সগিরা মোর্শেদ হত্যা: ৩৫ বছর আগের ঘটনার রহস্য জানা যায় রিকশাচালকের তথ্যে

সগিরা মোর্শেদছবি: সংগৃহীত

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন শিক্ষার্থী সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলার রায় হলো আজ বুধবার। প্রায় ৩৫ বছর আগে তাঁকে হত্যা করা হয়েছিল।

মামলার নথিপত্রের তথ্য অনুযায়ী, ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই সগিরা মোর্শেদ সালাম ভিকারুননিসা নূন স্কুল থেকে মেয়েকে আনতে যাওয়ার পথে ছিনতাইকারীর কবলে পড়েন। একপর্যায়ে দৌড় দিলে তাঁকে গুলি করা হয়। পরে সগিরা মোর্শেদ মারা যান।

সেদিনই রমনা থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে মামলা করেন নিহত সগিরার স্বামী আবদুস সালাম চৌধুরী।

আরও পড়ুন

এই মামলায় ২০২০ সালের ১৬ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল, ছিনতাই নয়, মূলত পারিবারিক দ্বন্দ্ব থেকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়েছিল।

ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন একজন রিকশাচালক। তিনি দুজনের জড়িত থাকার কথা বললেও মিন্টু ওরফে মন্টু নামের একজনের বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। ১৯৯১ সালের ১৭ জানুয়ারি মন্টুর বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করা হয়। নেওয়া হয় সাতজনের সাক্ষ্য।

বাদীপক্ষের সাক্ষ্যে আসামি মন্টু ও তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদুল হাসানের নিকটাত্মীয় মারুফ রেজার নাম আসে। তখন রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালের ২৩ মে বিচারিক আদালত অধিকতর তদন্তের আদেশ দেন।

এই আদেশের বিরুদ্ধে মারুফ রেজা হাইকোর্টে আবেদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ১৯৯১ সালের ২ জুলাই হাইকোর্ট রুল দিয়ে অধিকতর তদন্তের আদেশ স্থগিত করেন। পরে স্থগিতাদেশের মেয়াদ বাড়ান। থমকে যায় মামলার কার্যক্রম।

বিষয়টি নজরে এলে ওই স্থগিতাদেশ প্রত্যাহারের উদ্যোগ নেয় রাষ্ট্রপক্ষ। শুনানি নিয়ে ২০১৯ সালের ২৬ জুন হাইকোর্ট মামলার অধিকতর তদন্তের আদেশে এর আগে দেওয়া স্থগিতাদেশ প্রত্যাহার করেন। একই সঙ্গে ৬০ দিনের মধ্যে ওই মামলার অধিকতর তদন্ত শেষ করতে পিবিআইকে নির্দেশ দেন।

তদন্ত শেষে পিবিআই চারজনের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ১৪ জানুয়ারি আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। একই বছরের ২ ডিসেম্বর আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের মাধ্যমে বিচার শুরুর আদেশ দেওয়া হয়।

‘আমি কিন্তু তোমাকে চিনি’

প্রত্যক্ষদর্শী ওই রিকশাচালকের তথ্যে ৩৫ বছর আগের এই চাঞ্চল্যকর খুনের মামলার প্রকৃত রহস্য উদ্‌ঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে পিবিআই।

রিকশাচালকের নাম ছালাম মোল্লা। ছালামের সামনে ১৯৮৯ সালের ২৫ জুলাই রমনা এলাকায় সগিরা মোর্শেদ খুন হন।

মামলার কাগজপত্র ও পিবিআইয়ের তথ্য বলছে, সগিরা মোর্শেদ ও তাঁর স্বামী আবদুস সালাম চৌধুরী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের শিক্ষার্থী ছিলেন। পারিবারিকভাবে তাঁদের বিয়ে হয় ১৯৭৯ সালের ২৫ অক্টোবর। তাঁদের তিন কন্যাসন্তান রয়েছে। তাঁরা রাজারবাগের একটা বাসায় বসবাস করতেন।

১৯৮৯ সালে এই দম্পতির মেয়ে সারাহাত সালমার বয়স ছিল ৮ বছর। ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী ছিল সে। মেয়েকে স্কুল থেকে আনার জন্য রাজারবাগের বাসা থেকে সেদিন বিকেল পাঁচটায় রওনা হন সগিরা। রাজারবাগ মোড় থেকে চার টাকায় রিকশাচালক ছালামকে ভাড়া করেন।

ছালাম মালিবাগ পেট্রলপাম্প থেকে শান্তিনগর মোড় দিয়ে ভিকারুননিসা স্কুলে যেতে চেয়েছিলেন। কিন্তু সগিরা অল্প সময়ে স্কুলে যাওয়ার জন্য মৌচাকের গলি দিয়ে যেতে পরামর্শ দেন। সগিরার কথা অনুযায়ী, ছালাম মৌচাকের গলি পার হয়ে ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজের দিকে যাচ্ছিলেন।

স্কুলের অদূরে রিকশার গতিরোধ করে একটি মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেলের দুজন লোক ছিলেন। একজন ছিলেন লম্বা, তাঁর মুখ লম্বাকৃতির। গোঁফ ছিল পাতলা। আরেকজন ছিলেন খাটো, স্বাস্থ্যবান।

দুজনের একজন তখন মোটরসাইকেল থেকে নেমে সগিরার কাছে থাকা ব্যাগ ছিনিয়ে নেন। আর বাঁ হাতের চুড়ি ধরে টানাটানি করতে থাকেন। তখন সগিরা মোর্শেদ ওই লোকের উদ্দেশে বলেছিলেন, ‘আমি কিন্তু তোমাকে চিনি।’

অভিযোগপত্র অনুযায়ী, তখন সগিরাকে উদ্দেশ্য করে গুলি ছোড়া হয়, যা তাঁর বুকের বাঁ পাশে লাগে।

আরও পড়ুন

গুলির শব্দ শোনার পর স্থানীয় লোকজন এগিয়ে আসেন। তখন ফাঁকা গুলি করে শান্তিনগরের দিকে পালিয়ে যান ওই দুই ব্যক্তি। সগিরা মোর্শেদ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান।

পিবিআইয়ের অভিযোগপত্রে বলা হয়েছিল, মূলত পারিবারিক দ্বন্দ্ব থেকে হত্যার পরিকল্পনা করেন আসামিরা। পরিকল্পনামাফিক তা বাস্তবায়নের জন্য ভাড়াটে সন্ত্রাসী নিয়োগ দেওয়া হয়।

সগিরা মোর্শেদের তিন মেয়েই এখন উচ্চশিক্ষিত। তাঁদের দুজন বিদেশে থাকেন।
এদিকে আজ সগিরা মোর্শেদ হত্যা মামলায় দুই আসামিকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। খালাস দেওয়া হয়েছে তিন আসামিকে।

ঢাকার বিশেষ জজ আদালত-৩-এর বিচারক মোহাম্মদ আলী হোসাইন এই রায় দেন।
যাবজ্জীবন কারাদণ্ড পাওয়া দুই আসামি হলেন আনাছ মাহমুদ রেজওয়ান ও মারুফ রেজা। খালাস পাওয়া তিন আসামি হলেন সগিরার ভাশুর চিকিৎসক হাসান আলী চৌধুরী, তাঁর স্ত্রী সায়েদাতুল মাহমুদা শাহিন ও মিন্টু ওরফে মন্টু মণ্ডল।

আনাছ ও মারুফকে আজ কারাগার থেকে আদালতে হাজির করা হয়। হাসান, মন্টু ও সায়েদাতুল জামিনে।