প্রধান আসামির স্বীকারোক্তিতে নাম, তবু খালাস সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান

২০১৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর রাজধানীর পুরানা পল্টনের একটি বাসায় অভিযান চালিয়ে ৫ বস্তা মুদ্রা ও ৬১ কেজি সোনা উদ্ধার করেন শুল্ক গোয়েন্দারাফাইল ছবি

এক দশক আগে রাজধানীর পুরানা পল্টনের একটি বাসা থেকে ৫ বস্তা দেশি–বিদেশি মুদ্রা ও ৬১ কেজি সোনা উদ্ধারের মামলায় সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিনসহ ১১ আসামি খালাস পেয়েছেন। তবে শেখ মোহাম্মদ আলী নামের এক আসামির ২ বছরের কারাদণ্ড ও ৫০ হাজার টাকা জরিমানা করেছেন আদালত। ঢাকার ২১ নম্বর মহানগর বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক কুদরত–এ–ইলাহী চৌধুরী গত সোমবার এ রায় দেন।

রায়ে আদালত বলেছেন, ৬১ কেজি সোনা চোরাচালান মামলার প্রধান অভিযুক্ত এস কে মোহাম্মদ আলী ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান রিয়াজ উদ্দিনসহ অন্যান্য আসামির নাম বলেন। জবানবন্দিতে আসামির নাম এলেও তাঁদের পূর্ণাঙ্গ নাম–ঠিকানা ও পরিচয় উল্লেখ ছিল না।

রায়ে আদালত আরও বলেন, তদন্তকারী কর্মকর্তা কিসের ভিত্তিতে আসামিদের শনাক্ত করলেন বা তাঁরা কীভাবে আসামি অভিযুক্ত শেখ মোহাম্মদ আলীকে চোরাচালানে সহায়তা করলেন, এর কোনো ব্যাখ্যা অভিযোগপত্রে দেওয়া হয়নি। এসব আসামিদের কি বাংলাদেশের বাইরে আসা–যাওয়া ছিল? বা ঘটনার ঠিক আগে তাঁদের কেউ কি বাইরে থেকে বাংলাদেশে এসেছিলেন, সে ধরনের কোনো বক্তব্য অভযোগপত্রে নেই।

রায়ে বিচারক উল্লেখ করেন, এস কে মোহাম্মদ আলীর ১৬৪ ধারার স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে আসামিদের নাম থাকা ছাড়া আর কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ তাঁদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ উপস্থাপন করতে পারেনি। কাজেই অভিযোগ প্রমাণ করতে সক্ষম না হওয়ায় রিয়াজসহ বাকি আসামিদের বেকসুর খালাস দেওয়া হলো।

রিয়াজ উদ্দিন ছাড়া খালাস পাওয়া ১১ আসামির মধ্যে আছেন মজিবুর রহমান চৌধুরী, সালেহ আহম্মেদ, এস এম নুরুল ইসলাম, আবু আহম্মেদ, নবী নেওয়াজ খান, ওমর ফারুক, আলী হোসেন মুন্না, বাবু, উজ্জ্বল ঘোষ ও পংকজ সাহা।

রাষ্ট্রপক্ষে মামলা পরিচালনাকারী সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর (এপিপি) মো. শহীদ উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, মামলার প্রধান আসামি মোহাম্মদ আলীর কাছ থেকে ৬১ কেজি সোনা উদ্ধার করা হয়, সেটি প্রমাণিত হয়েছে। তবে সহযোগী হিসেবে মোহাম্মদ আলী আসামি রিয়াজ উদ্দিনসহ বাকিদের নাম বললেও তাঁদের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট অভিযোগ, তথ্যপ্রমাণ হাজির করতে পারেনি পুলিশ। তদন্তে দুর্বলতা ছিল, সেটি অস্বীকার করার উপায় নেই।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ঢাকা মহানগর পুলিশের পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্ট (পিএমও) পশ্চিম বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার গোলাম সাকলায়েন প্রথম আলোকে বলেন, এ মামলার রায় প্রকাশের তথ্য তাঁর জানা নেই। তিনিসহ মোট চারজন তদন্তকারী কর্মকর্তা মামলাটির তদন্ত করেন। মামলার দুই বছর পর তিনি তদন্তভার পেয়েছিলেন। শেখ মোহাম্মদ আলী স্বীকারোক্তিতে আসামিদের নাম বলেছিলেন। পরে তথ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে তিনি মোহাম্মদ আলীসহ ১২ জনের বিরুদ্ধে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেন।

২০১৪ সালের ২৫ ডিসেম্বর পুরানা পল্টনের একটি বহুতল ভবনে এস কে মোহাম্মদ আলীর (৫০) ফ্ল্যাটে অভিযান চালিয়ে শুল্ক গোয়েন্দারা ৫ বস্তা দেশি-বিদেশি মুদ্রা ও ৬১ কেজি ওজনের ৫২৮টি সোনার বার উদ্ধার করেন। এর সঙ্গে জড়িত অভিযোগে সেদিন তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। ওই বাসার বালিশের কভার, সোফার কুশনের ভেতরে, জাজিম-তোশকের নিচে, আলমারি ও বাসার ফলস (কৃত্রিম) ছাদের ওপর পাওয়া যায় ৫ বস্তা দেশি-বিদেশি মুদ্রা ও সোনার বার।

এ ঘটনায় শুল্ক গোয়েন্দা ও তদন্ত অধিদপ্তরের উপপরিচালক মোস্তাফিজুর রহমান বাদী হয়ে পল্টন থানায় মামলা করেন। মামলার এজাহারে বলা হয়, সোনা চোরাচালানে এস কে মোহাম্মদ আলী ও রিয়াজ উদ্দিন জড়িত। আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ, মোহাম্মদ আলীসহ অন্য আসামিরা সংঘবদ্ধ চোরাচালান চক্রের সক্রিয় সদস্য। পরস্পরের যোগসাজশে বিভিন্ন দেশ থেকে বাংলাদেশ ব্যাংকের অনুমোদন ছাড়া চোরাচালানের মাধ্যমে সোনার বার এনে বাসায় জমা রাখতেন। পরে আসামি উজ্জ্বল, বাবু ও পংকজদের সহায়তায় সোনা বিক্রি করতেন।

আদালত রায়ে ওই বাসা থেকে উদ্ধার করা ৬১ কেজি সোনা এবং ৫ কোটি ৯ লাখ ৯০ হাজার টাকা মূল্যমানের মুদ্রাগুলো রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করার নির্দেশ দিয়েছেন।

স্বীকারোক্তিতে কী বলেছিলেন মোহাম্মদ আলী
দণ্ডিত আসামি শেখ মোহাম্মদ আলী ১৬৪ ধারার জবানবন্দিতে বলেছিলেন, ১৯৮৭ সাল থেকে তিনি মুদ্রা বিনিময়ের ব্যবসা করতেন। একপর্যায়ে জনতা ব্যাংকের কর্মচারী রিয়াজ উদ্দিনের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়। পরে রিয়াজ উদ্দিন সিরাজগঞ্জ সদর উপজেলার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন।

মোহাম্মদ আলী বলেন, ১৯৯৫ সালে তিনি শেয়ার ব্যবসা শুরু করেন। আর ১৯৯৬ সালে মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসার নিবন্ধন নেন। তখন রিয়াজের গ্রামের বাসিন্দা নবী নেওয়াজও মুদ্রা বিনিময়ের ব্যবসা করতেন। তাঁর প্রতিষ্ঠানের নাম ঢাকা মানি এক্সচেঞ্জ। রিয়াজ তাঁর মেয়েকে সিলেটের মুন্নার সঙ্গে বিয়ে দেন। মুন্নার ঘনিষ্ঠ সহযোগী মুজিব ও রিয়াজ সোনার ব্যবসা শুরু করেন। এ ব্যবসা লাভজনক হওয়ায় পল্টনের সালেহ আহমেদ, নুরুদ্দিন, নামান, চট্টগ্রামের আবু, গুলশানের মিথুন, ওমর ফারুক ও রাসেল রিয়াজের সঙ্গে সোনার ব্যবসা শুরু করেন।

শেখ মোহাম্মদ আলী আরও বলেন, পল্টনে তাঁর বাসা থেকে যে ৫২৮টি সোনার বার (৬১ কেজি সোনা) উদ্ধার করা হয়েছে, সেগুলোতে সবার ভাগ রয়েছে। চার থেকে পাঁচ মাস আগে তাঁর বাসায় সোনার বারগুলো গচ্ছিত রেখেছিলেন সবাই। অবৈধ সোনার বার বিক্রির জন্য তাঁতীবাজারের মাসুম, বাবু, দুলু ও উজ্জ্বলের কাছে দেওয়া হয়। দেশের বাইরে থেকে আসা সোনার বারগুলো বিমানবন্দরে ছাড়ানোর জন্য সিভিল এভিয়েশনের (বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ) নুর ইসলাম, আবুল হোসেন, কাজী জাকের ও কামরুল দায়িত্ব পালন করতেন।