৩৩ বছর আগে ডাকাতি হওয়া দুই স্টেনগান উদ্ধারের চমকভরা কাহিনি

প্রকাশ্য রাস্তায় ডাচ্–বাংলা ব্যাংকের অর্থ ডাকাতির ঘটনার সুরাহা এখনো হয়নি। উদ্ধার হয়নি পুরো অর্থ। টাকা উদ্ধার নিয়ে ধোঁয়াশাও কম হয়নি। পুলিশ শুরুতে অর্থ উদ্ধারের যে বর্ণনা দিয়েছিল, পরে দেখা গেছে ঘটনা অন্য রকম। শেষ পর্যন্ত ডাকাতি হওয়া ১১ কোটি টাকার মধ্যে কত উদ্ধার হয়, সেটাই দেখার বিষয়। তবে কৌতূহল বেশি হচ্ছে কীভাবে উদ্ধার হলো, তা নিয়ে। মানুষ তো ঘটনার পেছনের গল্পটাই জানতে বেশি আগ্রহী।

ব্যাংকের টাকা নিয়ে যাওয়ার সময় প্রকাশ্য রাস্তায় ডাকাতির ঘটনা অবশ্য এটাই প্রথম নয়। বাংলাদেশে প্রথম এ ঘটনা ঘটেছিল ১৯৯০ সালের ৫ মার্চ। মতিঝিলের মতো ব্যস্ত সড়কে ওই দিন তৎকালীন বিদেশি ব্যাংক গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকের ৫০ লাখ টাকা ডাকাতি হয়েছিল। দেশজুড়ে সেই ঘটনা ছিল ব্যাপক আলোচিত। পুলিশের সমালোচনাও হয়েছিল প্রচুর। তবে শেষ পর্যন্ত দ্রুতই অর্থ উদ্ধার করেছিল পুলিশ।

আরও পড়ুন

পুলিশের দুই স্টেনগান ছিনতাই

সেই ব্যাংক ডাকাতি তখন ব্যাপক আলোড়ন তুললেও আরেকটি বড় ঘটনা থেকে গেছে চোখের আড়ালেই। ঘটনাটি প্রকাশিত যাতে না হয়, সে জন্য আপ্রাণ চেষ্টাও করে পুলিশ। আর সেটি ছিল পুলিশের কাছ থেকেই দুটি স্টেনগান ছিনতাই বা ডাকাতি। মজার ব্যাপার হলো, স্টেনগান বেহাত হয়েছিল ব্যাংকের ৫০ লাখ টাকা ডাকাতির এক দিন পরেই। তবে সেই অস্ত্র উদ্ধারের কাহিনিটাই আসলে বেশি চমকপ্রদ। এ থেকে থেকে বোঝা সম্ভব অস্ত্র উদ্ধারের নতুন এক পুলিশি পদ্ধতি। আসুন, সেই গল্পটি জানা যাক।

তখন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের (ডিবি) উপ-পুলিশ কমিশনার (ডিসি) ছিলেন সফিক উল্লাহ। পুলিশ জীবনের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি একটি বই লিখেছেন। ‘এক পুলিশের ডায়েরি’ নামের বইটি প্রকাশিত হয় ২০১৬ সালে। সেই বইটিতে ৫০ লাখ টাকা উদ্ধারের ঘটনা যেমন বিস্তারিত লিখেছেন, তেমনি লিখেছেন অস্ত্র উদ্ধারের বিশেষ সেই কাহিনিও।

গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকের ৫০ লাখ টাকা ডাকাতি নিয়ে তখন দেশজুড়ে বেশ হইচই। ডাকাত দলের অন্যতম সদস্য পরিবহন নেতা হিরুরেজা ওরফে হিরুকে ধরে ক্যান্টনমেন্ট থানায় জিজ্ঞাসাবাদ করছিল তখন পুলিশ। এরপরের ঘটনা এভাবে লিখেছেন সফিক উল্লাহ, ‘এসি আকরাম, আকতারুজ্জামান রুনু ও সুলতানকে দিই জিজ্ঞাসাবাদের দায়িত্ব। আমি নিজেও সন্ধ্যায় ক্যান্টনমেন্ট থানায় গিয়ে হিরুকে কিছুক্ষণ জিজ্ঞাসাবাদ করে চলে আসি। আকরাম ও সুলতানকে বলে আসি কোনো তথ্য পাওয়ামাত্র যেন আমাকে জানানো হয়।

রাত আনুমানিক আড়াইটার দিকে আমার বাসার সিকিউরিটি খবর দেয় ডিবি অফিস থেকে দুজন সাব–ইন্সপেক্টর ও একজন কনস্টেবল এসেছে। দ্রুত নিচে নেমে এসে জানলাম, তারা এসেছে আরেক নতুন ঝামেলা নিয়ে। কল্যাণপুরে ছিনতাইকারীরা তাদের দুটি স্টেনগান ছিনতাই করে নিয়ে গেছে। গাবতলীতে তারা গিয়েছিল ডাকাত ধরতে। ডাকাতদের তারা পায়নি, উল্টো ফেরার পথে কল্যাণপুরে একটি প্রাইভেট কার এসে তাদের কাছ থেকে অস্ত্রের ব্যাগটা নিয়ে চলে যায়। রিভলবার দিয়ে তারা কয়েক রাউন্ড গুলি করেও ছিনতাইকারীদের থামাতে পারেনি। বড় সাংঘাতিক ব্যাপার। কেন, কোন ডাকাত ধরতে তারা গাবতলী গিয়েছিল বা কে তাদের পাঠিয়েছে, এটা নিয়ে তাৎক্ষণিক বেশি প্রশ্ন তুললাম না। তারা নিজে থেকেই জানায় এসি আকরাম তাদের সেখানে পাঠিয়েছিল।’

আরও পড়ুন

তথ্য গোপন রাখে পুলিশ

এর মধ্যে অবশ্য হিরু ব্যাংকের অর্থ ডাকাতির কথা স্বীকার করেছে। উদ্ধার হচ্ছে টাকাও। এরপর সফিক উল্লাহ লিখেছেন, ‘খবরটা পুলিশ কমিশনার নসরুল্লাহ খানকে জানাই। সেই সঙ্গে জানাই স্টেনগান খোয়া যাওয়ার খবরটিও। ভালো সংবাদের পাশাপাশি মন্দ সংবাদ। খবর পেয়েই নসরুল্লাহ খান সরাসরি আমার অফিসে চলে আসেন। এমন একটি ভালো খবরের সঙ্গে দুটি স্টেনগান খোয়া যাওয়ায় তিনিও বিচলিত হন। বিস্তারিত জানানোর জন্য আমরা দুজনই চলে যাই আইজিপি তৈয়ব উদ্দিন সাহেবের বাসায়।

আইজিপিকে ভালো খবরটি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তিনি দারুণ উৎফুল্ল হন এবং স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকে জানানোর জন্য টেলিফোন হাতে নেন। আমি তাকে টেলিফোন করার আগে স্টেনগান খোয়া যাওয়ার দুঃসংবাদটি জানাই। সঙ্গে সঙ্গে তিনি টেলিফোন রেখে দিয়ে কিছুটা চিন্তিত হয়ে পড়েন। তিনি কোনো অবস্থাতেই স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মাহমুদুল হাসানের সঙ্গে কথা বলতে রাজি হলেন না। বললেন, তুমি কথা বলো। বাধ্য হয়ে আমি স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে কথা বলি। তাকে গ্রিন্ডলেজ ব্যাংকের টাকা উদ্ধার, ডাকাত গ্রেপ্তার এবং পরে বাকি টাকাও উদ্ধারের পরিকল্পনার কথা জানাই। তিনি খুশি হলেন। আমাকে বারবার ধন্যবাদ দিতে থাকলেন। এরই মধ্যে আমি তাকে জানালাম স্টেনগান খোয়া যাওয়ার কথা।

শুনে তিনি একটু চুপ করে থাকলেন। কিছু বলার আগেই আমি বললাম, স্যার আপনি চিন্তা করবেন না, এক সপ্তাহের মধ্যে আমি স্টেনগান দুটি উদ্ধার করব। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী বললেন, তোমার প্রতি আমার সেই আস্থা আছে। তুমি তা অবশ্যই পারবে। বিষয়টি তাহলে আমি আর মহামান্য রাষ্ট্রপতিকে জানাচ্ছি না। তবে তোমার টাকা উদ্ধারের বিষয়টি এখনই জানিয়ে দিচ্ছি।’

হিরুর কথামতো এরপর চলে ডাকাতির অর্থ উদ্ধারের অভিযান। একটা পর্যায়ে অধিকাংশ অর্থই উদ্ধার করা হয়। এরপর আনুষ্ঠানিকভাবে সংবাদ সম্মেলন করে অর্থ উদ্ধারের বিস্তারিত জানানো হয়। ফলাও করে তা প্রচারিত হয় সে সময়ের পত্রিকাগুলোয়।

এরপর সফিক উল্লাহ লিখেছেন, ‘এদিকে খোয়া যাওয়া অস্ত্র তো এখনো উদ্ধার হলো না। এত দিন এসি আকরামকে কিছু বলিনি। ব্যাংক ডাকাতির টাকা উদ্ধারের পর স্টেনগান দুটির ঘটনা আমাকে স্বস্তি দিচ্ছিল না। এ পর্যায়ে একদিন এসি আকরামকে জিজ্ঞাসা করি, কী কারণে কার নির্দেশে সে স্টেনগান নিয়ে ইন্সপেক্টরদের বাইরে পাঠিয়েছিল। এর কোনো সদুত্তর সে দিতে পারেনি। যাহোক, ডিবি এবং ডিএমপির ইমেজ রক্ষায় নেমে পড়ি অস্ত্র উদ্ধার অভিযানে। আমার মাথায় তখন আরও ছিল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি ও কমিশনারকে দেওয়া প্রতিশ্রুতির বিষয়টি। কিন্তু কোথাও থেকে তেমন কোনো সহযোগিতা পাচ্ছিলাম না। তখন অন্য পথ অবলম্বন করি। যেভাবে হোক আমাকে এক সপ্তাহের মধ্যে দুটি স্টেনগান উদ্ধার দেখাতেই হবে। তাই নিজেদের অস্ত্র উদ্ধারের সঙ্গে সঙ্গে কীভাবে দুটি স্টেনগান রিকভারি করে ওয়াদা রক্ষা করতে পারি, সে চেষ্টায় লেগে পড়ি।’

অস্ত্র উদ্ধারের ভিন্ন কাহিনি

অস্ত্র উদ্ধারের সেই ভিন্ন পথটা তাহলে কী? চমক আছে আসলে সেখানেই। যেমন সফিক উল্লাহ লিখেছেন, ‘এমন সময় মনে পড়ে শুক্রাবাদের লতিফের কথা। ’৮৮ সালে কমিশনার প্রার্থী ছিলেন তিনি। সেই সময় নির্বাচনের জন্য বরিশালে সর্বহারাদের কাছ থেকে ৬০ হাজার টাকায় লতিফ একটা স্টেনগান কিনেছিলেন বলে আমার কাছে তথ্য ছিল। স্টেনগানসহ তাকে গ্রেপ্তার করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয়েছি। ব্যাপারটি লতিফেরও জানা ছিল। তাই সে সব সময়ই সাবধানে চলাফেরা করত।

এবার আমি সরাসরি তাকে আমার অফিসে ডেকে এনে বলি যে, তোমার কাছে একটি স্টেনগান আছে। তুমি কীভাবে জোগাড় করেছে, তা–ও আমার জানা আছে। তোমার ভাগ্য ভালো যে স্টেনগানসহ তুমি ধরা পড়োনি। তুমি যদি সত্যিকার অর্থে স্টেনগানসহ ধরা পড়ে জেলে যেতে না চাও, তাহলে স্টেনগানটি আমাকে দিয়ে দাও। তোমার বিরুদ্ধে কোনো মামলা করব না। উল্টো তুমি যে ৬০ হাজার টাকায় স্টেনগান কিনেছ, তোমাকে তা দিয়ে দেব। এমন সোজাভাবে কথা বলায় সঙ্গে সঙ্গে সে আমার দুপা জড়িয়ে ধরে এবং বলে যে আমি এক্ষুনি আপনাকে স্টেনগান দিয়ে দিচ্ছি। আমাকে এ বিপদ থেকে বাঁচান। এ কথা বলে সে বেরিয়ে যায় এবং আধঘণ্টার মধ্যেই একটি গুলিভর্তি ম্যাগাজিনসহ স্টেনগানটা এনে আমার পায়ের কাছে রেখে আবারও আমার পা জড়িয়ে ধরে মাফ চায়। আমি স্টেনগানটি রেখে তাকে কথা দিই যে, তার বিরুদ্ধে কোনো মামলা হবে না। সে মনের আনন্দে আমার অফিস ত্যাগ করে।’

এভাবে একটি স্টেনগান জোগাড় হয়। এবার দ্বিতীয় স্টেনগান জোগাড়ের কাহিনি। একসময় সেটাও পাওয়া গেল। এ নিয়ে তৎকালীন ডিসি (ডিবি) সফিক উল্লাহ লিখেছেন, ‘এরই মধ্যে মনে পড়ে হাজারীবাগ রায়েরবাজার এলাকার কমিশনার আহমেদ হোসেন মিয়ার কথা। তাকে ডেকে আনি এবং বলি, আমার একটা স্টেনগান দরকার। তোমার জানামতে কোথাও থাকলে আমাকে একটা জোগাড় করে দাও। সে আমাকে জোগাড় করে দেবে বলে আশ্বাস দিয়ে বিদায় নেয়।

সাভারে তখন একটা নির্বাচন হচ্ছিল। নির্বাচনের কোনো এক প্রার্থীর কাছ থেকে ৫০ হাজার টাকার বিনিময়ে একটা স্টেনগান নিয়ে আসে সে। তাকে কথা দিয়েছিলাম যাদের কাছ থেকে স্টেনগান আনবে তাদের অ্যারেস্ট করব না। এদিকে স্টেনগান খোয়ানোর একটি রিপোর্ট গোপনীয়ভাবে ডিপার্টমেন্টে দিয়ে রাখি। আইজিপিকেও বলে রাখি যেন রিপোর্টটি গোপনই থাকে। আর সংগ্রহ করা স্টেনগান দুটি উদ্ধার দেখানোর ব্যবস্থা করতে বলি রুনুকে। উদ্ধার দেখানোর জন্য সে স্টেনগান দুটির গায়ে লেখা নম্বরগুলো মুছে ফেলে।

এরপর একটা চালাকি করে সে। আগারগাঁওয়ে পাসপোর্ট অফিস এলাকায় ছিনতাইকারীকে ধাওয়া দিচ্ছে এমন মনগড়া গল্প বলতে থাকে ওয়্যারলেসে। একপর্যায়ে ওয়্যারলেসে জানায় যে, ছিনতাইকারীরা একটি স্টেনগান পালিয়ে গেছে। নাটকীয় আয়োজন করে একটি স্টেনগান উদ্ধার দেখানো হয়। পরদিন খিলক্ষেত এলাকা থেকে একইভাবে উদ্ধার দেখানো হয় আরেকটা। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইজিপি ও পুলিশ কমিশনারকে জানালাম স্টেনগান দুটি উদ্ধার হয়ে গেছে। পুলিশ সদর দপ্তরে রিপোর্ট দিয়ে রাখি যে দুটি স্টেনগান পাওয়া গেছে মনে হচ্ছে এ দুটি পুলিশেরই খোয়া যাওয়া স্টেনগান। তবে যেহেতু নম্বর মুছে ফেলা হয়েছে, তাই এটা নিশ্চিত হওয়ার জন্য ব্যালিস্টিক এক্সপার্টের নিকট পাঠানো হবে।’

যেভাবে তথ্য গোপন

প্রশ্ন হচ্ছে, এত বড় একটা ঘটনা গোপন ছিল কীভাবে। এরও একটা ব্যাখ্যা দিয়েছেন তিনি। কোনো কিছু উদ্ধারের এই পদ্ধতি পুলিশ এখনো গ্রহণ করে কি না, এর উত্তর অবশ্য দিতে পারবে এখন যাঁরা দায়িত্বে আছেন, তাঁরাই। তার আগে সফিক উল্লাহর ব্যাখ্যাটি জানা যাক। তিনি বলেছেন, ‘সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে আমার অত্যন্ত সুসম্পর্কের সুবাদে কোনো একটি পত্রিকাও ডিবির এই অস্ত্র খোয়া যাওয়ার খবরটি প্রচার করেনি। এ ছাড়া ডিবি অফিসের প্রত্যেকটি অফিসার এবং ফোর্স আমার প্রতি এত বেশি অনুগত ছিল যে তারাও কেউ এই খবরটি কোথাও কারও নিকট প্রকাশ করেনি। পেশাগত সম্পর্কের পাশাপাশি আস্থা-বিশ্বাস অর্জন করতে পারলে পুলিশের চাকরিতে সফলতা অনিবার্য। জীবনে আমি তা এ রকম অনেকবার প্রমাণ পেয়েছি। সেই সঙ্গে পাবলিক রিলেশনের বিষয়টিও গুরুত্বপূর্ণ।’

আসল তথ্য অবশেষে জানা গেল

তবে শেষ পর্যন্ত ছিনতাই হওয়া স্টেনগানও উদ্ধার হয়েছিল। সফিক উল্লাহ লিখেছেন, ‘অস্ত্র উদ্ধার দেখাতে সক্ষম হলেও আমার মনে কিন্তু শান্তি নেই। সারাক্ষণই টেনশনে থাকি পুলিশের কাছ থেকে ছিনতাই করা সেই অস্ত্র নিয়ে দুর্বৃত্তরা কখন কোথায় কী অঘটন না জানি ঘটায়। তাই অব্যাহত থাকে খোয়া যাওয়া স্টেনগান দুটি উদ্ধারের প্রচেষ্টা। এরই মধ্যে ১৯৯০ সালের ৩ মে ঘটে আরেক অঘটন। গুলশানে অপমৃত্যু হয় মাহিয়া ইসলাম নামের এক নারীর। গুলশান মার্কেট থেকে বাজার করে ফেরার পথে গুলশান ১ ও ২-এর মাঝামাঝিতে একটি প্রাইভেট কারে ৫ ছিনতাইকারী তার পথ আটকায়। হাতে ছুরিকাঘাত করে মাহিয়া ইসলামের গলার চেইনটি ছিনিয়ে নেয় তারা।

ভদ্রমহিলা কয়েক দিন আগেই হৃদ্‌রোগে আক্রান্ত হয়ে সোহরাওয়ার্দী হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে বাড়িতে আসেন। ছুরিকাঘাতে আহত হয়ে দৌড়ে গিয়ে নিজের গেটের সামনে পড়ে সেখানেই মারা যান তিনি। এ মামলাটির তদন্তের ভারও ডিবির ওপর ন্যস্ত হয়। একদিন পর মাহিয়া ইসলাম হত্যা ও ছিনতাই ঘটনায় ব্যবহৃত গাড়িটি বাড্ডা এলাকায় পরিত্যক্ত অবস্থায় পাওয়া যায়।

খোঁজ নিয়ে দেখা যায় এ গাড়িটিও ছিনতাই হয়েছে মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে। গাড়ি ছিনতাইয়ে জড়িতরা অত্যন্ত অভিজ্ঞ ড্রাইভার। বিশেষ করে টয়োটা গাড়ি এরা চাবি ছাড়াই খুলে ফেলতে পারে। অনেক চেষ্টার পর আমি গাড়ি চুরিতে এক্সপার্ট এক চোরকে সোর্স হিসেবে পেয়ে যাই। তার থেকে জানতে পারি ইস্কাটনে অফিসার্স কোয়ার্টারের পেছনে বস্তির মতো বাড়ি করে থাকা সরকারি ড্রাইভারদের সঙ্গে তাদের আত্মীয়স্বজন ও অন্য ড্রাইভাররা বসবাস করে। এদের অধিকাংশই গাড়ি চুরি ও ছিনতাইয়ের সঙ্গে জড়িত।’

আরও পড়ুন

যেভাবে আসল অস্ত্র উদ্ধার

এ নিয়ে সফিক উল্লাহ আরও লিখেছেন, ‘সোর্সের দেওয়া তথ্যমতে ওই বস্তি থেকে টুইন্যা নামের এক ড্রাইভারকে গ্রেপ্তার করা হয়। জিজ্ঞাসাবাদের একপর্যায়ে সে এবং তার সহযোগীরা গাড়ি চুরি করে ওই গাড়ি দিয়ে ছিনতাই করেছে বলে স্বীকার করে। সে এ দলের সঙ্গে জড়িত ৫ জনের নামও বলে। তার কাছ থেকে জানা যায় সে এবং তার সঙ্গীরাই গাড়ি ছিনতাই করে গুলশানে মাহিয়া ইসলামকে ছুরিকাঘাত করে তার গলার হার ছিনিয়ে নিয়েছে।

জিজ্ঞাসাবাদে ওই ড্রাইভার স্বীকার করে সে কয়েকটি ছিনতাইকারী গ্রুপের সঙ্গে কাজ করে এবং তারাই একটি গাড়ি দিয়ে ছিনতাই করতে গিয়ে কল্যাণপুরে ডিবির অফিসারদের কাছ থেকে দুটি স্টেনগান নিয়ে গেছে। ড্রাইভার জানায়, ছিনতাইকারীদের একজন মগবাজারে থাকে। পুলিশের খোয়া যাওয়া একটি স্টেনগান আছে তার কাছে। আর অন্যটি আছে ভাসানটেকে আরেক ছিনতাইকারীর কাছে।

ড্রাইভারের দেওয়া ঠিকানা অনুযায়ী মগবাজার থেকে খোয়া যাওয়া স্টেনগানসহ একজনকে গ্রেপ্তার করা হয়। অপর স্টেনগানটি উদ্ধার করার জন্য আমি স্বয়ং এসি আকরামকে সঙ্গে নিয়ে যাই ভাসানটেকে। ভাসানটেকে ডোবার পাশে এক বস্তি ঘরে থাকে ওই ছিনতাইকারী। ডোবাটি কচুরিপানায় ভরা। ছিনতাইকারী আমাদের উপস্থিতি টের পেয়ে স্টেনগানসহ ডোবায় ঝাঁপ দেয়। সঙ্গে সঙ্গে আকরামের ড্রাইভারও ঝাঁপ দেয়। ডাকাতকে ধরে ফেলে সে। একপর্যায়ে ডাকাত স্টেনগান ফেলে ড্রাইভারের গলা চেপে ধরে মেরে ফেলার অবস্থা করে। এসি আকরাম তখন তার রিভলবার থেকে কয়েক রাউন্ড ফাঁকা গুলি করে। এতে ছিনতাইকারী তার গলা ছেড়ে দেয়। ড্রাইভার তখন স্টেনগানসহ ডোবা থেকে তাকে ধরে নিয়ে ওপরে ওঠে।’

সবশেষে তিনি লিখেছেন, ‘এক মামলায় তদন্ত করতে গিয়ে সফলতা আসে দুই মামলার। অস্ত্র উদ্ধারে দুঃসাহসিক কাজের জন্য আকরামের ড্রাইভারকে বিপিএম পুরস্কারের জন্য সুপারিশ করেছিলাম। তাকে ওই পুরস্কারে ভূষিত করা হয়। পরে আইজিপি, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশ কমিশনার সকলকে প্রথম দুটি স্টেনগান উদ্ধারের প্রেক্ষাপট ও পরে আসল স্টেনগান উদ্ধারের ঘটনা সবিস্তার জানাই।’