জঙ্গিবাদে জড়িয়ে ‘হিজরত’, ঘর ছেড়েছেন সাত তরুণ

হোলি আর্টিজানে হামলার আগে অনেকে ঘর ছেড়েছিলেন নব্য জেএমবিতে জড়িয়ে। সাম্প্রতিক ঘরছাড়া তরুণেরা আনসার আল ইসলামের সদস্য।

উগ্রবাদে জড়িয়ে কথিত হিজরতের নামে আবারও ঘর ছাড়ছেন কিছু তরুণ। এরই মধ্যে কুমিল্লা থেকে একযোগে সাত তরুণের বাড়ি ছাড়ার খবর পাওয়া গেছে। এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এইচএসসি থেকে স্নাতকপড়ুয়া এসব তরুণ নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন আনসার আল ইসলামের দ্বারা উদ্বুদ্ধ হয়ে ‘হিজরত’ (দেশত্যাগ বা এক স্থান থেকে অন্য স্থানে চলে যাওয়া) করেছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কাছে তথ্য রয়েছে। কুমিল্লার তরুণদের আগে সিলেট অঞ্চল থেকেও কিছু তরুণ একই জঙ্গিগোষ্ঠীর সঙ্গে জড়িয়ে বাড়ি ছেড়েছেন বলে সংশ্লিষ্ট একটি সূত্র থেকে জানা গেছে।

পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকার সাত তরুণ গত ২৩ আগস্ট একযোগে নিখোঁজ হন। তাঁদের বয়স ১৮ থেকে ২৩ বছর। নিখোঁজ তরুণেরা হলেন মো. ইমতিয়াজ আহম্মেদ ওরফে রিফাত, নিহাল আবদুল্লাহ, মো. আমিনুল ইসলাম ওরফে আল আমিন, সরতাজ ইসলাম ওরফে নিলয়, ইমরান বিন রহমান ওরফে শিথিল, মো. হাসিবুল ইসলাম ও আস সামী। শেষ তিনজন উচ্চমাধ্যমিক (এইচএসসি) পরীক্ষার্থী। প্রথম ছয়জনের অভিভাবক কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানায় পৃথক সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছেন।

তাঁদের মধ্যে ইমতিয়াজ আহম্মেদ কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী। তাঁর গ্রামের বাড়ি কুমিল্লার মুরাদনগরে। কুমিল্লা শহরে তাঁদের বাসা। তাঁর বাবা মো. ফয়েজ আহম্মেদ গত ২৬ আগস্ট থানায় জিডি করেন। ফয়েজ আহম্মেদ গত সোমবার প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ছেলেসহ আটজন একই দিন একই সময়ে নিখোঁজ হয়। এ ব্যাপারে কথা বলতে প্রশাসন থেকে নিষেধ আছে।’

ফয়েজ আহম্মদ আটজন নিখোঁজ হওয়ার কথা বললেও অষ্টমজনের নাম জানা যায়নি। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও এ বিষয়ে কিছু বলতে পারেনি।

নিখোঁজ নিহাল আবদুল্লাহ কুমিল্লা সরকারি কলেজের দ্বাদশ শ্রেণির ছাত্র। কুমিল্লা শহরের অশোকতলায় তাঁর বাসা। তাঁর মা ফৌজিয়া ইয়াসমিন ২৫ আগস্ট থানায় জিডি করেন।

আমিনুল ইসলাম ওরফে আল আমিন কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ইসলাম শিক্ষা চতুর্থ বর্ষের শিক্ষার্থী। তাঁর বাড়ি কুমিল্লার আদর্শ সদর উপজেলার বড় আলমপুর গ্রামে। তাঁরা কুমিল্লা শহরের ঝাউতলা এলাকার বাসায় থাকতেন। আমিনুলের বাবা মো. নুরুল ইসলাম ১ সেপ্টেম্বর থানায় জিডি করেন। মো. নুরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমিনুল আমার বড় ছেলে। সে আগে তাবলিগের নেতাদের সঙ্গে চিল্লায় যেত। পড়াশোনার পাশাপাশি কান্দিরপাড়ে আমার ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানে বসতো। ছেলে খুঁজে না পেয়ে হতাশ আমি।’

সরতাজ ইসলাম ড্যাফোডিল বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ করেছেন। ইমরান বিন রহমান ওরফে শিথিল কুমিল্লা ভিক্টোরিয়া সরকারি কলেজের ছাত্র। বাসা কুমিল্লা শহরে। তাঁর বাবা মোহাম্মদ মজিবুর রহমান ২৪ আগস্ট থানায় জিডি করেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘শিথিল আমার একমাত্র ছেলে। সে কোচিংয়ে যাওয়ার কথা বলে ২৩ আগস্ট বিকেল চারটায় বের হয়। এরপর বলেছিল রেসকোর্স নুর মসজিদে তাবলিগের বয়ান শুনবে। এরপর আর বাসায় ফেরেনি।’

কুমিল্লার কোতোয়ালি মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুহাম্মদ সহিদুর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, নিখোঁজ তরুণদের বিষয়ে পুলিশ অনুসন্ধান করছে। পুলিশ জানতে পেরেছে বাড়ি ছাড়ার পর ওই তরুণেরা কুমিল্লা থেকে চাঁদপুরে যায়। এরপর চাঁদপুর রেলস্টেশন এলাকার একটি হোটেলে রাতে ছিল। পরদিন সকাল সাড়ে ছয়টায় তাঁরা ওই হোটেল থেকে চলে যান। এরপর থেকে তাঁদের আর হদিস মেলেনি।

জেলা পুলিশের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা জানান, পরিবারগুলোর সঙ্গে কথা বলে এটা পরিষ্কার যে এসব তরুণ জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়েই বাড়ি ছেড়েছেন। বিষয়টি তাঁরা গুরুত্ব দিয়ে দেখছেন।

হোলি আর্টিজান বেকারিতে ভয়াবহ জঙ্গি হামলার ছয় বছর পর আবারও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে তরুণদের ঘর ছাড়ার প্রবণতাকে উদ্বেগজনক মনে করছেন জঙ্গিবাদবিষয়ক বিশ্লেষক ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। কারণ, হোলি আর্টিজান হামলায় জড়িত জঙ্গিরাও জঙ্গিবাদে উদ্বুদ্ধ হয়ে এভাবে বাড়ি ছেড়ে নিরুদ্দেশ হয়েছিলেন।

তবে হোলি আর্টিজানের হামলার আগে যাঁরা বাড়ি ছেড়েছিলেন, তাঁরা ছিলেন মূলত নব্য জেএমবির সদস্য। যাঁরা নিজেদের আইএস (ইসলামিক স্টেট) দাবি করতেন। আর এবার নিখোঁজ তরুণেরা আনসার আল ইসলামের সদস্য, যাঁরা নিজেদের একিউআইএসের (আল–কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশীয় শাখা) বাংলাদেশ শাখা দাবি করে।

২০১৪–১৬ সালে যেসব তরুণ বাড়ি ছেড়েছিলেন, তাঁরা মূলত সিরিয়ায় আইএসের পক্ষে লড়াই করার লক্ষ্যে বের হয়েছিলেন। তাঁদের একটি অংশ সিরিয়ায় গেলেও বাকিদের দেশের ভেতরেই বিভিন্ন জঙ্গি আস্তানায় রেখে প্রশিক্ষণ দেয় নব্য জেএমবি। তখন এসব তরুণের সামনে ‘হিজরতের’ নতুন ব্যাখ্যা দাঁড় করান জঙ্গি নেতারা। বলা হয়, দেশের ভেতরেও এক এলাকা থেকে আরেক এলাকায় গেলে সেটা ‘হিজরত’ হিসেবে গণ্য হবে।

সম্প্রতি নিখোঁজ হওয়া তরুণেরাও আফগানিস্তানে যাওয়ার লক্ষ্য নিয়ে বাড়ি ছাড়েন বলে পরিবারের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে। জঙ্গি দমনে কাজ করেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এমন একাধিক কর্মকর্তা বলেন, নতুন করে নিখোঁজ এই তরুণদেরও দেশের ভেতরে কোনো না কোনো আস্তানায় রেখে প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে বলে মনে করছেন।

বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড সিকিউরিটি স্টাডিজের সভাপতি মেজর জেনারেল (অব.) আ ন ম মুনীরুজ্জামান মনে করেন, আফগানিস্তানে তালেবানরা ক্ষমতায় আসার পর এ দেশের উগ্র মতাদর্শী তরুণদের মধ্যে একধরনের মানসিক অস্থিরতা তৈরি হয়।

আল–কায়েদার শীর্ষ নেতা আয়মান আল-জাওয়াহিরি মারা যাওয়ার পর আল–কায়েদা নতুন করে সংগঠিত হওয়ার যে চেষ্টা করছে, তাতে উগ্রবাদী এই তরুণেরা উদ্বুদ্ধ হয়েছেন বলে মনে হয়। এই অস্থিরতার কারণে তরুণদের মধ্যে নতুন করে হিজরতের প্রবণতা তৈরি হয়ে থাকতে পারে।

এ কারণে নতুন ধরনের হুমকির আশঙ্কা তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, ‘আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মধ্যে একটা আত্মতুষ্টি লক্ষ করা গেছে যে জঙ্গিবাদ নিয়ন্ত্রণে চলে এসেছে। এ কারণে কাজে শিথিলতা আসে, যা বিপদের কারণ হতে পারে।’