অর্থ পাচারে ৭০০ মানি এক্সচেঞ্জ

মুদ্রা কেনাবেচার আড়ালে বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগ। গুলশানের লাবনী মানি চেঞ্জারসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা।

অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ী তরিকুল ইসলামের বাড়ি। নড়াইলের কালিয়ার খাশিয়াল গ্রামে
প্রথম আলো

সারা দেশে অন্তত অবৈধ ৭০০ মানি এক্সচেঞ্জ হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার করছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ও বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এই তথ্য পাওয়া গেছে। শুধু ঢাকার উত্তরা, আশকোনা, দিলকুশা, মোহাম্মদপুর, মিরপুর ও গুলশান এলাকায় প্রশাসনের নাকের ডগায় চলছে অন্তত র্অধশতাধিক অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের ব্যবসা।

বিদেশে টাকা পাচারের অভিযোগে অন্তত তিনটি মানি এক্সচেঞ্জের মালিকের বিরুদ্ধে মামলাও করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। একটি মামলায় সুমন আল আজাদ নামের এক ব্যবসায়ীর ১৪ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। তিনি ১২ কোটি টাকা পাচারের সময় শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে গ্রেপ্তার হন।

অনুসন্ধানে জানা গেছে, মানি এক্সচেঞ্জের অবৈধ ব্যবসা করে বাড়ি, জমি ও মাছের খামারের মালিক হয়েছেন অনেকে। দুবাইতেও গড়েছেন ব্যবসা।

দোকান বন্ধ রেখে বিভিন্ন কৌশলে অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের মালিকেরা ডলার কেনাবেচা করছেন
মোহাম্মদ আলী, সিআইডির প্রধান

দেশে ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায় পর অবৈধ এসব মানি একচেঞ্জের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান শুরু করে আইনশৃঙখলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাংলাদেশ ব্যাংকও কয়েকটি অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ বন্ধে সরকারি বিভিন্ন সংস্থাকে নির্দেশনা দিয়েছে। এদিকে হুন্ডি বন্ধে ঢাকাসহ সারা দেশে অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ ব্যবসায়ীদের তালিকা তৈরি করছে সিআইডি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তৎপরতায় এরই মধ্যে কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দিয়েছেন মালিকেরা। তবে প্রতিষ্ঠান বন্ধ হলেও থেমে নেই তাঁদের ব্যবসা।

সিআইডির প্রধান ও অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক মোহাম্মদ আলী গতকাল প্রথম আলোকে বলেন, তিন শতাধিক অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের তথ্য সিআইডি সংগ্রহ করেছে। এসব প্রতিষ্ঠান বন্ধে অভিযান শুরু হয়েছে। তিনি বলেন, ‘দোকান বন্ধ রেখে বিভিন্ন কৌশলে অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জের মালিকেরা ডলার কেনাবেচা করছেন। সিআইডি এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেবে।’

সিআইডির কর্মকর্তারা বলেন, মানি এক্সচেঞ্জের দোকানে অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে অনেক ঝামেলা হয়। অভিযানে গিয়ে দোকান থেকে ৫০০ ডলার উদ্ধার হলে, মালিকেরা আদালতে গিয়ে ৫০০০ ডলার ছিল বলে দাবি করেন। এতে অভিযানে অংশ নেওয়া কর্মকর্তারা বিপদে পড়েন। তাই একজন পুলিশ সুপারের নেতৃত্বে অভিযান করার কথা ভাবছে সিআইডি।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র সিরাজুর ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, সারাদেশে সাত শ অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ রয়েছে। যারা অর্থ পাচারে জড়িত। দেশে বৈধ মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ২৩৫টি।

দোকান বন্ধ রেখেও ডলার কেনাবেচা

উত্তরার রাজলক্ষ্মী এলাকার এইচ এম প্লাজার নিচতলায় নাইটিঙ্গেল মানি এক্সচেঞ্জের দোকান। দোকানের ঝাঁপে ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে সাইনবোর্ড ‘ভাড়া হবে’। গত ২ সেপ্টেম্বর ওই দোকানে গিয়ে কথা হয় জাকির হোসেন নামের একজনের সঙ্গে, যিনি ওই দোকানের মালিক শিমুল শিকদারের বড় ভাই। জাকির হোসেন প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমাদের বৈধ কাগজপত্র নেই। এত দিন কাগজপত্র ছাড়াই চলছিল বিদেশি মুদ্রা কেনাবেচা।’ তাঁর দাবি, সিআইডি তাঁদের ব্যবসা বন্ধ করতে বলেছে। তাই দোকান ছেড়ে দিয়েছেন তিনি।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে মার্কেটের এক দোকানদার প্রথম আলোকে বলেন, আগে প্রকাশ্যে ডলার কেনাবেচা করা হতো ওই দোকানে। তবে এক মাস ধরে দোকানের সামনে ‘ভাড়া হবে’ সাইনবোর্ড টানিয়ে ভেতরে ডলার কেনাবেচা চলছে।

উত্তরার রাজলক্ষী ছাড়াও বিমানবন্দর এলাকার হজক্যাম্পের মুক্তিযোদ্ধা মার্কেট ও গুলশান এলাকার ১০টি মানি একচেঞ্জের দোকান ঘুরে দেখা গেছে, ৯টি এখন বন্ধ। এসব অবৈধ দোকান বছরের পর বছর ধরে ডলার কেনাবেচার আড়ালে হুন্ডির মাধ্যমে বিদেশে টাকা পাচার করে আসছিল। গত ৩ সেপ্টেম্বর সরেজমিন দেখা গেছে, দোকান বন্ধ রেখে বাইরে দাঁড়িয়ে, কেউ আবার মার্কেটের সিঁড়ির পাশে বসে বিদেশি মুদ্রার কেনাবেচা চালিয়ে যাচ্ছেন।

সরেজমিনে অনুসন্ধানে গিয়ে, রাজধানীর উত্তরা থানা এলাকায় পাওয়া গেছে অবৈধ মানি একচেঞ্জের আটটি দোকান। আর বিমানবন্দরের হজক্যাম্পের সামনে মুক্তিযোদ্ধা মার্কেটে রয়েছে ছয়টি দোকান। দোকানগুলো বন্ধ রেখে কর্মচারীরা মার্কেটের সিঁড়ি ও বিভিন্ন দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে বিদেশি মুদ্রা কেনাবেচা করছেন।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর গুলশান–২ মেট্রোপলিটন শপিং প্লাজার নিচতলায় খান অ্যান্ড চৌধুরী মানি এক্সচেঞ্জে গিয়ে দোকানটি বন্ধ পাওয়া যায়। পাশের দোকানের এক বিক্রয়কর্মী নাম প্রকাশ না করার শর্তে প্রথম আলোকে বলেন, কয়েক বছর ধরে দোকানটি চলছিল। এক মাস ধরে দোকানটি বন্ধ রয়েছে। এ ছাড়া মিরপুর ১০ নম্বর গোলচত্বর এলাকার শাহ আলী মার্কেট ও পর্বতা টাওয়ারে এমন অবৈধ মানি এক্সচেঞ্জ আছে অন্তত ১০টি।

জমি, বাড়ি ও মাছের খামার

১০ বছর আগেও অন্যের জমিতে শ্রমিকের কাজ করতেন নড়াইলের কালিয়া উপজেলার খাশিয়াল গ্রামের মিল্টন মোল্লা। কিন্তু ঢাকার এসে মানি এক্সচেঞ্জের অবৈধ ব্যবসা করে হয়েছেন জমি, বাড়ি ও মাছের খামারের মালিক।

স্থানীয় ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকায় গিয়ে শুরুতে একটি মানি এক্সচেঞ্জের দোকানের কর্মচারী ছিলেন মিল্টন মোল্লা। পরে রাজধানীর উত্তরায় আল মদিনা নামের অবৈধ একটি মানি এক্সচেঞ্জের দোকান খোলেন তিনি। এরপর হুন্ডির মাধ্যমে টাকা পাচার শুরু করেন বলে এলাকায় প্রচার আছে। বর্তমানে এলাকায় তাঁর ২৫ বিঘা জমিতে রয়েছে মাছের খামার। আরও রয়েছে দোতলা দুটি বাড়ি। এখন তিনি নড়াইলে মদের ব্যবসা নিয়ন্ত্রণ করেন। গত সংসদ নির্বাচনে তিনি লাঙ্গল প্রতীক নিয়ে নড়াইল-১ আসনে নির্বাচন করেন।

একই গ্রামের তরিকুল ইসলামও একসময় মুদিদোকান করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। আট বছর আগে ঢাকায় গিয়ে মানি এক্সচেঞ্জের ব্যবসায় শুরু করেন। বর্তমানে বনানী এলাকায় তাঁর একাধিক অবৈধ মানি একচেঞ্জের দোকান রয়েছে। বর্তমানে গ্রামের ওই মুদিদোকানের পেছনে দোতলা বাড়ি করেছেন। চড়েন বিলাসবহুল গাড়িতে।

আর অবৈধভাবে ডলার কেনাবেচা করা কৃষকের ছেলে রাজত সরদার এখন দুবাইয়ের বাসিন্দা। ঢাকার উত্তরা এলাকার আর আর মানি একচেঞ্জের মালিক তিনি। একসময় আট হাজার টাকা বেতনে মানি একচেঞ্জের দোকানে চাকরি করা রাজত এখন ব্যবসা খুলেছেন দুবাইয়ে।