পিস্তল–ওয়াকিটকি সবই খেলনা, আসল শুধু হাতকড়া

গোয়েন্দা পুলিশ পরিচয়ে ডাকাতিতে জড়িত অভিযোগে এই ছয়জনকে গ্রেপ্তার করেছে পুলিশ। তাঁদের কাছ থেকে খেলনা পিস্তল, ওয়াকিটকি, পিস্তলসহ নানা সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়েছে বলে ডিবির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন

গাড়িতে লাগানো ডিবি লেখা স্টিকার, গায়ে জড়ানো ডিবি লেখা জ্যাকেট, কারও হাতে পিস্তল, কারও হাতে ওয়াকিটকি—এই বেশে তিন বছরের বেশি সময় ধরে ঢাকা ও এর আশপাশের এলাকায় ডাকাতি করে আসছিল ১০–১২ জনের একটি দল। এই দলের নেতা ফরিদ উদ্দিন এসব সরঞ্জাম ও দলের সদস্যদের জড়ো করেছিলেন। তাঁদের জ্যাকেট, স্টিকার ছিল ভুয়া, আর পিস্তল ও ওয়াকিটকি ছিল খেলনা। তবে তাঁদের কাছে থাকা হাতকড়াটি ছিল আসল।

গোয়েন্দা পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়ার পর প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ফরিদ উদ্দিন বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যবহৃত ওই হাতকড়া (হ্যান্ডকাফ) তিনি সংগ্রহ করেছিলেন কাশিমপুর কারাগারে দায়িত্বরত জেল পুলিশের এক সদস্যের কাছ থেকে। এর জন্য তাঁকে খরচ করতে হয়েছিল ১০ হাজার টাকা।

ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) মতিঝিল বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার (এডিসি) আব্দুল্লাহ আল মামুন জানিয়েছেন, ঢাকার মতিঝিল থেকে গত রোববার ফরিদসহ চক্রের ছয় সদস্যকে গ্রেপ্তার করেন তাঁরা। আজ সোমবার তাঁদের আদালতে হাজির করার পর কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

ফরিদ উদ্দিনকে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে ডিবির কর্মকর্তারা বলেছেন, ডাকাত দলের এই সরদার ‘গুরুর’ সহায়তায় কাশিমপুর কারাগার থেকে হাতকড়া সংগ্রহ করার কথা জানিয়েছেন। জেল পুলিশের সদস্যরা হাতকড়া ব্যবহার করেন না। ওই সদস্য হয়তো সেটি অন্য কোনো উৎস থেকে সংগ্রহ করেছেন।

ফরিদের দেওয়া তথ্য যাচাই-বাছাই করা হচ্ছে। তাঁর গুরুর বিষয়েও খোঁজ শুরু হয়েছে।
এ বিষয়ে বক্তব্য জানতে চাইলে কাশিমপুর কারাগার–২–এর জেলার মুহাম্মাদ এনায়েত উল্যাহ প্রথম আলোকে বলেন, জেল পুলিশের সদস্যরা হাতকড়া ব্যবহার করেন না। তাঁদের কাছে হাতকড়া থাকার সুযোগও নেই। আসামি আনা–নেওয়ার ক্ষেত্রে পুলিশ সদস্যরা হাতকড়া ব্যবহার করেন। ডিবির জিজ্ঞাসাবাদে পাওয়া তথ্যের বিষয়ে জেলার বলেন, ‘এ বিষয়ে আমার জানা নেই।’

ফরিদ উদ্দিনের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরে; গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের ভাষ্যমতে, তিনি ডাকাত দলের নেতা। ১০ হাজার টাকা খরচ করে সংগ্রহ করেছিলেন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ব্যবহৃত হাতকড়া

ডিবি জানায়, এই চক্রের সদস্যরা ঢাকা ও আশপাশের এলাকায় ডাকাতি করতেন। ডিবি পরিচয়ে সাধারণ মানুষকে গাড়িতে তুলে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে সর্বস্ব লুটে নিতেন তাঁরা। ডিবির অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন-অর-রশীদ বলেন, চক্রের সদস্যরা সাধারণত ব্যাংক গ্রাহকদের লক্ষ্যবস্তু করতেন। তাঁরা গ্রাহকের ছদ্মবেশে ব্যাংকে ঢুকে লেনদেনকারী ব্যক্তিদের অনুসরণ করতেন। বেশি টাকা লেনদেনকারী কোনো একজনকে অনুসরণ করতেন। সুবিধাজনক স্থানে ডিবি পুলিশ পরিচয় দিয়ে ওই ব্যক্তিকে গাড়িতে তুলে ভয় দেখানো হতো। প্রাণনাশের হুমকি দিয়ে তাঁর কাছ থেকে টাকা ও অন্যান্য মূল্যবান সামগ্রী ছিনিয়ে নিতেন তাঁরা। পরে রাস্তায় কোনো সুবিধাজনক স্থানে ভুক্তভোগীকে গাড়ি থেকে ফেলে দিয়ে পালিয়ে যেত চক্রটি।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের বিষয়ে যা জানা গেল

ডিবির কর্মকর্তারা জানান, ফরিদ উদ্দিনের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরে। তিনি গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) পরিচয়ে ডাকাতি করেন এক দশকের বেশি সময় ধরে। আগে তিনি একটি ডাকাত দলের সদস্য ছিলেন। তিন বছরেরও বেশি সময় আগে নিজে আলাদা ডাকাত দল গঠন করে দলনেতা হন। ডাকাতির সময় তিনি ডিবির ওসি (ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) পরিচয় দিতেন।

এই দলের ‘সেকেন্ড ইন কমান্ড’ পারভেজ। তাঁর বাড়ি কেরানীগঞ্জের বৌনাকান্দিতে। ডাকাতির সময় তিনি উপপরিদর্শক (এসআই) পরিচয় দিতেন। মো. জসিম ও মো. নাসির নামের দুজন পরিচয় দেন কনস্টেবল হিসেবে। এর মধ্যে জসিমের বাড়ি নরসিংদীর মনোহরদীতে এবং নাসিরের বাড়ি গাজীপুরের টঙ্গীর এরশাদনগরে। গ্রেপ্তার অপর ব্যক্তি সাইফুল ইসলাম (নাদিম) গাড়ির চালক। তাঁর বাড়ি কেরানীগঞ্জের চলপাল পাড়ায়।

গোয়েন্দা কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, চক্রের প্রধান ফরিদ আগেও বিভিন্ন সময় গ্রেপ্তার হয়েছেন। তিনি আগে ডাকাত দলে কনস্টেবল ও এসআই পরিচয় দিলেও শেষের দিকে পরিদর্শক (ইন্সপেক্টর) পরিচয় দিতেন। দেশের বিভিন্ন থানায় এখন পর্যন্ত তাঁর বিরুদ্ধে ৯টি মামলার তথ্য পাওয়া গেছে।

ডিবি সূত্র জানায়, এই চক্রের সদস্যরা সর্বশেষ ২১ জুলাই কুমিল্লার চান্দিনায় এক ব্যবসায়ীর টাকা লুটে নেন। ওই দিন দুপুরে চান্দিনার ইসলামী ব্যাংক থেকে এক ব্যবসায়ী আড়াই লাখ টাকা তুলে বের হন। এ সময় বাইরে ডিবির পোশাক পরা কয়েকজন ওই ব্যবসায়ীকে টেনেহিঁচড়ে গাড়িতে তোলেন। তাঁদের শরীরে ডিবির পোশাক এবং গাড়িতে ডিবির স্টিকার থাকার কারণে ওই ব্যবসায়ীকে উদ্ধার করতে কেউ এগিয়ে আসেনি। চক্রের সদস্যরা ওই ব্যবসায়ীর কাছ থেকে টাকা ও মুঠোফোন কেড়ে নেন। পরে দূরে একটি নির্জন স্থানে তাঁকে ফেলে পালিয়ে যান তাঁরা।