পেটের মধ্যে ইয়াবা গলে মৃত্যু হচ্ছে, তারপরেও এভাবে পাচার বাড়ছে

ইয়াবা
ফাইল ছবি

গত তিন মাসে (অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর) ১ লাখ ৬৩ হাজার ইয়াবা বড়ি উদ্ধার করেছে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের (ডিএনসি) ঢাকা উত্তর অঞ্চল। এর মধ্যে ২২ হাজার ইয়াবা উদ্ধার করা হয়েছে বাহকের পেট থেকে। অর্থাৎ উদ্ধার হওয়া ইয়াবার প্রায় ১৩ শতাংশই বাহক পেটে বহন করে নিয়ে এসেছেন।

ডিএনসির উত্তর অঞ্চলের এক কর্মকর্তা তাঁদের তিন মাসে ইয়াবা উদ্ধারসংক্রান্ত তথ্য তুলে ধরে এই পরিস্থিতিকে খুবই উদ্বেগজনক ও ঝুঁকিপূর্ণ বলছেন। তাঁর ভাষ্য, দুই বছর ধরে এই প্রবণতা বাড়ছে। পেটে ইয়াবা বহনে মৃত্যুঝুঁকি আছে, এটা বাহক জানেন। তবু মাদক কারবারিদের প্রলোভনের ফাঁদে পড়ে তাঁরা এই কাজ করছেন। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর হাতে ধরা পড়ার ঝুঁকি কম এবং বাড়তি অর্থপ্রাপ্তির জন্যই বাহকেরা এমন ঝুঁকি নিচ্ছেন। নারী ও শিশুদেরও এমন কাজে ব্যবহার করছেন মাদক কারবারিরা। কখনো কখনো রোহিঙ্গাদের এই কাজে ব্যবহার করছেন তাঁরা।

ডিএনসি বলছে, পেটে করে ইয়াবা বহন করতে গিয়ে গত ৬ বছরে ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে তাঁদের কাছে তথ্য রয়েছে। এর মধ্যে চট্টগ্রামে ছয়জন, ঢাকায় তিনজন ও সিরাজগঞ্জে একজন মারা গেছেন। মারা যাওয়া ব্যক্তিদের মধ্যে চারজনের বাড়ি কক্সবাজারে এবং দুইজনের বাড়ি চট্টগ্রামে। পেটের মধ্যে থাকা ইয়াবা গলে তার বিষক্রিয়াতেই সবার মৃত্যু হয়েছে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন নারী ও একজন কিশোর রয়েছে।

ডিএনসির ঢাকা বিভাগীয় কার্যালয়ের অতিরিক্ত পরিচালক জাফরুল্ল্যাহ কাজল প্রথম আলোকে বলেন, বাহক পেটে করে ইয়াবা বহন করছেন, এটা খুবই উদ্বেগজনক পরিস্থিতি। কারণ, কাউকে তল্লাশি করে ইয়াবা উদ্ধার করা সম্ভব হচ্ছে না, অথচ তিনি ইয়াবা বহন করছেন। এ ক্ষেত্রে একবারে সুনির্দিষ্ট তথ্য পেলেই কেবল ইয়াবা উদ্ধার করা সম্ভব। এমনকি শতভাগ নিশ্চিত হওয়ার পর হাসপাতালে নিয়ে এক্স-রে করে নিশ্চিত হতে হয় বাহকের পেটে ইয়াবা রয়েছে।

পেট থেকে ইয়াবা উদ্ধারও ঝুঁকিপূর্ণ  

ঘটনাটি গত বছরের মার্চের। ইয়াবা আছে এমন সন্দেহ থেকে রাকিব মোল্লা নামের এক যুবককে আটক করেন ডিএনসির কর্মকর্তারা। কিছুক্ষণ পরই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। তাঁকে দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়। অবস্থার অবনতি হলে তাঁকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠানো হয়। সেখানেই চিকিৎসাধীন অবস্থায় তিনি মারা যান। ময়নাতদন্তের সময় দেখা যায়, তাঁর পেটে থাকা কিছু ইয়াবা গলে গেছে। এক হাজারের বেশি পিস ইয়াবা পাওয়া যায় তাঁর পেটে। ওই অভিযানে থাকা ডিএনসির পরিদর্শক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা এখন ঢাকায় কর্মরত। তিনি নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, মামুনের মৃত্যু হয়েছিল ডিএনসির হেফাজতে। এ নিয়ে অভিযানে থাকা সবাই ভয় পেয়ে যান। তাঁর পরিবারের সদস্যরা নির্যাতনে মৃত্যুর অভিযোগ তুলেছিলেন। ময়নাতদন্তের সময় পুলিশ ও মামুনের পরিবারের সদস্যরা ছিলেন। তাঁর পেটে যখন ইয়াবা পাওয়া গেল, তখন তাঁরা বুঝতে পেরেছেন পেটে থাকা ইয়াবা গলেই মামুনের মৃত্যু হয়েছে।

ডিএনসির এই কর্মকর্তার ভাষ্য, নিশ্চিত তথ্য রয়েছে বাহক পেটে ইয়াবা নিয়ে এসেছেন। তাঁকে ‘চ্যালেঞ্জ’ করলেও তিনি সেটি স্বীকার করেন না। এক্স-রে করে নিশ্চিত হওয়ার পরও বাহক সেটি বের করে দিতে অস্বীকৃতি জানান। এমন পরিস্থিতিতে বাহকের স্বাস্থ্যঝুঁকি বেড়ে যায় কয়েক গুণ। তাঁকে চাপ প্রয়োগ করা হলে বড় বিপদ হওয়ার আশঙ্কা তৈরি হয়। যদি বাহক সেটি বের করে দিতে কালক্ষেপণ করেন, তখন পেটে সেটি গলে বিষক্রিয়ায় মারা যেতে পারেন। আবার কোনো বাহক পেট থেকে ইয়াবা বের করতে রাজি হলেও সেই প্রক্রিয়া খুবই জটিল। একটি বিশেষ ধরনের ওষুধ সেবন করিয়ে তাঁর পেট থেকে ইয়াবা বের করা হয়। এই ওষুধ সেবনে মৃত্যুঝুঁকিও রয়েছে।

যেভাবে পেটে রাখা হয় ইয়াবা

ডিএনসির একটি মামলার নথি থেকে জানা যায়, ৫ জানুয়ারি ঢাকার যাত্রাবাড়ী থেকে শহিদুল ইসলাম ও মিতু আক্তার নামের দুইজনের পেটে ইয়াবা আছে, এমন সন্দেহে আটক করেন ডিএনসির কর্মকর্তারা। বিষয়টি প্রথমে স্বীকার না করলেও একটি হাসপাতালে নিয়ে এক্স-রে করা হয়। তারপর বিষয়টি তাঁরা স্বীকার করেন এবং ইয়াবা বের করে দিতে রাজি হন। তাঁরা তরলজাতীয় একটি ওষুধ সেবন করেন। পরে পায়ুপথ দিয়ে ট্যাবলেটের মতো দেখতে ৭৫টি প্যাকেট বের করেন শহিদুল ইসলাম। মিতু বের করেন ৫৫ প্যাকেট। স্কচটেপ দিয়ে প্যাঁচানো এই প্যাকেটগুলো খোলার পর প্রতিটিতে ১০০ পিস ইয়াবা পাওয়া যায়।

ডিএনসির উত্তর অঞ্চলের সহকারী পরিচালক মেহেদী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, ৫০ থেকে ১০০ পিস ইয়াবা স্কচটেপ দিয়ে পেঁচিয়ে ‘ট্যাবলেটের’ মতো বানানো হয়। পেটে ইয়াবা যেন গলে না যায়, সে জন্য স্কচটেপ ব্যবহার করা হয়। কলা বা জুসজাতীয় পানীয় দিয়ে এসব ট্যাবলেট গিলে খান বাহক। একজন বাহক এমন ১০০টি ট্যাবলেট পর্যন্ত খেয়ে থাকেন। একটি নির্দিষ্ট সময় পর ইয়াবা গলে যেতে পারে। শহিদুল ও মিতু দুজনই বলেছেন, তাঁরা কলার সঙ্গে এসব ইয়াবা গিলে খেয়েছেন।

ডিএনসির একজন কর্মকর্তা জানান, শহিদুল ও মিতু জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, ৫ থেকে ১০ হাজার পিস ইয়াবা কক্সবাজার থেকে ঢাকায় পৌঁছে দিলে তাঁরা ১২ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা পেয়ে থাকেন। এ জন্য তাঁরা প্রতি মাসেই একাধিক চালান কক্সবাজার থেকে ঢাকায় পৌঁছে দেন। ইয়াবা পেটে ঢুকিয়ে সেটি বের করতে তাঁরা ৬ থেকে ১২ ঘণ্টা পর্যন্ত অপেক্ষা করেন। ইয়াবা গলে বিষক্রিয়ায় মৃত্যু হতে পারে, এমন ঝুঁকি জেনেও তাঁরা এই কৌশলে ইয়াবা নিয়ে আসছেন।