প্রতীকী ছবি

‘জিনের বাদশাহ’ পরিচয়ে পাবনার এক গৃহবধূকে জানানো হয়, তাঁর প্রবাসী স্বামীর সামনে বড় বিপদ, তাঁর মৃত্যুও হতে পারে। আর এ অবস্থা থেকে কেবল তাঁর স্বামীকে বাঁচাতে পারবে ‘পরিস্থানের’ লোকেরা। এ জন্য ৪৫ হাজার টাকা পাঠাতে হবে। স্বামীর মৃত্যুর ভয়ে ওই গৃহবধূ প্রতারক চক্রের দেওয়া মুঠোফোন নম্বরে ৩০ হাজার টাকা পাঠান।

প্রথম দফায় সফল হওয়ার পর তিন দিন পর ওই গৃহবধূকে প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে প্রতারক চক্র। চক্রের সদস্যরা তাঁকে কাপড়ে মোড়ানো সোনালি রঙের একটি পুতুল দিয়ে বলেন, এটি পরিস্থানের স্বর্ণ দিয়ে তৈরি। এই পুতুল নতুন পাতিলে রেখে মাটির নিচে লুকিয়ে রাখার ১৫ দিন পর পাতিলভর্তি স্বর্ণ পাওয়া যাবে। এভাবে কৌশলে এবার ওই গৃহবধূর কাছ থেকে আরও মোটা অঙ্কের টাকা ও সোনার গয়না হাতিয়ে নেন তাঁরা। গৃহবধূকে যে পুতুলটি দেওয়া হয়েছিল, সেটিও ছিল লোহার।

এভাবে পাবনার ওই গৃহবধূকে ফাঁদে ফেলে প্রায় সাড়ে ৫ লাখ টাকা এবং ১ লাখ ২০ হাজার টাকার স্বর্ণালংকার হাতিয়ে নিয়েছেন প্রতারক চক্রের সদস্যরা। পরে পাবনার আদালতে ওই নারীর করা একটি নালিশি মামলার তদন্তে এসব তথ্য উঠে এসেছে।

পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই) সূত্র জানায়, ওই গৃহবধূ প্রতারক চক্রের ফাঁদে পড়েন ২০২১ সালের আগস্টের শেষের দিকে। তিনি নালিশি মামলা করেন ২০২২ সালের মার্চে। ওই গৃহবধূর স্বামী ১০ বছর ধরে বিদেশে থাকেন। তাঁর ব্যাংক হিসাবে নিয়মিত টাকা পাঠান প্রবাসী স্বামী। তিনি (গৃহবধূ) গ্রামের বাড়িতে একা থাকেন।

গৃহবধূর কাছ থেকে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার হাতিয়ে নেওয়ার তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ঘটনায় তিনজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তবে তাঁরা পলাতক।
সোহাগ আলী, পাবনা জেলা পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক

পিবিআই এ মামলার তদন্ত শেষে গত ফেব্রুয়ারিতে আদালতে প্রতিবেদন দাখিল করেছে। তারা প্রতারণায় জড়িত চক্রটির তিন সদস্যকে শনাক্ত করেছে। তাঁরা হলেন ওয়াসিম মণ্ডল (৩০), সানোয়ার হোসেন (৩৯) ও সৈয়দ লুৎফর রহমান (৩৮)। তাঁদের মধ্যে ওয়াসিম মণ্ডল ও সানোয়ার হোসেনের বাড়ি গাইবান্ধার গোবিন্দগঞ্জে। আর লুৎফর রহমানের বাড়ি টাঙ্গাইলের গোপালপুরে।

পিবিআই জানায়, ফাঁদে ফেলার আগে প্রতারক চক্রের সদস্যরা ওই গৃহবধূর সঙ্গে ইন্টারনেটভিত্তিক যোগাযোগের অ্যাপ ইমোতে যোগাযোগ করতেন। চক্রের সদস্যরা তখন জানতে পারেন, গৃহবধূ পীর-ফকির বিশ্বাস করেন। তাই জিন ও পরির গল্প বলে তাঁকে ফাঁদে ফেলা সম্ভব হবে বলে তাঁরা বুঝতে পারেন।

মামলাটি তদন্ত করেছেন পাবনা জেলা পিবিআইয়ের উপপরিদর্শক (এসআই) সোহাগ আলী। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, গৃহবধূর কাছ থেকে নগদ টাকা ও স্বর্ণালংকার হাতিয়ে নেওয়ার তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে। মুঠোফোনে আর্থিক লেনদেনের নম্বরের সূত্র ধরে তদন্ত করে তিনজনকে শনাক্ত করা হয়েছে। তবে তাঁরা পলাতক। এ চক্রের আরও কয়েকজন সহযোগী সদস্য রয়েছেন। তাঁদের শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি।

অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার অভিনব কৌশল

ভুক্তভোগী গৃহবধূর ভাষ্য, মুঠোফোনে আর্থিক লেনদেনের একটি মাধ্যমে টাকা নেওয়ার পর প্রতারক চক্রের সদস্যরা বলেছিলেন, বিষয়টি যেন কাউকে না জানানো হয়। এ কথা কাউকে জানালে তাঁর (গৃহবধূ) স্বামী মারা যাবেন বলে ভয় দেখানো হয়। কথিত পরিস্থান থেকে জিনের বাদশাহ মানুষের রূপ ধারণ করে তাঁর (গৃহবধূ) সঙ্গে একটি বাজারের পাশে দেখা করবেন বলে জানান। তখন জিনের বাদশাহ তাঁকে একটি স্বর্ণের পুতুল দেবেন বলা হয়। এ জন্য গৃহবধূকে তাঁর স্বর্ণের চেইন ও হাতের বালা নিয়ে যেতে বলা হয়।

প্রতারণার শিকার গৃহবধূ প্রথম আলোকে বলেন, প্রতারকেরা তাঁকে এমন করে মগজধোলাই করেন যে তাঁরা যা বলছিলেন, সবই সত্যি মনে হচ্ছিল। স্বর্ণের পুতুল পাওয়ার আশায় তিনি স্বর্ণের চেইন ও বালা নিয়ে এক ব্যক্তির সঙ্গে দেখা করেন। তখন তাঁকে (গৃহবধূ) লাল কাপড়ে মোড়ানো একটি ভারী পুতুল দেখিয়ে বলা হয়, এটি পরিস্থানের স্বর্ণের পুতুল। এই পুতুল পাতিলে ভরে ১৫ দিন মাটির নিচে রেখে দিলে পুরো পাতিল স্বর্ণে ভরে যাবে। এই পুতুল তাঁকে দেওয়া হবে—এমন আশ্বাস দিয়ে স্বর্ণের চেইন ও বালা নিয়ে যান ওই ব্যক্তি।

ভুক্তভোগী নারী আরও বলেন, এ ঘটনার পর গভীর রাতে তাঁকে মুঠোফোনে জানানো হয়, ‘পরিস্থান’ থেকে পরিরা তাঁর জন্য স্বর্ণের পুতুল নিয়ে এসেছে। ৫ লাখ ১০ হাজার টাকা নিয়ে তাঁকে আবারও দেখা করতে বলা হয়। এবার তিনি ব্যাংক থেকে ৫ লাখ ১০ হাজার টাকা নিয়ে দেখা করেন। তখন ওই ব্যক্তি গৃহবধূকে বলেন, টাকাগুলো কচুগাছের নিচে রেখে পুতুলটি যেন তিনি গ্রহণ করেন। ওই গৃহবধূ ৫ লাখ ১০ হাজার টাকা কচুগাছের নিচে রেখে সেই পুতুল নিয়ে বাসায় চলে আসেন। কথিত জিনের বাদশাহর কথামতো ওই গৃহবধূ পুতুলটি নতুন পাতিলে ভরে ১৫ দিন মাটির নিচে রেখে দেন। তবে ১৫ দিন পর পাতিল খুলে তিনি দেখেন, সেখানে কোনো স্বর্ণ নেই। পরে দেখেন তাঁকে যে পুতুল দেওয়া হয়েছে, সেটিও লোহার তৈরি।

পিবিআইয়ের এসআই সোহাগ আলী বলেছেন, ওই নারী প্রতারকদের দুই দফায় সাড়ে ৫ লাখ টাকা দিয়েছেন, তা তদন্তে নিশ্চিত হওয়া গেছে।