ডিবির ব্যস্ততায় ‘থেমে গেছে’ কলকাতায় আনোয়ারুল হত্যাকাণ্ড তদন্ত

আইনশৃঙ্খলার বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় মামলাটি পিবিআইয়ের কাছে হস্তান্তরের জন্য পুলিশ সদর দপ্তরে আবেদন করা হতে পারে।

আনোয়ারুল আজীমফাইল ছবি

ভারতের কলকাতায় বাংলাদেশের সাবেক সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ঢাকায় করা মামলার তদন্ত কার্যত থেমে আছে। মামলার তদন্তের দায়িত্বে থাকা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের (ডিবি) একাধিক সূত্র বলছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণে তাদের ব্যস্ততা আগের চেয়ে অনেক বেড়েছে। এর ফলে আনোয়ারুল হত্যা মামলার তদন্ত কিছুটা গতি হারিয়েছে।

এ মামলাটি তদন্তের ক্ষেত্রে এর আগে পাওয়া তথ্যগুলো আরও যাচাই-বাছাই করা দরকার বলে মনে করেন ডিবির একাধিক কর্মকর্তা। তাঁরা বলছেন, বিগত সরকারের সময় এই হত্যাকাণ্ড নিয়ে রাজনৈতিক কারণে কিছু ক্ষেত্রে হয়তো প্রকৃত ঘটনা পাশ কাটানোর চেষ্টা হয়েছিল। বিশেষ করে আত্মগোপনে থাকা ডিবির তৎকালীন অতিরিক্ত কমিশনার মোহাম্মদ হারুন অর রশীদ এই মামলার তদন্ত নিয়ে বিভিন্ন সময়ে স্ববিরোধী বক্তব্য দিয়েছিলেন।

আরও পড়ুন
কলকাতার নিউ টাউনের অভিজাত আবাসিক এলাকা সঞ্জিভা গার্ডেনসের একটি ফ্ল্যাটে ওঠার পর আনোয়ারুল আজীমকে হত্যা করা হয়। ওই ভবনের সেপটিক ট্যাংকে তল্লাশি চালিয়ে দেহের খণ্ডিত অংশ উদ্ধার করেছেন তদন্তকারীরা
ছবি: প্রথম আলো

গত বছরের ১৩ মে ভারতের কলকাতার নিউটাউনের একটি ফ্ল্যাটে খুন হন ঝিনাইদহ-৪ আসনের তৎকালীন সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম। আলোচিত এই হত্যাকাণ্ডে ঢাকা ও কলকাতায় গ্রেপ্তার হওয়া ব্যক্তিরা পুলিশকে তখন বলেছিলেন, আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম গত বছরের ১২ মে কলকাতায় যান। পরে তাঁকে ফাঁদে ফেলে ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যার আলামত মুছে ফেলতে তাঁর মরদেহ টুকরা টুকরা করে বিভিন্ন স্থানে ফেলা হয়।

এই দ্বন্দ্বের জেরে আনোয়ারুলকে হত্যার জন্য পাঁচ কোটি টাকায় আক্তারুজ্জামান খুনি ভাড়া করেছিলেন বলে জানায় ডিবি পুলিশ। হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নে মূল ভূমিকা রাখেন খুলনা অঞ্চলের একসময়ের দুর্ধর্ষ চরমপন্থী নেতা শিমুল ভূঁইয়া। তিনিই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া বাকিদের সঙ্গে পুরো বিষয়টি সমন্বয় করেন।

গ্রেপ্তার হওয়া আসামিদের তথ্য অনুযায়ী, আনোয়ারুল আজীমের লাশের খণ্ডিত অংশ উদ্ধারে কলকাতার দক্ষিণ চব্বিশ পরগনার ভাঙরের একটি খালে কয়েক দফা তল্লাশি চালানো হয়। তখন কিছু হাড়গোড় উদ্ধার হয়। এরপর গত বছরের ২৮ মে কলকাতার নিউটাউন এলাকার আবাসিক ভবন সঞ্জিভা গার্ডেনসের (এ ভবনের একটি ফ্ল্যাটে খুন হন আনোয়ারুল) সেপটিক ট্যাংক থেকে উদ্ধার করা হয় কিছু মাংসের টুকরা। পরে হাড়গোড় ও মাংসের টুকরার ডিএনএ নমুনা পরীক্ষা করা হয় কলকাতার সেন্ট্রাল ফরেনসিক সায়েন্স ল্যাবরেটরিতে। আনোয়ারুলের মেয়ে মুমতারিন ফেরদৌস (ডরিন) গত নভেম্বরে সেখানে ডিএনএন নমুনা দিয়ে আসেন। পরে দুটি নমুনা বিশ্লেষণের পর ভারতীয় তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্র গত ডিসেম্বরে নিশ্চিত হয়, উদ্ধার হওয়া দেহাবশেষগুলো আনোয়ারুলের।

আরও পড়ুন
কলকাতার যে ফ্ল্যাটে আনোয়ারুল আজীমকে হত্যা করা হয়েছে, সেই ফ্ল্যাটের বাইরে সিসি ক্যামেরা ধরা পড়া এই ফুটেজ সংগ্রহ করেছে কলকাতা পুলিশ
ছবি: ভিডিও থেকে নেওয়া

ডিবির তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, হত্যার কমপক্ষে এক মাস আগে আনোয়ারুলকে খুনের পরিকল্পনা করা হয়। খুনের ঘটনায় জড়িতদের মধ্যে অন্তত তিনজন ঘটনার ১৩ দিন আগে বাংলাদেশ থেকে ভারতের কলকাতা যান। এরও আগে থেকে আরও দুজন সেখানে অবস্থান করছিলেন। পরে কলকাতার নিউটাউনের ভাড়া করা একটি ফ্ল্যাটে ডেকে নিয়ে খুন করা হয় আনোয়ারুলকে।

ডিবির যুগ্ম কমিশনার (প্রশাসন ও গোয়েন্দা—দক্ষিণ) মোহাম্মদ নাসিরুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে মামলাটি আমরা নতুনভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করছি। এ ক্ষেত্রে মেডিকেল রিপোর্ট, পারিপার্শ্বিক প্রমাণাদি ও সাক্ষীদের বক্তব্য যাচাই-বাছাই করছি।’

আওয়ামী লীগের তৎকালীন সংসদ সদস্য আনোয়ারুল আজীম গত বছরের ১২ মে কলকাতায় যান। পরে তাঁকে ফাঁদে ফেলে ওই ফ্ল্যাটে নিয়ে হত্যা করা হয়। হত্যার আলামত মুছে ফেলতে তাঁর মরদেহ টুকরা টুকরা করে বিভিন্ন স্থানে ফেলা হয়।

তবে আইনশৃঙ্খলার বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায় মামলাটির তদন্তের দায়িত্ব পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) কাছে হস্তান্তরের জন্য পুলিশ সদর দপ্তরে আবেদন করার বিষয়টিও আলোচনায় রয়েছে বলে জানায় ডিবির একাধিক সূত্র।

আনোয়ারুল হত্যার ঘটনায় ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের দুই নেতাসহ বাংলাদেশে এ পর্যন্ত সাতজনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। এর বাইরে কলকাতা ও নেপালে গ্রেপ্তার হয়েছেন আরও দুজন। এ মামলার তদন্ত নিয়ে কলকাতার পুলিশের সঙ্গে কয়েক দফা আলোচনা করেছেন ডিবি পুলিশের তদন্তসংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। দুই দেশের আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদ ও ঘটনাটি সম্পর্কে পাওয়া তথ্য যাচাইয়ে ডিবির তদন্ত দল কলকাতার পাশাপাশি নেপালেও গিয়েছিল। কলকাতার তদন্তসংশ্লিষ্ট দলও ঢাকায় এসেছিল।

তদন্তসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, সোনা চোরাচালান নিয়ে দ্বন্দ্বের কারণেই হত্যা করা হয়েছে আনোয়ারুলকে। এই হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ঝিনাইদহের কোটচাঁদপুর পৌরসভার তৎকালীন মেয়র সহিদুজ্জামানের ভাই যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী মো. আক্তারুজ্জামান ওরফে শাহীন।

এই দ্বন্দ্বের জেরে আনোয়ারুলকে হত্যার জন্য পাঁচ কোটি টাকায় আক্তারুজ্জামান খুনি ভাড়া করেছিলেন বলে জানায় ডিবি পুলিশ। হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নে মূল ভূমিকা রাখেন খুলনা অঞ্চলের একসময়ের দুর্ধর্ষ চরমপন্থী নেতা শিমুল ভূঁইয়া। তিনিই হত্যাকাণ্ডে অংশ নেওয়া বাকিদের সঙ্গে পুরো বিষয়টি সমন্বয় করেন। গ্রেপ্তারের পর তাঁকে জিজ্ঞাসাবাদেই এ ঘটনায় ঝিনাইদহ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সাইদুল করিমসহ আরও এক নেতার নাম আসে।

ডিবি সূত্র বলছে, আনোয়ারুল আজীম খুন হওয়ার পর খুনের মূল পরিকল্পনাকারী আক্তারুজ্জামান গত ২০ মে ঢাকা থেকে দিল্লি যান। পরে সেখান থেকে নেপালের কাঠমান্ডু যান। এরপর দুবাই হয়ে চলে যান যুক্তরাষ্ট্রে। তবে তাঁকে ফেরাতে এখন আর কোনো অগ্রগতি নেই। এমনকি তাঁর বিরুদ্ধে এখনো ইন্টারপোলের ‘রেড নোটিশ’ জারি করা হয়নি।