ইসির অফিস সহায়ক পদ: দেড় কোটি টাকার চুক্তিতে পরীক্ষা না দিয়েই পাস ১৪ প্রার্থী

নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ‘অফিস সহায়ক’ পদের একজন নিয়োগপ্রার্থী দিনাজপুরের মোবারক হোসেন। প্রথমে নৈর্ব্যক্তিক (এমসিকিউ) পরীক্ষা হয়। নৈর্ব্যক্তিকে উত্তীর্ণ প্রার্থীদের নিয়ে হয় লিখিত পরীক্ষা। উভয় পরীক্ষায় ‘উত্তীর্ণ’ হন মোবারক।

মৌখিক পরীক্ষায় অংশ নিতে গত ২০ জুলাই মোবারক রাজধানীর আগারগাঁওয়ে নির্বাচন কমিশনে হাজির হন। মৌখিক পরীক্ষার নিয়োগ বোর্ডে তিনি কোনো প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে ব্যর্থ হন।

তখন নিয়োগ বোর্ডের সন্দেহ হয়। বোর্ডের সদস্যরা মোবারককে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেন। একপর্যায়ে মোবারক বলেন, ‘স্যার, আমি কোনো (এমসিকিউ-লিখিত) পরীক্ষা নিজে দিইনি। আমার হয়ে অন্য কেউ পরীক্ষা দিয়েছেন।’

মোবারক লিখিতভাবে নির্বাচন কমিশনের কাছে এই জালিয়াতির কথা স্বীকার করেন। লিখিত স্বীকারোক্তিতে তিনি বলেন, এমসিকিউ ও লিখিত পরীক্ষায় নিজে অংশ নেবেন না, কিন্তু উত্তীর্ণ করিয়ে দেবেন—এমন শর্তে তিনি এক ব্যক্তির সঙ্গে ১৪ লাখ টাকার চুক্তি করেন। চুক্তি অনুযায়ী, তিনি এমসিকিউ ও লিখিত কোনো পরীক্ষায় নিজে অংশ নেননি। তাঁর হয়ে অজ্ঞাত কেউ অংশ নিয়েছেন। এভাবে উভয় পরীক্ষাতেই তিনি উত্তীর্ণ হন। তিনি ইতিমধ্যে চুক্তির সাড়ে সাত লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন।

জালিয়াতি ধরা পড়ার পর ২০ জুলাই মোবারকের বিরুদ্ধে রাজধানীর শেরেবাংলা নগর থানায় মামলা করে নির্বাচন কমিশন। মামলায় মোবারকের ভাই মোবাশ্বেরুল ইসলামকেও আসামি করা হয়। মোবাশ্বেরুল নির্বাচন প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে (ইটিআই) মালি পদে কর্মরত। পরে নির্বাচন কমিশন কর্তৃপক্ষ মোবারক ও মোবাশ্বেরকে পুলিশে সোপর্দ করে।

একই পদে নিয়োগের এমসিকিউ ও লিখিত পরীক্ষা না দিয়ে উত্তীর্ণ হওয়ার অভিযোগে আরও ১৩ প্রার্থীকে আটক করে নির্বাচন কমিশন। জালিয়াতির এসব ঘটনায় মোট আটটি মামলা করেছেন নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব মো. নাজমুল কবীর।

জানতে চাইলে নাজমুল কবীর গতকাল বুধবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘নৈর্ব্যক্তিক ও লিখিত পরীক্ষায় অংশ না নিয়েও যেসব চাকরিপ্রার্থী টাকার বিনিময়ে উত্তীর্ণ হয়েছেন, এমন ১৪ জনকে আমরা ধরেছি। তাঁদের আটক করে পুলিশে দিয়েছি। মামলা করেছি। এমন আরও কেউ আছেন কি না, তা শনাক্তের কাজ চলছে।’

নির্বাচন কমিশন সূত্রে জানা যায়, অফিস সহায়কের ১৭৮টি পদে লোক নিয়োগের জন্য ৩ বছর আগে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয়। আবেদনের ন্যূনতম যোগ্যতা ছিল মাধ্যমিক পাস। এই পদে নিয়োগ পেতে অনলাইনে ১ লাখ ৩১ হাজার ব্যক্তি আবেদন করেন। রাজধানীর বিভিন্ন কেন্দ্রে নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় চলতি বছরের ৩১ মার্চ। নৈর্ব্যক্তিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের নিয়ে লিখিত পরীক্ষা হয় গত ১৯ মে। নৈর্ব্যক্তিক ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ প্রার্থীদের মৌখিক পরীক্ষা শুরু হয় জুলাই থেকে। মৌখিক পরীক্ষা এখনো চলছে।

নির্বাচন কমিশনের সংশ্লিষ্ট একাধিক কর্মকর্তা প্রথম আলোকে বলেন, মৌখিক পরীক্ষায় দেখা যায়, নৈর্ব্যক্তিক ও লিখিত পরীক্ষায় ভালো নম্বর পাওয়া কিছু প্রার্থী কোনো প্রশ্নের সঠিক উত্তর দিতে পারছেন না। এমন নিয়োগপ্রার্থীদের নৈর্ব্যক্তিক ও লিখিত পরীক্ষার উত্তরপত্র যাচাই-বাছাই করা হয়। এভাবে ১৪ নিয়োগপ্রার্থী ধরা পড়েন। তাঁরা প্রত্যেকে লিখিতভাবে নির্বাচন কমিশনের কাছে জালিয়াতির কথা স্বীকার করেন। তাঁরা বলেন, তাঁরা টাকা দিয়ে জালিয়াতির মাধ্যমে নৈর্ব্যক্তিক ও লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়েছেন। তাঁদের হয়ে অন্য কেউ নৈর্ব্যক্তিক ও লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিয়েছিলেন।

১৪ নিয়োগপ্রার্থীর স্বীকারোক্তির তথ্য পর্যালোচনা করে দেখা যায়, নৈর্ব্যক্তিক ও লিখিত পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেওয়ার জন্য তাঁরা মোট ১ কোটি ৬০ লাখ টাকার চুক্তি করেন। এর মধ্যে প্রায় ৯০ লাখ টাকা পরিশোধও হয়েছে। কোনো কোনো প্রার্থী সর্বোচ্চ ১২ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন।

শেরেবাংলা নগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা উৎপল বড়ুয়া গতকাল রাতে প্রথম আলোকে বলেন, নির্বাচন কমিশনের অফিস সহায়ক পদে নিয়োগ পেতে যাঁরা জালিয়াতির আশ্রয় নিয়েছেন, তাঁদের প্রত্যেককে আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করা হবে। যাঁদের বিরুদ্ধে ইতিমধ্যে মামলা হয়েছে, গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁদের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার জন্য আদালতে আবেদন করা হবে।

জালিয়াতিতে যুক্ত ব্যক্তিরা অধরা

নির্বাচন কমিশনের করা মামলাগুলোর কাগজপত্রের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা যায়, যে ১৪ নিয়োগপ্রার্থী গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁরা তাঁদের স্বীকারোক্তিতে এই জালিয়াতির সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের নাম ও মুঠোফোন উল্লেখ করেছেন। কত টাকার চুক্তি হয়েছে, কত টাকা দিয়েছেন, তা–ও তাঁরা বলেছেন। তবে জালিয়াতে যুক্ত এসব ব্যক্তির কেউ এখনো ধরা পড়েননি।

দিনাজপুরের মোবারক লিখিত স্বীকারোক্তির তথ্য বলেছেন, নৈর্ব্যক্তিক ও লিখিত পরীক্ষায় পাস করিয়ে দেওয়ার জন্য তিনি রাজু নামের একজনের সঙ্গে ১৪ লাখ টাকার চুক্তি করেছিলেন।

ধরা পড়া আরেক নিয়োগপ্রার্থী হাফিজুর রহমান তাঁর স্বীকারোক্তিতে বলেন, পল্লব হোসেন ও সোহাগের সহযোগিতায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তাঁর হয়ে পরীক্ষা দেন। পাঁচ লাখ টাকার বিনিময়ে তিনি এই পরীক্ষা দেন।

নিয়োগপ্রার্থী পলাশ চন্দ্র তাঁর স্বীকারোক্তিতে বলেন, বাচ্চু ও ফারুকের সহযোগিতায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তাঁর হয়ে পরীক্ষা দিয়ে দেন। সেই ব্যক্তির সঙ্গে ১৬ লাখ টাকার চুক্তি হয়। তিনি ১২ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন।

নিয়োগপ্রার্থী নূর মোহাম্মদ তাঁর স্বীকারোক্তিতে বলেন, শাহাজাহানের সহযোগিতায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তাঁর হয়ে পরীক্ষা দেন। সেই ব্যক্তির সঙ্গে তাঁর সাত লাখ টাকার চুক্তি হয়।

আবদুল্লাহ নামের নিয়োগপ্রার্থী তাঁর স্বীকারোক্তিতে বলেন, মোতালেবের মধ্যস্থতায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তাঁর হয়ে পরীক্ষা দেন। ১৪ লাখ টাকা চুক্তি হয়। তিনি ১২ লাখ টাকা দিয়েছেন।

নিয়োগপ্রার্থী তরিকুজ্জামান তাঁর স্বীকারোক্তিতে বলেন, রংপুরের নূর নবী ও সরোয়ারের সহযোগিতায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তাঁর হয়ে পরীক্ষা দিয়েছেন। ১২ লাখ টাকার চুক্তি হয়। তিনি ইতিমধ্যে সাত লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন।

সিরাজগঞ্জের সাথী খাতুন নামের নিয়োগপ্রার্থী স্বীকারোক্তিতে বলেন, জয়নাল ও নাজিমের সহযোগিতায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তাঁর হয়ে পরীক্ষা দিয়ে দেন। এ জন্য আট লাখ টাকা পরিশোধ করার কথা ছিল। তিনি ইতিমধ্যে পাঁচ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন।

কুড়িগ্রামের রকিবুল ইসলাম নামের নিয়োগপ্রার্থী তাঁর স্বীকারোক্তিতে বলেন, শামসুল আলমের সহযোগিতায় অজ্ঞাত এক ব্যক্তি তাঁর হয়ে পরীক্ষা দেন। ১৪ লাখ টাকার চুক্তি হয়। তিনি ব্যাংকের মাধ্যমে ১০ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন।

বরিশালের নিয়োগপ্রার্থী শাহ আলম বলেন, তাঁর হয়ে অজ্ঞাত এক ব্যক্তি পরীক্ষা দিয়েছেন। তিনি চুক্তির ১০ লাখ টাকার মধ্যে পাঁচ লাখ টাকা পরিশোধ করেছেন।

স্বীকারোক্তি অনুযায়ী, ঠাকুরগাঁওয়ের নিয়োগপ্রার্থী জহিরুল ইসলাম ১০ লাখ টাকার চুক্তিতে পাস করেছেন। ১৪ লাখ টাকার চুক্তিতে পাস করেছেন কুড়িগ্রামের রতন কুমার। পটুয়াখালীর শাকিল উদ্দিন ১৪ লাখ টাকার চুক্তিতে পাস করেন। ১২ লাখ টাকার চুক্তিতে পাস করেছেন নীলফামারীর মশিউর রহমান। রিপন ইসলাম পাস করেছেন ১০ লাখ টাকার চুক্তিতে।

নির্বাচন কমিশন সূত্র জানায়, নিয়োগপ্রার্থীরা প্রথমে অনলাইনে আবেদন করেন। পরে তাঁরা অনলাইন থেকে প্রবেশপত্র সংগ্রহ করেন। প্রত্যেক নিয়োগপ্রার্থীর ছবিযুক্ত তালিকা নির্বাচন কমিশনের কাছে সংরক্ষিত আছে।

তবে তারপরও প্রকৃত নিয়োগপ্রার্থীর পরিবর্তে কীভাবে অন্যরা নৈর্ব্যক্তিক ও লিখিত পরীক্ষায় অংশ নিতে পারলেন, সে ব্যাপারে যৌক্তিক কোনো ব্যাখ্যা দিতে পারেননি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।

জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশন সচিবালয়ের জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব নাজমুল কবীর প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি পরীক্ষাকেন্দ্রে নিয়োগপ্রার্থীদের ছবিযুক্ত তালিকা পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু কীভাবে অন্যরা পরীক্ষা দিতে পারল, তা তদন্তের বিষয়। এই জালিয়াতি কীভাবে হলো, কারা জড়িত, তা নিশ্চয়ই পুলিশি তদন্তে বেরিয়ে আসবে।

পুলিশের তেজগাঁও বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) এইচ এম আজিমুল হক গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, ‘এই জালিয়াতির ঘটনায় জড়িত প্রত্যেককে আমরা আইনের আওতায় এনে বিচারের মুখোমুখি করব।’