মাদক মামলার আসামিদের সাজা না হওয়ার ১০ কারণের কথা বলছে ডিএমপি

মামলার জব্দ তালিকা প্রস্তুতের সময়ে গরমিল, আলামতের সঠিক পরিমাণ ও অবস্থান সঠিকভাবে উল্লেখ না থাকাসহ ১০ কারণে মাদক মামলায় আসামিদের যথাযথ সাজা হচ্ছে না। সাম্প্রতিক সময়ে নিষ্পন্ন হওয়া কিছু মামলা পর্যালোচনা করে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) এসব কারণ চিহ্নিত করেছে।

তদন্ত কার্যক্রম শেষ করার সময় ১০টি বিষয় মেনে চলতে ডিএমপির আট অপরাধ বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট ইউনিটকে সম্প্রতি চিঠি দেওয়া হয়েছে। ডিএমপির ওই চিঠিতে বলা হয়েছে, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইন একটি বিশেষায়িত আইন। তদন্ত কার্যক্রমের সময় কিছু ত্রুটি-বিচ্যুতির কারণে মাদক মামলায় আসামিদের প্রত্যাশিত সাজা নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না।

মাদক মামলার আসামিদের যথাযথ সাজা না হওয়ার পেছনে অন্য কারণগুলোর মধ্যে রয়েছে—এজাহার দায়েরকারী ও তদন্ত করা পুলিশ কর্মকর্তা একই ব্যক্তি হওয়া; মাদক উদ্ধার মামলার ক্ষেত্রে অধিকাংশ সময় জব্দ তালিকায় ভাসমান ও অস্থায়ী ঠিকানার ব্যক্তিদের সাক্ষী করা; বর্তমানে প্রচলিত সাক্ষ্য আইনের বিধান অনুসারে জব্দ করা আলামত উদ্ধার অভিযান; তলব করা সাক্ষীদের সঠিক সময়ে আদালতে উপস্থাপন না করা ও রাষ্ট্রপক্ষের মামলা পরিচালনার ক্ষেত্রে দায়িত্বশীলতার অভাব পরিলক্ষিত হওয়া ইত্যাদি।

২০১২ সালের ১ ডিসেম্বর রাজধানীর নিউমার্কেট এলাকা থেকে তৎকালীন এক সরকারি কর্মকর্তাকে ফেনসিডিলসহ গ্রেপ্তার করেছিল পুলিশ। তাঁকে বহনকারী মাইক্রোবাস থেকে ৩৪২ বোতল ফেনসিডিল জব্দ করা হয়েছিল। কিন্তু মামলা দায়ের ও জব্দ তালিকায় ত্রুটি থাকায় মামলা করা পুলিশ কর্মকর্তাকে তলব করেছিলেন ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম)। ৩৪২ বোতল ফেনসিডিল উদ্ধার করা হলেও তার ওজন বা পরিমাণ কত ছিল, তা এজাহার বা অভিযোগপত্রে উল্লেখ ছিল না। এ কারণে ওই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে অপরাধ প্রমাণিত হলেও বিচারিক আদালত জাবেদকে চার বছরের বেশি কারাদণ্ড দিতে পারেননি। মামলায় দুর্বলতার সুযোগে পরে হাইকোর্ট থেকে খালাস পান তিনি।

সাক্ষ্য গ্রহণের সময় এসবই (ডিএমপি কমিশনারের ১০ নির্দেশনা) মামলার প্রয়োজনীয় উপাদান। তদন্ত কর্মকর্তারা এসব নির্দেশনা মেনে চললে ভবিষ্যতে মাদক মামলার আসামিদের খালাস পাওয়ার সুযোগ থাকবে না, বরং সাজা বাড়বে।
তাপস কুমার পাল, অতিরিক্ত পিপি, ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত

পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছেন, মাদকের মামলার জব্দ তালিকা, এজাহার ও তদন্তে এমন ত্রুটি থাকার ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। ফলে মাদকদ্রব্য আইনের অধিকাংশ মামলায় আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছেন।

ডিএমপি সদর দপ্তরের মাদকের মামলায় খালাস পাওয়া আসামির সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত—১৪ বছরে সারা দেশে অধিদপ্তরের করা ৩২ হাজার ৪৮০টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৪৩৪ মামলার আসামিরা বেকসুর খালাস পেয়েছেন। এ সংখ্যা ১৮ হাজার ৩৩৫, যা মোট আসামির ৫২ দশমিক ২ শতাংশ।

ফৌজদারি কার্যবিধির ১০৩ ধারার উপধারাগুলোতে বলা হয়েছে, তল্লাশি করার আগে ওই এলাকার দুই বা ততোধিক গণ্যমান্য ব্যক্তিকে উপস্থিত থাকতে আহ্বান করা বা লিখিত আদেশ দেওয়া, তাদের সামনে তল্লাশি করে মাদকদ্রব্যের তালিকা তৈরি করতে হবে। পরে তাতে উপস্থিত ব্যক্তিদের সই নিতে হবে ও সাক্ষীদের সই করা জব্দ তালিকার অনুলিপি (কপি) উপস্থিত দাখিলদারকে দিতে হবে।

তবে আইনের এসব বিধান সঠিকভাবে মানছেন না পুলিশ কর্মকর্তারা। পাশাপাশি মামলার এজাহার, তদন্ত ও সাক্ষীদের সাক্ষ্য দিতে না আসা এবং আদালতে ভুল সাক্ষ্য দেওয়ার ঘটনাও ঘটছে। আসামিদের খালাসের পেছনে এসব গাফিলতিকে দায়ী মনে করেন রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের তথ্যমতে, ২০০৯ থেকে ২০২২ সাল পর্যন্ত—১৪ বছরে সারা দেশে অধিদপ্তরের করা ৩২ হাজার ৪৮০টি মামলা নিষ্পত্তি হয়েছে। এর মধ্যে ১৬ হাজার ৪৩৪ মামলার আসামিরা বেকসুর খালাস পেয়েছেন। এ সংখ্যা ১৮ হাজার ৩৩৫, যা মোট আসামির ৫২ দশমিক ২ শতাংশ।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (অতিরিক্ত পিপি) তাপস কুমার পাল গত মঙ্গলবার রাতে প্রথম আলোকে বলেছেন, ভাসমান লোকের মুঠোফোন নম্বরও থাকে না। জব্দ তালিকার সাক্ষী অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু তাঁদের সঠিক নাম-ঠিকানা না থাকায় তাঁদের আর পাওয়া যায় না। যদিও কাউকে কাউকে পাওয়া যায়, তখন ওই সাক্ষী বলেন, ঘটনা তিনি দেখেননি, তবু সাদা কাগজে তাঁদের স্বাক্ষর নেওয়া হয়েছে। এসব কারণে মামলার বেশির ভাগ আসামি খালাস পেয়ে যাচ্ছেন।

ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশনাগুলোর প্রশংসা করে তাপস কুমার পাল বলেছেন, সাক্ষ্য গ্রহণের সময় এসবই মামলার প্রয়োজনীয় উপাদান। তদন্ত কর্মকর্তারা এসব নির্দেশনা মেনে চললে ভবিষ্যতে মাদক মামলায় আসামিদের খালাস পাওয়ার সুযোগ থাকবে না, বরং সাজা বাড়বে।

আইনজীবী তাপস পাল আরও বলেন, মামলার বাদী, তদন্ত কর্মকর্তা বদলি হয়ে অন্যত্র চলে যাওয়ার সময় তাঁর মুঠোফোন নম্বর বা কোথায় যাচ্ছেন, সেই কর্মস্থলের ঠিকানা থানার নিবন্ধন খাতায় লিখে যেতে হবে। এতে সাক্ষ্য চলার সময় যোগাযোগ করে সংশ্লিষ্ট পুলিশ কর্মকর্তাকে ডেকে আনা যাবে।

মাদক মামলায় আসামিদের সাজা না হওয়ার কারণ চিহ্নিত করে পুলিশের করণীয় নিয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মাদক মামলা হওয়ার আগে ও মামলা হওয়ার পর তদন্তকারী কর্মকর্তাদের এসব মেনে চলতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
হাবিবুর রহমান, ডিএমপি কমিশনার

কোনো ভুলের কারণে আসামিরা যাতে খালাস না পান, তা কাটিয়ে উঠতে ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান ১০টি বিষয়ে মেনে চলতে নির্দেশ দিয়েছেন। সেগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য—জব্দ তালিকার প্রকৃত সময়, তারিখ ও ঘটনাস্থলের সঙ্গে মিল রেখে মামলা করা নিশ্চিত করতে হবে। এজাহার দায়েরকারী কর্মকর্তাকে ছাড়া অন্য কর্মকর্তাকে দিয়ে মামলার তদন্ত করতে হবে। মাদক মামলায় জব্দ করা আলামত সংখ্যা নয়, ওজনে সঠিক পরিমাপ করা। কোনো অবস্থাতেই ভাসমান দোকানদার কিংবা ভাসমান ব্যক্তিদের জব্দ তালিকার সাক্ষী করা যাবে না।

ডিএমপি কমিশনারের নির্দেশনায় আরও বলা হয়েছে, জব্দ তালিকার সাক্ষীদের জবানবন্দি কার্যবিধির ১৬১ ধারায় লিপিবদ্ধ করে সাক্ষীদের সঙ্গে সঙ্গে পড়ে শোনাতে হবে। মামলার বিচারকালে কাঠগড়ায় ওঠার আগেই সাক্ষীকে ঘটনা সম্পর্কে জব্দ তালিকার বিষয়ে আবারও মনে করিয়ে দিতে হবে। সংশোধিত সাক্ষ্য আইনে ছবি ও ভিডিও চিত্রের সাক্ষ্যগত মূল্য রয়েছে। সুতরাং জব্দ তালিকা প্রস্তুতকালে অবশ্যই ছবি ও ভিডিও ধারণ করে মামলার নথিপত্রে সংযুক্ত করতে হবে। মামলার তদন্ত শেষে ‘চার্ট অব এভিডেন্স’ অবশ্যই দাখিল করতে হবে। যথাসময়ে সাক্ষীকে আদালতে হাজির ও উপস্থাপন নিশ্চিত করতে হবে ইত্যাদি।

জানতে চাইলে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার হাবিবুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, মাদক মামলায় আসামিদের সাজা না হওয়ার কারণ চিহ্নিত করে পুলিশের করণীয় নিয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। মাদক মামলা হওয়ার আগে ও মামলা হওয়ার পর তদন্তকারী কর্মকর্তাদের এসব মেনে চলতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এতে মাদকের মামলায় আসামিদের সাজার হার বেড়ে যাবে। ফলে আসামিরা কারাগারে আটক থাকলে মাদকের সরবরাহ কমে যাবে।