গত ১৯ সেপ্টেম্বর গ্রামের বাড়ি বাঁশখালী থেকে হাসান আলী স্ত্রীকে নিয়ে চট্টগ্রাম নগরের ইপিজেড এলাকায় ছোট ছেলের বাসায় বেড়াতে আসেন। সেদিন রাতে ওই বাসায় ছিলেন বড় ছেলেও। পরদিন সকালে সবাই একসঙ্গে নাশতা করেন। এরপর সম্পত্তি নিয়ে বাবা-ছেলেদের কথা-কাটাকাটি হয়। বাবা তাঁদের সম্পত্তি দেবেন না বলায় তাঁরা খেপে যান। নাশতা করার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই তাঁরা বাবাকে হত্যা করে টুকরা টুকরা করেন। পরে লাগেজ ও বস্তায় ভরে নগরের তিনটি স্থানে ফেলে দিয়ে আসা হয় তাঁর দেহাংশ।
বাঁশখালীর হাসান আলী খুনের মামলায় তাঁর ছোট ছেলে শফিকুর রহমান আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে এসব তথ্য জানান বলে মামলার তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। আজ মঙ্গলবার বিকেলে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট সাদ্দাম হোসেনের আদালতে তিনি জবানবন্দি দেন।
গত শুক্রবার ঢাকা থেকে শফিকুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। পরে তাঁকে তিন দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। আজ আদালতে তিনি জবানবন্দি দেন। এর আগে নগরের পতেঙ্গা থানার এ মামলায় শফিকুরের বড় ভাই মোস্তাফিজুর রহমান ও শফিকুরের স্ত্রী আনার কলি আদালতে খুন, লাশ টুকরা করে গুম করার বর্ণনা দিয়ে জবানবন্দি দিয়েছিলেন। হাসান আলীর স্ত্রী ছেনোয়ারা বেগমও এ মামলায় গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে আছেন।
২১ সেপ্টেম্বর রাতে নগরের পতেঙ্গা থানার ১২ নম্বর ঘাট এলাকায় খালের কাছ থেকে একটি লাগেজ উদ্ধার করে পুলিশ। এর ভেতরে মানুষের হাত ও পায়ের আটটি টুকরা পাওয়া যায়। উদ্ধার হওয়া আঙুলের ছাপের মাধ্যমে পরিচয় শনাক্ত হয় হাসান আলীর। এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে পতেঙ্গা থানায় একটি হত্যা মামলা করে। এরপর ২৩ সেপ্টেম্বর সকালে আকমল আলী রোডে ভাড়া বাসায় অভিযান চালিয়ে পুলিশ হাসান আলীর স্ত্রী ছেনোয়ারা বেগম (৫০) ও বড় ছেলে মোস্তাফিজুর রহমানকে (৩২) গ্রেপ্তার করে। তাঁদের বাসার পাশের একটি ডোবা থেকে লাশের আরও দুটি অংশ উদ্ধার করা হয়। কিন্তু মাথাটা এখনো পাওয়া যায়নি।
ক্ষোভ থেকে বাবাকে হত্যা করেন
আদালত সূত্র জানায়, শফিকুর রহমান আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে বলেন, হাসান আলী ২৬ বছর আগে বাড়ি ছেড়ে সিলেটে চলে যান। বছরখানেক আগে ফিরে এসে ভিটেবাড়ি বিক্রি করে দেওয়ার চেষ্টা চালান। এতে তাঁদের মা ও তাঁরা দুই ভাই বাধা দেন ও ক্ষোভ প্রকাশ করেন। ১৯ সেপ্টেম্বর তাঁদের মা–বাবা বাঁশখালী থেকে নগরে তাঁর বাসায় আসেন। পরদিন সকাল সাতটার দিকে বাবা, মা, তাঁর স্ত্রী ও বড় ভাই মিলে নাশতা করেন। এরপর ভিটেবাড়ি নিয়ে বাবার সঙ্গে তাদের ঝগড়া বাধে। বাবা কিছুতেই জমি তাঁদের দিতে রাজি নন। এমনকি তাঁদের মায়ের অসুখের বিষয়েও বাবার কোনো কিছু করার নেই বলে জানান। ভিটেবাড়ি তাঁদের না দিয়ে বিক্রি করে দেবেন বলে সাফ জানিয়ে দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে দুই ভাই বাবার হাত-পা বেঁধে ফেলেন এবং গলায় গামছা পেঁচিয়ে শ্বাস রোধ করে হত্যা করেন। পরে লাশটি একটি বস্তায় ভরে বাসায় রেখে দেন। তখন বাসায় তাঁর মা ও স্ত্রী আনার কলি ছিলেন। দুপুরে তাঁর ছোট বোনের স্বামীকেও খবর দিয়ে বাসায় নিয়ে আসেন। তাঁকে দিয়ে মাকে গ্রামের বাড়ি বাঁশখালী পাঠিয়ে দেন।
শফিকুর জবানবন্দিতে আরও বলেন, তাঁর স্ত্রী আনার কলি দোকান থেকে স্কচ টেপ এনে দেন। এরপর তাঁরা লাশটি টুকরা টুকরা করে স্কচ টেপ দিয়ে মুড়িয়ে নেন। ২১ সেপ্টেম্বর বড় ভাই লাগেজে করে আটটি টুকরা পতেঙ্গা ১২ নম্বর ঘাট এলাকায় ফেলে দেন। আর তিনি ও তাঁর স্ত্রী আনার কলি বাবার মাথাটি পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকতে পাথরের ব্লকে ফেলে দেন। এরপর তাঁরা ব্যাগটি নিয়ে বাসায় চলে আসেন।
মামলার তদন্ত কর্মকর্তা পিবিআই চট্টগ্রাম মেট্রো পরিদর্শক ইলিয়াস খান প্রথম আলোকে বলেন, আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন শফিকুর রহমান। পরে তাঁকে আদালতের নির্দেশে কারাগারে পাঠিয়ে দেওয়া হয়। লাশের মাথাটি এখনো পাওয়া যায়নি। এটি উদ্ধারের জন্য শফিকুর ও তাঁর স্ত্রীকে নিয়ে পতেঙ্গা সৈকতে বেশ কয়েকবার তল্লাশি চালানো হয়। হয়তো জোয়ারের পানির সঙ্গে ভেসে গেছে।