সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে ৫৯ বছর বয়সে নাম–পরিচয় বদল, ডিএনএ পরীক্ষায় ধরা

পারভেজ আহম্মেদ জাহানের প্রথম জাতীয় পরিচয়পত্র
ছবি: সংগৃহীত

প্রথম জাতীয় পরিচয়পত্রে (এনআইডি) তাঁর নাম পারভেজ আহম্মেদ জাহান। পিতার নাম মো. শাহ্জাহান। মায়ের নাম কাসমেরী বেগম। স্থায়ী ঠিকানা পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের ৩০ আগা নওয়াব দেউড়ি। এই এনআইডি ইস্যু করা হয় ২০০৮ সালের ২ এপ্রিল।

ছয় বছরের মাথায় ২০১৪ সালে পারভেজ আরেকটি এনআইডি নেন বলে অভিযোগ পুলিশের। অভিযোগ অনুযায়ী, পারভেজ এই এনআইডিতে নিজের নাম, মা-বাবার নাম ও স্থায়ী ঠিকানা পরিবর্তন করেন। দ্বিতীয় এনআইডিতে পারভেজ নিজের নাম দিয়েছেন ইফতেখার আহমেদ খান। বাবার নাম মমতাজুল হক খান। মায়ের নাম তাহমিনা বেগম। স্থায়ী ঠিকানা ১৮১ পূর্ব তেজতুরী বাজার, তেজগাঁও। তিনি ২০১৮ সালে ইফতেখার আহমেদ খান নামে পাসপোর্ট গ্রহণ করেন।

পুলিশ বলছে, ইফতেখার সেজে পারভেজ রাজধানীর তেজগাঁও থানায় প্রতারণার একটি মামলা করেন। এই মামলায় ঢাকার আদালতে চূড়ান্ত প্রতিবেদন দিয়েছে পুলিশ। অর্থাৎ তদন্তে অভিযোগের সত্যতা পায়নি পুলিশ। এই মামলার সূত্র ধরেই পারভেজের ইফতেখার সাজা, নাম-পরিচয় বদলে দ্বিতীয় এনআইডি নেওয়াসহ তাঁর প্রতারণা-জালিয়াতির তথ্য জানতে পারে পুলিশ।

ইফতেখার নামধারী পারভেজের অভিযোগের সত্যতা না পেয়ে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণা-জালিয়াতির অভিযোগে একটি মামলা করে তেজগাঁও থানা-পুলিশ। এই মামলায় আদালতে অভিযোগপত্র দিয়েছে পুলিশ।

২০১৮ সালে ইফতেখার আহমেদ খান নামে নেওয়া পাসপোর্ট
ছবি: সংগৃহীত

অভিযোগপত্রের তথ্য বলছে, মিথ্যা মামলা করার পাশাপাশি পারভেজ গুলশানের ৪৪ শতাংশ সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে জাল কাগজপত্র তৈরি করেন। জমির কাগজপত্রে তিনি নিজের নাম দেন ইফতেখার আহমেদ খান। তবে তিনি যে ইফতেখার আহমেদ খান নন, তা ডিএনএ পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে।

তদন্ত করতে গিয়ে পারভেজের প্রকৃত মা কাসমেরী বেগম ও ভাই দিদার আহম্মেদকে খুঁজে বের করে পুলিশ। পারভেজ কাসমেরী বেগমের সন্তান কি না, তা যাচাইয়ে তিনজনের ডিএনএ নমুনা নেওয়া হয়।

পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) ফরেনসিক ডিএনএ ল্যাবরেটরিতে ডিএনএ নমুনা পরীক্ষা করা হয়।

পুলিশের করা মামলার তদন্ত কর্মকর্তা তেজগাঁও থানার পরিদর্শক সরোয়ার আলম খান। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, পারভেজের বিরুদ্ধে প্রতারণা-জালিয়াতির একাধিক অভিযোগ রয়েছে। ডিএনএ পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে, তিনি কাসমেরী বেগমের সন্তান, তিনি ইফতেখার আহমেদ খান নন। সম্পত্তি হাতিয়ে নিতে তিনি ইফতেখার সেজেছিলেন।

তবে পারভেজের আইনজীবীরা দাবি করেন, তাঁদের মক্কেলকে তেজগাঁও থানা-পুলিশ মিথ্যা মামলায় জড়িয়েছে। সামাজিকভাবে হেয়প্রতিপন্ন করতে তাঁকে প্রতারণা-জালিয়াতির মামলার আসামি করা হয়েছে।

জানতে চাইলে পারভেজের আইনজীবী মো. শাহ আলম প্রথম আলোকে বলেন, ‘হয়রানি করার জন্যই আমার মক্কেলকে প্রতারণা-জালিয়াতির মামলায় জড়ানো হয়েছে।’

আদালতে জমা দেওয়া পুলিশের অভিযোগপত্রের তথ্য বলছে, প্রথম এনআইডি অনুযায়ী, পারভেজ জন্মগ্রহণ করেন ১৯৫৫ সালের ৫ অক্টোবর। জন্মের ৫৯ বছর পর ২০১৪ সালের ৬ জুলাই পূর্ব তেজতুরী বাজারের ঠিকানা ব্যবহার করে তিনি ঢাকার উত্তর সিটি করপোরেশন থেকে জন্মসনদ নেন। পরে একই নাম-ঠিকানা দিয়ে এনআইডির পাশাপাশি টিআইএন নম্বর নেন।

পুলিশ বলছে, পারভেজ উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত লেখাপড়া করেছেন। ১৯৭৭ সালে তিনি বিয়ে করেন। ১৯৭৮ সালে আবুধাবি চলে যান। ১৯৮০ সালে দেশে ফেরেন। পরে স্ত্রীকে নিয়ে নিউ ইস্কাটন এলাকায় বসবাস শুরু করেন।

ইফতেখার আহমেদ খান নামে করা জন্মসনদ
ছবি: সংগৃহীত

মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও তেজগাঁও থানার পরিদর্শক সরোয়ার আলম খান প্রথম আলোকে বলেন, পারভেজের বাবা শাহজাহান সরকারি গাড়িচালক ছিলেন। তাঁর নামে ইস্কাটনে পাঁচ কাঠা জমি ছিল। সেই জমি বিক্রি করতে মা–বাবা, ভাইবোনকে না জানিয়ে পারভেজ ভুয়া আমমোক্তারনামা তৈরি করেন। এই জমি দেখিয়ে ১৩ জনের কাছ থেকে তিনি টাকা নেন। ভুক্তভোগীরা ২০০১ সালে রাজধানীর কোতোয়ালি ও রমনা থানায় পারভেজের বিরুদ্ধে দুটি মামলা করেন।

তেজগাঁও থানা-পুলিশের দেওয়া অভিযোগপত্রের তথ্য বলছে, পারভেজ বেশ কয়েক বছর আগে তেজতুরী বাজার এলাকায় আসেন। তিনি সেখানে বসবাস শুরু করেন। পরে ভুয়া জন্মসনদ ও এনআইডি গ্রহণ করেন। একপর্যায়ে তিনি গুলশান এলাকার ৪৪ শতাংশ জমি হাতিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করেন। তিনি দাবি করেন, এই জমির মালিক ইনতেখাব আহম্মেদ খান। তিনি তাঁর ভাই। তাঁর কাছ থেকে তিনি ‘পাওয়ার অব অ্যাটর্নি’ পেয়েছেন। এই জমি বিক্রির জন্য প্রাথমিক বায়নাপত্র গ্রহণ করেন তিনি। জমির ভুয়া কাগজপত্র তৈরি করে তা রাজউকে জমা দেন। এক ব্যক্তির কাছ থেকে তিনি ৩০ লাখ টাকাও নেন।