কারাগারে বসে জজ পরিচয়ে মুঠোফোনে টাকা আদায় বন্দীর, জড়িত দুই কারারক্ষী
কারাগারে বসে মুঠোফোনে নিজেকে মহানগর দায়রা জজ পরিচয় দিয়ে পৌরসভার এক মেয়রের কাছ থেকে টাকা আদায় করেন এক বন্দী। ওই বন্দীকে মুঠোফোনটি দেন এক কারারক্ষী। আরেক কারারক্ষী মেয়রের পাঠানো টাকা বন্দীকে তুলে এনে দেন। অথচ কারাগারের বন্দীদের মুঠোফোন ব্যবহার নিষিদ্ধ।
পৌর মেয়রের কাছ থেকে টাকা আদায়ের ঘটনাটি ঘটে বছর দুয়েক আগে, গাজীপুরের কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-১-এ। এ ঘটনায় করা মামলার তদন্ত শেষে ৫ সেপ্টেম্বর অভিযোগপত্র জমা দেয় চট্টগ্রাম পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিট। অভিযোগপত্রে বন্দী রাজু আহমেদ এবং সহকারী প্রধান কারারক্ষী মোহাম্মদ কাউসার মিয়া ও কারারক্ষী সানোয়ার হোসেনকে আসামি করা হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর অভিযোগপত্র গ্রহণ করেন আদালত। একই সঙ্গে দুই কারারক্ষীর বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারি করা হয়।
কারাগারে বসে মহানগর দায়রা জজ পরিচয়ে টাকা আদায়ের প্রমাণ পাওয়ায় দুই কারারক্ষী ও এক বন্দীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।আসিফ মহিউদ্দীন, অতিরিক্ত উপকমিশনার, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, চট্টগ্রাম
পুলিশের অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ২০২১ সালের ২৩ এপ্রিল নিজেকে তৎকালীন চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ পরিচয় দিয়ে চট্টগ্রামের ফটিকছড়ি, পটিয়া ও মিরসরাই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এবং ফটিকছড়ি পৌরসভার মেয়রের কাছে ফোন করেন রাজু আহমেদ। ফোনে করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের কারণে লকডাউনে অসহায় মানুষকে সহায়তার জন্য টাকা পাঠাতে বলেন তিনি। ওই দিন পৌরসভার মেয়র মুঠোফোনে আর্থিক লেনদেনের সেবার মাধ্যমে রাজুকে ১৫ হাজার টাকা পাঠান।
বিষয়টি জানাজানি হলে চট্টগ্রাম মহানগর দায়রা জজ আদালতের নাজির মোহাম্মদ ইসমাইল বাদী হয়ে নগরের কোতোয়ালি থানায় অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তির বিরুদ্ধে মামলা করেন। এতে বলা হয়, অজ্ঞাতনামা এক ব্যক্তি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাসহ বিভিন্ন গণ্যমান্য ব্যক্তির কাছে মহানগর দায়রা জজ পরিচয়ে টাকা দাবিসহ বিভিন্ন তদবির করেছেন। এতে বিচার বিভাগের সুনাম চরমভাবে ক্ষুণ্ন হয়েছে।
মুঠোফোন দেন সানোয়ার, টাকা তুলে দেন কাউসার
শুরু থেকেই মামলাটির তদন্ত করেন চট্টগ্রাম পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের উপপরিদর্শক (এসআই) সুমিত দাশ। অভিযোগপত্রে তিনি বলেন, যে মুঠোফোন নম্বরে টাকা নেওয়া হয়েছিল, প্রথমে সেটির পরিচয় শনাক্ত করেন তিনি। দেখা যায়, সেটি এক নারীর নামে নিবন্ধিত। তাঁর স্বামী সানোয়ার হোসেন। ওই নারী পুলিশকে জানান, তাঁর নামে নিবন্ধিত নম্বরটি ব্যবহার করতেন তাঁর স্বামী।
পুলিশের অভিযোগপত্রে নাম আসায় দুই কারারক্ষীর বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাঁরা যে কাজ করেছেন, সে জন্য আগামী রোববার তাঁদের সাময়িক বরখাস্তসহ পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।এ কে এম ফজলুল হক, উপ কারা মহাপরিদর্শক
পরে জিজ্ঞাসাবাদে সানোয়ার তদন্ত কর্মকর্তাকে জানান, ২০২১ সালের এপ্রিলে কাশিমপুর কারাগারে যোগ দেন তিনি। কারাবন্দী রাজু আহমেদ তাঁর কাছে মুঠোফোন ও আর্থিক লেনদেনের সেবা ব্যবহারের জন্য একটি সিম চান। তখন তিনি তাঁর স্ত্রীর নামে নিবন্ধিত সিমটি দেন। পরে ওই সিম ও মুঠোফোন রাজুর কাছ থেকে আর ফেরত পাননি।
ওই সিম ব্যবহার করে রাজু আহমেদ বিভিন্ন ব্যক্তির কাছে টাকা দাবি করেছিলেন। ওই নম্বরেই ফটিকছড়ি পৌরসভার মেয়র ১৫ হাজার টাকা পাঠান। টাকা পাওয়ার পর রাজু আরেকটি নম্বরে ওই টাকা পাঠিয়ে দেন। আরেক কারারক্ষী কাউসার মিয়া ওই টাকা বাইরে থেকে ক্যাশ আউট করে রাজুকে এনে দেন।
অভিযোগপত্রে আরও বলা হয়, বন্দী রাজু আহমেদ তাঁর মুঠোফোনে আরেকটি সিমও ব্যবহার করতেন। ওই সিমটি ঢাকার কামরাঙ্গীরচরের আশ্রাফাবাদ এলাকার এক ব্যক্তির নামে নিবন্ধিত। কিন্তু কামরাঙ্গীরচর বড় এলাকায় হওয়ায় এবং সিম নিবন্ধনের তথ্যে কোনো বাড়ির হোল্ডিং নম্বর না থাকায় স্থানীয় লোকজন পুলিশকে ওই ব্যক্তির সম্পর্কে কোনো তথ্য দিতে পারেননি।
পুলিশ বলছে, রাজু আহমেদ প্রতারক চক্রের একজন সদস্য। তিনি সরকারি কর্মকর্তা পরিচয়ে বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে প্রতারণার মাধ্যমে টাকা আদায় করে আসছেন। তাঁর বিরুদ্ধে গাজীপুরের কালিয়াকৈর থানার প্রতারণার আরেকটি মামলা রয়েছে। তাঁর স্থায়ী ও বর্তমান ঠিকানায় পরিবারের কাউকে পায়নি পুলিশ।
কারাবন্দীকে মুঠোফোন ব্যবহার করতে দেওয়াটা ভুল ছিল বলে স্বীকার করেছেন কারারক্ষী সানোয়ার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ভুল হয়ে গেছে।’ ক্যাশ আউট করে টাকা তুলে এনে কারাবন্দীকে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন আরেক কারারক্ষী কাউসার মিয়াও।
চট্টগ্রাম পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপকমিশনার আসিফ মহিউদ্দীন প্রথম আলোকে বলেন, কারাগারে বসে মহানগর দায়রা জজ পরিচয়ে টাকা আদায়ের প্রমাণ পাওয়ায় দুই কারারক্ষী ও এক বন্দীর বিরুদ্ধে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে। এতে আটজনকে সাক্ষী রাখা হয়েছে।
‘আমার ভুল হয়ে গেছে’
রাজু আহমেদকে কারাগারে মুঠোফোন ব্যবহার করতে দেওয়াটা ভুল ছিল বলে স্বীকার করেছেন কারারক্ষী সানোয়ার হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমার ভুল হয়ে গেছে।’ ক্যাশ আউট করে টাকা তুলে এনে দেওয়ার কথা স্বীকার করেছেন আরেক কারারক্ষী কাউসার মিয়াও। তিনি বর্তমানে নারায়ণগঞ্জ কেন্দ্রীয় কারাগারের সহকারী প্রধান কারারক্ষী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন। কাউসার প্রথম আলোকে বলেন, ‘সে (রাজু) বলাতে টাকাগুলো এনে দিয়েছিলাম।’
এদিকে অবৈধভাবে বন্দীকে মুঠোফোন ব্যবহার করতে দেওয়ার ঘটনা জানাজানি হলেও দুই কারারক্ষীর বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। সানোয়ার হোসেনকে কাশিমপুর কারাগার-১-এর ভেতরের পরিবর্তে বাইরে (অফিসে) দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। আর সহকারী প্রধান কারারক্ষী কাউসার মিয়াকে নারায়ণগঞ্জে বদলি করা হয়েছে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিভাগের উপ কারা মহাপরিদর্শক (ডিআইজি প্রিজনস) এ কে এম ফজলুল হক প্রথম আলোকে বলেন, পুলিশের অভিযোগপত্রে নাম আসায় দুই কারারক্ষীর বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে। তাঁরা যে কাজ করেছেন, সে জন্য আগামী রোববার তাঁদের সাময়িক বরখাস্তসহ পরবর্তী ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
এ বিষয়ে সাবেক উপ কারা মহাপরিদর্শক সামসুল হায়দার ছিদ্দিকী প্রথম আলোকে বলেন, কারাগারে বন্দীদের কাছ থেকে মুঠোফোন উদ্ধার করা কারারক্ষীদের দায়িত্ব। সেখানে একজন বন্দীকে প্রতারণার কাজে নিজের মুঠোফোন ব্যবহার করতে দেওয়াটা জঘন্য অপরাধ। জড়িত দুই কারারক্ষীর বিরুদ্ধে কারা কর্তৃপক্ষ এত দিন কেন ব্যবস্থা নেয়নি, তার তদন্ত হওয়া উচিত। দুই কারারক্ষী ও তাঁদের তদারকিতে যাঁরা আছেন, তাঁদের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে হবে। না হলে এ ধরনের ঘটনা বারবার ঘটবে, যা কারাগারের নিরাপত্তার জন্য হুমকি।