অপরাধ ছেড়ে নতুন জীবনে তাঁরা

পাঁচ বছরে লঘু অপরাধে মামলার আসামি হওয়া ২১৭ জন আদালতের নির্দেশে প্রবেশন পেয়েছেন। এর মধ্যে ৪৬ জন শর্ত পূরণ করে প্রবেশন থেকে মুক্ত হন।

প্রবেশনের শর্ত মেনে চলায় সমাজসেবা অধিদপ্তর থেকে চট্টগ্রামের নুর কালাম ভ্যান পেয়েছেন
প্রথম আলো

চট্টগ্রাম নগরের বাকলিয়া এলাকার বাসিন্দা ইসমাইল হোসেন ১০ বছর আগে ৫০০ গ্রাম গাঁজাসহ গ্রেপ্তার হন। মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনের মামলায় তাঁকে কারাগারে পাঠানো হয়। ২২ দিন পর তিনি জামিনে মুক্তি পান। এরপর চলতে থাকে মামলার কার্যক্রম। একদিকে আদালতে মামলার হাজিরা, অন্যদিকে স্ত্রীসহ তিন সন্তানের সংসারের খরচ জোগানো।

পেশায় দিনমজুর ইসমাইলের (৩৮) হিমশিম অবস্থা তখন। গত বছরের ২ জানুয়ারি আইনজীবীর মাধ্যমে তিনি চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রবেশনের আবেদন করেন। এরপর ৯ মার্চ আদালত তাঁকে এক বছরের প্রবেশনে পরিবারের সঙ্গে থেকে সাজাভোগের সুযোগ দেন। শর্ত পূরণ করায় চলতি বছরের ৯ মার্চ প্রবেশন থেকে তিনি মুক্তি পান।

সাক্ষী না আসা, তদন্ত প্রতিবেদন আসতে দেরি হওয়া, আসামি পলাতক থাকা, আদালতের কাছে আসামিদের বারবার সময় নেওয়ায় নিষ্পত্তিতে সময় লেগে যায়। তার ওপর মামলাজট তো আছেই।
সরকারি কৌঁসুলি মো. আবদুর রশিদ

চট্টগ্রাম আদালত সূত্রে জানা গেছে, ২০১৮ সাল থেকে চলতি বছরের এপ্রিল পর্যন্ত গত পাঁচ বছরে মাদক বহন ও বিক্রি, মারামারিসহ লঘু অপরাধে আসামি হওয়া ২১৭ জন প্রবেশন পেয়েছেন। এর মধ্যে ১৭১ জন এখনো প্রবেশনে রয়েছেন। বাকি ৪৬ জন আদালতের শর্ত পূরণ করায় দণ্ড থেকে পুরোপুরি মুক্ত হয়ে ফিরেছেন নতুন জীবনে।

প্রবেশনে থেকে পুরোপুরি মুক্ত হওয়া ইসমাইল হোসেনের জন্য ছিল পাঁচ শর্ত: নতুন করে অপরাধে না জড়ানো, সামাজিক মূল্যবোধবিরোধী কাজ না করা, প্রতিবেশীদের সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখা, ভালো আচরণ করা এবং মাদকবিরোধী প্রচারণায় অংশ নেওয়া।

ইসমাইল এখনো দিনমজুরি করেই সংসার চালাচ্ছেন। তাঁর স্ত্রী রিমা আক্তার জানান, প্রবেশনে নিজেকে সংশোধন করেছেন তাঁর স্বামী।

বাকলিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) আবদুর রহিম প্রথম আলোকে বলেন, ইসমাইল নতুন করে কোনো অপরাধে জড়াননি।

প্রবেশন পাওয়া ব্যক্তি ও শিশু-কিশোরেরা আদালতের শর্ত পূরণ করছে কি না, তা তদারক করেন সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রবেশন কর্মকর্তা। প্রবেশন কর্মকর্তারা স্থানীয়ভাবে খোঁজ নেন এবং আদালতকে অবহিত করেন।

চট্টগ্রাম সমাজসেবা অধিদপ্তরের প্রবেশন কর্মকর্তা পারুমা বেগম নিজ কার্যালয়ে প্রথম আলোকে বলেন, আদালতের নির্দেশনা অনুযায়ী যাঁরা প্রবেশন পেয়েছেন, তাঁদের কার্যক্রম নিয়মিত তদারক করা হচ্ছে। সবাই শর্ত পূরণ করে চলেছেন। তাই কারও প্রবেশন বাতিল হয়নি। আর যাঁরা মুক্ত হয়েছেন, তাঁদের কেউ নতুন করে অপরাধে জড়াননি। সবার ওপরই নজর রাখা হচ্ছে। দণ্ডমুক্ত ৪৬ জনের মধ্যে অন্তত ১০ জনকে পুনর্বাসন করা হয়েছে।

কোনো অপরাধীকে প্রাপ্য শাস্তি না দিয়ে (স্থগিত রেখে), কারাবন্দী না রেখে বা কোনো প্রতিষ্ঠানে আবদ্ধ না করে সমাজে খাপ খাইয়ে চলার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে ‘প্রবেশন’।

আইনে যা আছে

দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্স, ১৯৬০ (সংশোধিত ১৯৬৪)-এর আওতায় ক্ষমতাপ্রাপ্ত আদালত প্রথম ও লঘু অপরাধে জড়িত শিশু-কিশোর বা প্রাপ্তবয়স্ক ব্যক্তিকে শর্ত সাপেক্ষে প্রবেশন মঞ্জুর করতে পারবেন। এক থেকে তিন বছরের জন্য প্রবেশন দেওয়ার সুযোগ আছে। আগে থেকে আইনে প্রবেশনের সুযোগ থাকলেও তার চর্চা ছিল কম। কারাগারের ওপর চাপ কমানো এবং ‘সংশোধনমূলক’ সাজার নীতি প্রয়োগে ‘দ্য প্রবেশন অব অফেন্ডার্স অর্ডিন্যান্সের’ বিধান অনুসরণ করতে অধস্তন আদালতে বিচারকদের প্রতি ২০১৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি নির্দেশনা দিয়েছিল সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। এরপর থেকে প্রবেশনব্যবস্থার চর্চা বেড়েছে। চট্টগ্রাম, সুনামগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় প্রবেশনে অনেকে মুক্তি পাচ্ছেন।

বায়েজিদ বোস্তামী এলাকার দোকানি আবদুল হাকিমও গাঁজা রাখার অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এখন তিনি দোকানেই পুরোপুরি মনোযোগ দিচ্ছেন। মারামারির মামলার আসামি চান্দগাঁও এলাকার বাসিন্দা জমির আহমেদ বেকার ছিলেন। এখন তিনি একটি ভবনের নিরাপত্তারক্ষী।

কোনো অপরাধীকে প্রাপ্য শাস্তি না দিয়ে (স্থগিত রেখে), কারাবন্দী না রেখে বা কোনো প্রতিষ্ঠানে আবদ্ধ না করে সমাজে খাপ খাইয়ে চলার সুযোগ দেওয়া হচ্ছে ‘প্রবেশন’। এই ব্যবস্থায় আদালতের নির্দেশে প্রবেশন কর্মকর্তার তত্ত্বাবধানে এবং শর্ত সাপেক্ষে পরিবারের সঙ্গে থাকার সুযোগ পান আবেদনকারী। প্রবেশন কর্মকর্তার পদটি সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীন।

প্রবেশন আইনের ৫ ধারা অনুযায়ী, পুরুষ আসামিরা মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত না হলে প্রবেশন পেতে পারেন। আর নারী আসামিরা মৃত্যুদণ্ড বাদে যেকোনো দণ্ডের ক্ষেত্রে পেতে পারেন প্রবেশন।

প্রবেশন দেওয়ার শর্তের মধ্যে সাধারণত মুক্তিযুদ্ধের বই পড়া, বৃক্ষরোপণ, ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলা, মাদকবিরোধী শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণ, প্রতিবেশীদের সঙ্গে ভালো আচরণ, বিনা মূল্যে গান শেখানো, এতিমদের খাবার সরবরাহ, সৎভাবে জীবনযাপন ও মা-বাবার সেবা করার মতো কাজ করতে বলা হয়ে থাকে।

আদালত সূত্র জানায়, চট্টগ্রামে বেশির ভাগ প্রবেশন দেওয়া হচ্ছে মেট্রোপলিটন ও জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, বিভাগীয় বিশেষ জজ আদালত এবং নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল থেকে। প্রবেশনে থাকা ও মুক্ত হওয়া ২১৭ জনের মধ্যে ১৭০ জন মাদক মামলার, ৩০ জন মারামারির এবং বাকি ১৭ জন মানহানিসহ অন্যান্য মামলার আসামি। এর মধ্যে ৫ থেকে ১০ বছর মামলা চলার পর ১৩০ জন প্রবেশন পান।

মামলা নিষ্পত্তিতে এত দেরি কেন, জানতে চাইলে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের সরকারি কৌঁসুলি মো. আবদুর রশিদ প্রথম আলোকে বলেন, সাক্ষী না আসা, তদন্ত প্রতিবেদন আসতে দেরি হওয়া, আসামি পলাতক থাকা, আদালতের কাছে আসামিদের বারবার সময় নেওয়ায় নিষ্পত্তিতে সময় লেগে যায়। তার ওপর মামলাজট তো আছেই।

একজন আসামি প্রবেশনের আবেদন কীভাবে করবেন, জানতে চাইলে এই সরকারি কৌঁসুলি বলেন, লঘু অপরাধে প্রবেশন পাওয়ার বিষয়টি আইনজীবীরা অবগত আছেন। এ জন্য আইনজীবীরাই আসামিদের বিষয়টি জানাতে পারেন। প্রবেশন আবেদন করতে আইন-আদালতসংক্রান্ত বিভিন্ন সভা ও সেমিনারে আইনজীবীদের উদ্বুদ্ধ করা হচ্ছে।

তাঁদের নতুন জীবন

প্রবেশনে থেকে পুরোপুরি মুক্ত হওয়া ৪৬ জনের মধ্যে ইসমাইল হোসেনসহ চারজনের বিষয়ে সরেজমিনে এলাকায় খোঁজ নিয়েছেন এই প্রতিবেদক। অন্যরা হলেন মো. ইয়াসিন (৪৯), আবদুল হাকিম (৩৮) ও জমির আহমেদ (২৮)। ২০১৯ থেকে ২০২১ সালের মধ্যে তাঁরা প্রবেশনের শর্ত পূরণ করে মুক্ত হন। এলাকার লোকজন জানিয়েছেন, তাঁরা আর অপরাধে জড়াননি।

গাঁজা নিয়ে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন বাকলিয়া থানার চর চাক্তাই এলাকার ভ্যানচালক মো. ইয়াসিন (৪৯)। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, বেশি আয়ের আশায় তিনি গাঁজা বিক্রি করেছিলেন। আর এই বিপথে পা বাড়াবেন না বলে জানান ইয়াসিন। এখন তিনি ভ্যান চালিয়ে স্ত্রী, দুই সন্তানসহ চারজনের সংসার চালান।

বায়েজিদ বোস্তামী এলাকার দোকানি আবদুল হাকিমও গাঁজা রাখার অপরাধে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। এখন তিনি দোকানেই পুরোপুরি মনোযোগ দিচ্ছেন। মারামারির মামলার আসামি চান্দগাঁও এলাকার বাসিন্দা জমির আহমেদ বেকার ছিলেন। এখন তিনি একটি ভবনের নিরাপত্তারক্ষী।

ওই তিনজনের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট থানার ওসিদের সঙ্গে কথা হয়েছে এই প্রতিবেদকের। তাঁরা বলেছেন, তিনজনের নতুন করে অপরাধে জড়ানোর খবর তাঁরা পাননি।

‘ভালোভাবে বাঁচতে চাই’

চট্টগ্রাম মহানগরের আকবর শাহ এলাকার নুর কালাম (২৬) সাড়ে আট বছর আগে ৫০টি ইয়াবাসহ গ্রেপ্তার হয়ে কারাগারে যান। তিন মাস পর জামিনে মুক্তি পান তিনি। মামলার হাজিরা ও ঘরে বৃদ্ধ পঙ্গু বাবার চিকিৎসার খরচ নিয়ে কষ্টে পড়েন পেশায় ভ্যানচালক কালাম। এ অবস্থায় আইনজীবীর মাধ্যমে চট্টগ্রাম মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে প্রবেশনের আবেদন করেন তিনি। ২০২১ সালে তাঁকে দুই বছরের প্রবেশনে পরিবারের সঙ্গে থেকে সাজাভোগের সুযোগ দেন আদালত।

আগামী ৯ নভেম্বর নুর কালামের দুই বছরের প্রবেশন শেষ হবে। ইতিমধ্যে প্রবেশনের শর্তগুলো পূরণে কোনো ব্যত্যয় না হওয়ায় সমাজসেবা অধিদপ্তর তাঁকে পুনর্বাসনের জন্য ৯ মাস আগে একটি ভ্যানগাড়ি দিয়েছে।

প্রবেশনে থাকা নুর কালামকে সম্প্রতি নগরের আকবর শাহ থানার পূর্ব ফিরোজ শাহ বিশ্ব কলোনি এলাকায় দেখা যায় ভ্যানগাড়ি চালাতে। তিনি বলেন, ‘নিজের ভুল বুঝতে পারছি। আমি এখন ভালোভাবে বাঁচতে চাই।’ নুর কালাম নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা করছেন বলে জানালেন এলাকার বাসিন্দারাও।

নুর কালামের বিষয়ে আকবর শাহ থানার ওসি ওয়ালী উদ্দিন প্রথম আলোকে বলেন, প্রবেশন পাওয়ার পর থেকে নতুন করে কোনো অপরাধে জড়ানোর তথ্য নেই নুর কালামের বিষয়ে।

প্রবেশনে থাকা আরও চারজনের বিষয়ে সরেজমিনে খোঁজ নেওয়া হয় বন্দর, পাঁচলাইশ ও খুলশী এলাকায়। দুই থেকে তিন বছর আগে ইয়াবাসহ গ্রেপ্তারের পর তাঁদের চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে এক বছরের জন্য প্রবেশনে দেওয়া হয়। এর মধ্যে রয়েছে পাঁচলাইশ ও খুলশী এলাকার ১৬ ও ১২ বছরের দুই শিশু-কিশোর। বাকি দুজন হলেন বন্দর এলাকার কারখানার শ্রমিক মো. হোসেন (২৬) ও গোসাইলডাঙ্গা এলাকার দিনমজুর মেহের আলী (৩২)। আশপাশের বাসিন্দারা তাঁদের ভালো আচরণের কথা উল্লেখ করেছেন। প্রবেশন কর্মকর্তাও জানান, শর্ত পূরণের বিষয়টি নিয়মিতই খোঁজ রাখেন তিনি।

অনন্য পদক্ষেপ

স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার ক্ষেত্রে প্রবেশন অনন্য একটি পদক্ষেপ উল্লেখ করে আইনি সহায়তা দেওয়া সংগঠন বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড অ্যান্ড সার্ভিসেস ট্রাস্টের (ব্লাস্ট) আইন উপদেষ্টা এবং সাবেক জেলা ও দায়রা জজ রেজাউল করিম প্রথম আলোকে বলেন, লঘু অপরাধে দণ্ডিত ব্যক্তিরা কারাগারে গিয়ে সাজাপ্রাপ্ত কয়েদিদের সঙ্গে থাকলে আরও ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারেন। প্রবেশনে পরিবারের সঙ্গে থেকে সাজা ভোগ করে অন্ধকার থেকে আলোর পথে ফিরে আসার সুযোগ পাচ্ছেন অনেকে। যাঁদের অতীত ফলাফল ভালো, এসব আসামিকে প্রবেশনে পাঠানো উচিত। এতে আদালতে মামলাজট কমার পাশাপাশি কারাগারেও বন্দীর সংখ্যা বাড়বে না।