এক বছরেও বিচার শুরু হয়নি

কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চাঁদপুরে দায়ের করা ৫৪টি মামলায় ৩৬টির অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। ৩৩ শতাংশ মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি।

পবিত্র কোরআন অবমাননাকে কেন্দ্র করে এক বছর আগে দেশের বিভিন্ন স্থানে পূজামণ্ডপ, মন্দির, হিন্দুধর্মাবলম্বীদের বাড়িঘর ও ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে হামলার ক্ষত এখনো শুকায়নি। এসব হামলার ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিচারকাজ এখনো শুরুই হয়নি। এ নিয়ে ক্ষোভ আছে হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মনে। এর মধ্যেই কাল শনিবার থেকে শুরু হচ্ছে সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা।

গত বছরের ১৩ অক্টোবর কুমিল্লায় পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন অবমাননাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে দুষ্কৃতকারীদের দ্রুত খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেওয়ার আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল। বাস্তবে তা সম্ভব হয়নি।

প্রশাসনের নানামুখী পদক্ষেপে শান্তিপূর্ণভাবে পূজা উদ্‌যাপনের ব্যাপারে আশাবাদী।
মধুসূদন ভৌমিক, সভাপতি, রাধা মাধব জিউ মন্দির, নোয়াখালী

এমনকি ঘটনার এক বছর পার হতে চললেও এখনো বিচার প্রক্রিয়া শুরু হয়নি। কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চাঁদপুরের হামলার ঘটনায় সব মিলিয়ে ৫৪টি মামলা হয়। এর মধ্যে নোয়াখালীর ৩২টি মামলায় ২৪টিতে, কুমিল্লায় ১২টির মধ্যে ৬টি ও চাঁদপুরে ১০টি মামলার মধ্যে ৬টিসহ মোট ৩৬টি মামলায় অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেওয়া হয়েছে। বাকি ১৮টি মামলা এখনো তদন্ত পর্যায়ে রয়ে গেছে। অর্থাৎ ঘটনার এক বছরেও ৩৩ শতাংশ মামলার তদন্তকাজ এখনো শেষ হয়নি।

আরও পড়ুন

জানতে চাইলে কুমিল্লার সংস্কৃতিকর্মী চন্দন দাস প্রথম আলোকে বলেন, ‘বিচারহীনতার সংস্কৃতির কারণে এত দিনেও জানা গেল না কারা, কেন, কী উদ্দেশ্যে পূজামণ্ডপে কোরআন অবমাননা করল? এক বছরেও বিচারকার্য শুরু না হওয়া দুঃখজনক।’

শান্তিপূর্ণ পূজা উদ্‌যাপনের প্রস্তুতি

এ বছর সারা দেশে ৩২ হাজার ১৬৮টি মণ্ডপে পূজা উদ্‌যাপন হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পূজা উদ্‌যাপন পরিষদ। এবার পূজার আগে, পরে ও পূজার দিন তিন স্তরের নিরাপত্তাব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ। সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, দেশের সব পূজামণ্ডপে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন এবং প্রবেশপথে মেটাল ডিটেক্টর ও আর্চওয়ে গেট স্থাপন করবে পুলিশ।

কোতোয়ালি মডেল থানার দুটি মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে। অভিযোগপত্র প্রস্তুত। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রশাসনিক অনুমোদন আসার পর আদালতে অভিযোগপত্র উপস্থাপন করা হবে।
মো. আবদুল মান্নান, কুমিল্লার জেলা পুলিশ সুপার

এদিকে শান্তিপূর্ণভাবে পূজা উদ্‌যাপনের লক্ষ্যে দেশের বিভিন্ন স্থানে প্রশাসনের উদ্যোগে সামাজিক সম্প্রীতি সমাবেশের আয়োজন করা হয়েছে। এসব সমাবেশে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান ও বৌদ্ধধর্মাবলম্বী নারী-পুরুষসহ বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের কর্মকর্তা, এনজিও প্রতিনিধি, ব্যবসায়ী, শিক্ষক ও গণমাধ্যমকর্মীরা উপস্থিত থাকছেন।

আরও পড়ুন

কুমিল্লা নগরের নানুয়াদিঘির উত্তরপাড়ে এবারও দর্পণ সংঘের উদ্যোগে শারদীয় দুর্গাপূজা হবে। এ উপলক্ষে পূজামণ্ডপ তৈরির কাজ প্রায় শেষ পর্যায়ে। সেখানে বাঁশ টানানো হয়েছে। এখন কাপড় লাগানো ও রংতুলির কাজ চলছে। পূজামণ্ডপের সভাপতি ও কুমিল্লা মহানগর পূজা উদ্‌যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক অচিন্ত্যদাস টিটু প্রথম আলোকে বলেন, ‘এবার কড়া নিরাপত্তায় পূজা হবে। আমরা শক্তিশালী সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করেছি। ২৪ ঘণ্টা পাহারা থাকবে। স্বেচ্ছাসেবক, আনসার ও পুলিশ পালা করে থাকবে।’

মণ্ডপে কড়া পাহারা
ফাইল ছবি

কুমিল্লা নগরের কান্দিরপাড় নজরুল অ্যাভিনিউ কাত্যায়নী কালীবাড়ি মন্দিরেও শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে। বরুড়া উপজেলার মহেশপুর রাধারানী মন্দিরেও চলছে প্রতিমায় রংতুলির আঁচড়ের কাজ।

ভয় ছাপিয়ে উৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছেন নোয়াখালীর হিন্দুধর্মাবলম্বীরা। মণ্ডপে মণ্ডপে চলছে দুর্গোৎসবের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। গতকাল বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় জেলার প্রধান দুর্গাপূজা উৎসবের এলাকা হিসেবে পরিচিত চৌমুহনীর একাধিক মন্দির ঘুরে দেখা যায়, কারিগরদের দম ফেলার সময় নেই। শেষ মুহূর্তের সাজসজ্জায় ব্যস্ত সবাই।

চৌমুহনী ব্যাংক রোডের রাধা মাধব জিওর মন্দির কমপ্লেক্সে দেখা যায়, মৃৎশিল্পী গৌতম পাল প্রতিমার মাথায় চুল পরিয়ে দিচ্ছেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, এই কমপ্লেক্সে জেলার বিভিন্ন উপজেলার ২৫টি পূজামণ্ডপের জন্য প্রতিমা তৈরি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে কয়েকটি প্রতিমা মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। বাকিগুলো আজ শুক্রবারের মধ্যে মন্দিরে মন্দিরে চলে যাবে।

ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগরে ২০১৬ সালের ৩০ অক্টোবর মন্দির ও হিন্দু সম্প্রদায়ের বাড়িঘরে হামলা, ভাঙচুর, লুটপাট-অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে
প্রথম আলো ফাইল ছবি

রাধা মাধব জিওর মন্দিরের সভাপতি মধুসূদন ভৌমিক প্রথম আলোকে বলেন, গত বছর পূজামণ্ডপে তাণ্ডবের পর মনের ভেতর যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, সেটি সহজে যাবে না। তবে প্রশাসনের নানামুখী পদক্ষেপে তাঁরা শান্তিপূর্ণভাবে পূজা উদ্‌যাপনে আশ্বস্ত হয়েছেন। সে কারণে প্রস্তুতিতে কোনো ধরনের কমতি নেই। একই কথা বললেন জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি বিনয় কিশোর রায়। প্রশাসন স্থানে স্থানে সম্প্রতি সমাবেশ করায় তাঁরা আশ্বস্ত হয়েছেন।

কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে গত বছর চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ বাজারে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। তখন হাজীগঞ্জ পৌর এলাকাসহ উপজেলার আশপাশে কয়েকটি মন্দির ও মণ্ডপে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। হাজীগঞ্জ বাজারে পুলিশের সঙ্গে মিছিলকারীদের সংঘর্ষ বাধলে পুলিশ গুলি চালায়। এ সময় ঘটনাস্থলে তিনজন, পরে হাসপাতালে দুজনের মৃত্যু হয়। সেই হাজীগঞ্জে এবার ২৯টি মণ্ডপে দুর্গাপূজার প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এ জন্য প্রশাসন সম্প্রীতি সমাবেশসহ মণ্ডপে মণ্ডপে নিরাপত্তাব্যবস্থা জোরদার করেছে বলে জানা গেছে।

তিন জেলার মামলা পরিস্থিতি

মন্দির–মণ্ডপে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় কুমিল্লার চার থানায় গত বছর ১২টি মামলা হয়। এর মধ্যে ছয়টি মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়েছে। চারটি মামলার তদন্ত শেষ, দুটি মামলার তদন্ত চলছে। ছয় মামলায় ২৪১ জনের নামে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এ অবস্থায় হিন্দুধর্মাবলম্বীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ রয়েছে। তাঁরা দ্রুত বিচার শুরু করার দাবি জানিয়েছেন।

থানা–পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১৩ অক্টোবর সকালে কুমিল্লা নগরের নানুয়াদিঘির উত্তরপাড়ে শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে দর্পণ সংঘের উদ্যোগে আয়োজিত পূজামণ্ডপ থেকে পবিত্র কোরআন শরিফ উদ্ধার করা হয়। এরপর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই দিনই নগরের চারটি মন্দির, সাতটি পূজামণ্ডপ ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এতে আহত হন অন্তত ৩০ জন।

আহত ব্যক্তিদের মধ্যে একজন হাসপাতালে চিকিত্সাধীন অবস্থায় মারা যান। এ ছাড়া জেলার সদর দক্ষিণ, দেবীদ্বার ও দাউদকান্দিতে প্রতিমা ভাঙচুর ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটে। এসব ঘটনায় পরে ১২টি মামলা দায়ের করা হয়।

এ ১২ মামলার ছয়টির তদন্ত করছে সিআইডি। এর মধ্যে পাঁচটির অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। পিবিআইয়ের কাছে থাকা চারটির মধ্যে একটি মামলার অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। আর পুলিশের কাছে থাকা দুটি মামলার এখনো কোনো অভিযোগপত্র দেওয়া হয়নি।

জানতে চাইলে কুমিল্লার জেলা পুলিশ সুপার মো. আবদুল মান্নান প্রথম আলোকে বলেন, কোতোয়ালি মডেল থানার দুটি মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে। অভিযোগপত্র প্রস্তুত। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রশাসনিক অনুমোদন আসার পর আদালতে অভিযোগপত্র উপস্থাপন করা হবে।

গত বছরের ১৪ ও ১৫ অক্টোবর নোয়াখালীর পূজামণ্ডপে হামলা-ভাঙচুর, লুটপাট ও দুই মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের হওয়া ৩২টি মামলার মধ্যে ২৪টির অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেওয়া হয়েছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ—সিআইডির কাছে থাকা সাতটি মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এ ছাড়া জেলা পুলিশের কাছে থাকা ১০টি মামলার মধ্যে একটি মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি বলে জানা গেছে।

চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে ১০টি মামলার ৬টিতে অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়েছে। চাঁদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদীপ্ত রায় প্রথম আলোকে বলেন, এসব মামলার মধ্যে পুলিশ দুটি, ডিবি পুলিশ দুটি, সিআইডি একটি ও পিবিআই একটি মামলার অভিযোগপত্র ইতিমধ্যে জমা দিয়েছে। তবে এখনো চারটি তদন্তাধীন আছে। শিগগির এগুলোর অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হবে।

হতাশা ছাপিয়ে আশার কথা শোনালেন নোয়াখালী হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি বিনয় কিশোর রায়। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি প্রথম আলোকে বলেন, প্রতিটি পূজামণ্ডপে পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। নিরাপত্তা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা নেই। এবারের পূজা উৎসবে পরিণত হোক। সেই প্রস্তুতিই নিয়েছেন তাঁরা।

[প্রতিবেদন তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন গাজীউল হক, কুমিল্লা; মাহবুবুর রহমান, নোয়াখালীআলম পলাশ, চাঁদপুর]