনো নিজেদের ট্রাকে মালামাল তুলে নিয়ে যান। একে ডাকাত দলের সদস্যরা বলেন ‘ঠ্যাক’ দিয়ে ডাকাতি। আর নির্মাণসামগ্রী ডাকাতিকে বলেন ‘সাইটে ডাকাতি’।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মিরপুর অঞ্চলের সহকারী কমিশনার হাসান মুহাম্মদ মুহতারিম প্রথম আলোকে বলেন, ঢাকার উপকণ্ঠে ট্রাক দিয়ে ডাকাতির পাঁচটি চক্র রয়েছে। তারা বিভিন্ন মালবাহী ট্রাক ও নির্মাণাধীন ভবনের রড, সিমেন্টসহ বিভিন্ন সামগ্রী লুট করে আসছে।

ঢাকার উপকণ্ঠে সক্রিয় ৫ চক্র

তদন্তসংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, রাজধানীতে পুলিশের নজরদারি বেশি থাকায় এবং রাত ১০টার আগে ট্রাক ঢুকতে না দেওয়ার কারণে রাজধানীর উপকণ্ঠে ডাকাতি করে ৫টি চক্র। প্রতিটি চক্রে রয়েছেন ৭ থেকে ১০ জন সদস্য। তাঁরা রাজধানীর সীমান্তবর্তী থানা এলাকা ও পার্শ্ববর্তী সাভার, আশুলিয়া, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও কেরানীগঞ্জে ডাকাতি করেন।

গ্রেপ্তার ডাকাত দলের সদস্যরা জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানিয়েছেন, তাঁরা দিনে শ্রমিকের কাজ করেন। রাত হলে নেমে পড়েন ডাকাতিতে। ডাকাতি করার আগে চক্রের কয়েকজন সদস্য ঘুরে ঘুরে লক্ষ্যবস্তু ঠিক করেন। এ কাজের সঙ্গে জড়িত ব্যক্তিদের ‘সার্ভেয়ার’ বলে ডাকেন চক্রের অন্য সদস্যেরা। কাফরুলে নির্মাণসামগ্রী ডাকাতির ঘটনায় ইব্রাহিমের নেতৃত্বে আটজন অংশ নেন। পুলিশ বলছে, তাঁর চক্রের তিন সদস্য গ্রেপ্তার হওয়ার পর ইব্রাহিম আত্মগোপনে রয়েছেন। তাঁকে গ্রেপ্তারের চেষ্টা চলছে। এ চক্রের গ্রেপ্তার তিন সদস্য হলেন আল আমিন (৩৪), জালাল হাওলাদার (৪৩) ও বাপ্পি ভান্ডারি (৩৫)।

ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত ট্রাক
ছবি: সংগৃহীত

পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, কাওসার, মুক্ত, জাহাঙ্গীর ও বিজয় নামের আরও চারজন ব্যক্তির নেতৃত্বে চারটি চক্র ডাকাতিতে জড়িত। এর মধ্যে কাওসারের চক্রের সদস্যরা গাজীপুরের টঙ্গী, তুরাগ ও আশুলিয়া এলাকায়, মুক্তারের চক্রের সদস্যরা রাজধানীর ডেমরা, যাত্রাবাড়ী ও কেরানীগঞ্জ এলাকায় এবং জাহাঙ্গীরের চক্রের সদস্যরা নারায়ণগঞ্জে ডাকাতি করেন। ডাকাতির পর পুলিশের চোখ ফাঁকি দিতে অনেক সময় ট্রাকের রং বদলে ফেলা হয়। যেমন কাফরুলে ডাকাতির পর ট্রাকের রং বদলানো হয়েছিল।

রাজধানীর দুই স্থানে কেনাবেচা হয় ডাকাতির পণ্য

পুলিশের তথ্যমতে, ডাকাতির পর জিনিসপত্র বিক্রি করা হয় রাজধানীর কারওয়ান বাজার ও ভাটারা এলাকায়। এই দুই এলাকার কয়েকজন ব্যবসায়ী ডাকাতদের কাছ থেকে সেগুলো অল্প দামে কিনে নেন। ডাকাতদের কাছ থেকে জিনিসপত্র কেনাবেচার অভিযোগে ছয়জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তাঁদের মধ্যে উজ্জল শেখ ভাটারা এলাকার ব্যবসায়ী। তিনি কাফরুল থেকে ডাকাতি হওয়া রড বাজারদরের চেয়ে ২০ টাকা কম দামে কিনে বিক্রি করেছিলেন। গ্রেপ্তার অন্যরা হলেন তাজুল ইসলাম (৩৫), রবিন মিয়া (২৫), মোস্তাকিম আহমেদ (২৮), রফিকুল ইসলাম (৩৫) ও শানু মিয়া (৪৮)।