চুরির দেড় কেজি স্বর্ণ বরখাস্ত এসআইয়ের বাসার বিদ্যুতের সুইচ হোল্ডারের নিচে

পুলিশের বরখাস্ত উপপরিদর্শক (এসআই) আশরাফুল ইসলাম
ছবি: সংগৃহীত

দেড় বছর আগে ঢাকার গাবতলী থেকে এক স্বর্ণ ব্যবসায়ীর প্রাইভেট কার চুরি হয়। পরদিন হোটেল র‌্যাডিসন ব্লুর কাছে বিমানবন্দর সড়কে গাড়িটি পাওয়া গেলেও তাতে রাখা ৩১টি স্বর্ণের বার খোয়া যায়। এ ঘটনার তদন্ত করে পুলিশের বরখাস্ত একজন উপপরিদর্শকের নাটোরের বাসা থেকে ১৫টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করে ডিবি। ঢাকায় তাঁর তিন সহযোগীর কাছ থেকে আরও ১৪টি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়।

পুলিশের সাবেক এই উপপরিদর্শকের নাম আশরাফুল ইসলাম। সাত বছর আগে স্বর্ণ ছিনতাইয়ের চেষ্টার একটি ঘটনায় তাঁকে পুলিশের চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়। তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, আশরাফুল সহযোগীদের নিয়ে স্বর্ণ ছিনতাইয়ের একটি চক্র গড়ে তুলেছিলেন। এবার তাঁর যে তিন সহযোগীর কাছ থেকে স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়েছে, তাঁদের একজন ২০১৬ সালের ওই ঘটনায়ও জড়িত ছিলেন।

এ মামলায় আশরাফুল ইসলামসহ পাঁচজনকে আসামি করে গত বছরের ১১ ডিসেম্বর ঢাকার চিফ মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট (সিএমএম) আদালতে অভিযোগপত্র জমা দেয় গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ডিবির সাইবার অ্যান্ড স্পেশাল ক্রাইম বিভাগের উপপরিদর্শক (এসআই) ধর্মেন্দু দাশ প্রথম আলোকে বলেন, গাবতলী থেকে প্রাইভেটকার চুরি করে স্বর্ণের বার গায়েবের সঙ্গে  বরখাস্ত হওয়া পুলিশের এসআই আশরাফুল জড়িত ছিলেন। এর আগেও তাঁর বিরুদ্ধে স্বর্ণ ছিনতাইয়ের চেষ্টার অভিযোগে মামলা হয়েছিল। এরপর ২০১৭ সালের ৯ জুলাই তাঁকে চাকরিচ্যুত করা হয়।

এ বিষয়ে আশরাফুল প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৬ সালে স্বর্ণ ছিনতাই চেষ্টার মামলা থেকে তিনি অব্যাহতি পেয়েছেন। পরবর্তী সময়ে গাবতলী থেকে স্বর্ণ চুরির মামলায় তাঁকে ফাঁসানো হয়েছে। তিনি আদালতে ন্যায়বিচার পাবেন বলে আশা করেন।

এ মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত অপর আসামিরা হলেন আবদুর রাজ্জাক, তপন বিশ্বাস, মিরাজ হোসেন ও তাঁর স্ত্রী জান্নাতুল ফেরদৌস। তাঁদের মধ্যে মিরাজ পলাতক। বাকিরা জামিনে আছেন।

রেস্তোরাঁয় খেতে গেলে চুরি হয় গাড়ি

স্বর্ণ ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন ও জাহিদুল ইসলাম দুই বন্ধু। গত বছরের ৮ জানুয়ারি ঢাকার কাফরুল থেকে একটি প্রাইভেট কারে স্বর্ণের বার নিয়ে চুয়াডাঙ্গার উদ্দেশে রওনা হন তাঁরা। গাড়ির আসনের নিচে বিশেষভাবে লুকিয়ে রাখা ছিল ৩১টি স্বর্ণের বার।

রাত ১০টার দিকে গাড়িটি গাবতলী জামে মসজিদের সামনে রাস্তার পাশে থামানো হয়। ভালোভাবে গাড়ির দরজা বন্ধ করে দুই স্বর্ণ ব্যবসায়ী পাশের রেস্তোরাঁয় খেতে যান। খাওয়া শেষে ঘণ্টাখানেক পর ফিরে দেখেন গাড়ি নেই।

তখন দুই স্বর্ণ ব্যবসায়ী থানা-পুলিশের শরণাপন্ন হন। রাতভর খোঁজাখুঁজির পরও গাড়ির হদিস পাওয়া যায়নি। পরদিন বিমানবন্দর সড়কে শহীদ রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের সামনে সেই প্রাইভেট কার পাওয়া যায়। তবে গাড়ির ভেতর লুকিয়ে রাখা স্বর্ণ পাওয়া যায়নি।

অভিযোগপত্রের তথ্য ও তদন্ত কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, আগে থেকেই আশরাফুলসহ অন্যরা স্বর্ণ ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন ও জাহিদুলের গাড়িটি অনুসরণ করছিলেন। গাবতলীতে গাড়ি রেখে খেতে যাওয়ার পর নকল চাবি দিয়ে দরজা খুলে গাড়িটি চালিয়ে নিয়ে যান চক্রের একজন।

পরে প্রাইভেট কারটি রমিজ উদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের সামনে নিয়ে আসা হয়। গাড়ি অনুসরণ করে আশরাফুল মোটরসাইকেলে করে ক্যান্টনমেন্ট এলাকায় যান। এরপর গাড়ি থেকে স্বর্ণের বার নিয়ে তাঁরা নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করে নেন।

যেভাবে উদ্ধার

এ ঘটনায় রাজধানীর দারুসসালাম থানায় চুরির মামলা করেন স্বর্ণ ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন। মামলা দায়েরের পর প্রযুক্তির সহায়তায় ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) স্বর্ণ চুরির সঙ্গে জড়িত কয়েকজনকে শনাক্ত করে।

প্রথমে ৩০ জানুয়ারি পল্লবীর বালুরঘাট এলাকার বাসা থেকে রাজ্জাককে গ্রেপ্তার করে গোয়েন্দা পুলিশ। তাঁর বাসার আলমারি থেকে দুটি স্বর্ণের বার উদ্ধার করা হয়।

রাজ্জাকের দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে শান্তিনগরে মিরাজের বাসায় যান পুলিশ সদস্যরা। সেখানে মিরাজকে না পেয়ে তাঁর স্ত্রী ও সন্তানকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। ওই বাসা থেকে চারটি স্বর্ণের বার (৪৬৫ গ্রাম) উদ্ধার করা হয়। পরে ওই ভবনের নিচতলায় তপন বিশ্বাসের বাসা থেকে আরও আটটি স্বর্ণের বার (৯০৩ গ্রাম স্বর্ণ) জব্দ করে পুলিশ।

গ্রেপ্তার ব্যক্তিদের মধ্যে রাজ্জাক আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন। সেখানে এ ঘটনায় সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা আশরাফুল ইসলামের সম্পৃক্ততার তথ্য উঠে আসে। গ্রেপ্তার অপর আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে আশরাফুলের সম্পৃক্ত পাওয়া যায়।

এরপর আশরাফুলের নাটোরের বাড়িতে অভিযান চালায় ডিবির একটি দল। আশরাফুল যে কক্ষে ঘুমান, সেই কক্ষের দুটি বৈদ্যুতিক সুইচ হোল্ডারের ভেতর ঢাকনা দিয়ে লুকিয়ে রাখা ১৫টি স্বর্ণের বার (১ হাজার ৫১৮ গ্রাম) উদ্ধার করা হয়। এ ছাড়া জুয়েলার্সে বিক্রি করে দেওয়া একটি বারও উদ্ধার করা হয়।

তদন্ত কর্মকর্তা ধর্মেন্দু দাশ অভিযোগপত্রে উল্লেখ করেন, স্বর্ণ ছিনতাই চেষ্টার অপরাধে ২০১৬ সালের ১৬ ফেব্রুয়ারি আশরাফুল ও রাজ্জাক গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে তাঁদের দুজনের বিরুদ্ধে বংশাল থানায় মামলা হয়। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, তাঁরা পূর্বপরিচিত এবং আগে থেকে স্বর্ণ ছিনতাইয়ে জড়িত।

স্বর্ণ চুরির এ ঘটনায় ন্যায়বিচার চান ভুক্তভোগী ব্যবসায়ী মহিউদ্দিন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ‘সেদিন আমাদের গাড়িটি চুরি করে নিয়ে যান তাঁরা। পরে পুলিশ চোরাই স্বর্ণ উদ্ধারও করেছে। সাবেক পুলিশ কর্মকর্তা আশরাফুলের কাছ থেকে দেড় কেজি স্বর্ণ উদ্ধার করা হয়েছে। তাঁর যথাযথ শাস্তি চাই।’