অনিয়মের শাস্তি কেবলই বদলি

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১০টি তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, কারা কর্মকর্তা-কমর্চারীদের বিরুদ্ধে প্রতিবেদন দিলেও তা আমলে নেওয়া হয় না।

কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার

কারাগারের অনিয়ম ও দুর্নীতির তদন্ত করে অপরাধীদের চিহ্নিত করা হলেও শাস্তি হয় হাতেগোনা। তদন্তে কঠোর শাস্তির সুপারিশ করা হলেও বেশির ভাগ দোষীকে সতর্ক করে দেওয়া হয় মাত্র। অবশ্য কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের কম গুরুত্বপূর্ণ কারাগারে বদলি করা হয়। কয়েক মাস না যেতেই প্রভাব খাটিয়ে তারা ফিরে আসেন গুরুত্বপূর্ণ পদে।

সম্প্রতি কারাগারের ভেতরে তৈরি করা মই বেয়ে এক আসামি পালিয়ে যান। এরপরই রাজধানীর একটি হাসপাতাল থেকে আরেক কয়েদি পালান। এসব ঘটনায় ১ ও ৩ সেপ্টেম্বর স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তারা ৬৪ কারাগারের জেল সুপারদের সঙ্গে অনলাইনে বৈঠক করেন। বৈঠকে হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলা হয়, এমন ঘটনা ঘটতে থাকলে তাঁরা আইনানুগ ব্যবস্থা নিতে বাধ্য হবেন।

অপরাধভেদে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। একজন অপরাধীকে বদলি করে দিলে তিনি আরেক কারাগারে গিয়ে একই অপরাধ করবেন।
শাহদীন মালিক, আইনজীবী
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের অন্তত ১০টি তদন্ত প্রতিবেদন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে, মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বিভিন্ন সময় কারাগারের কর্মকর্তা–কর্মচারীদের বিরুদ্ধে অভিযোগ পেয়ে তদন্ত করে প্রতিবেদন দিলেও তা আমলে নেওয়া হয়নি। বাস্তবায়ন করা হয়নি সুপারিশও। বরং তদন্ত প্রতিবেদন ও তদন্ত করার প্রক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিষয়টিকে হেলাফেলা করা হয়েছে।

সর্বশেষ কারাগারের ভেতরে তৈরি করা মই বেয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামির পালানোর পর তদন্ত কমিটি প্রতিবেদন দিয়েছে। সেই প্রতিবেদনের সুপারিশ বাস্তবায়নে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে গত ২৭ আগস্ট চিঠি দেওয়া হয়েছে। সেই চিঠিতে কারাগারের জ্যেষ্ঠ জেল সুপার জাহানারা বেগম, জেলার বাহারুল ইসলাম, পাঁচ ডেপুটি জেলারসহ মোট ২১ জনকে কেন্দ্রীয় কারাগার থেকে অব্যাহতি দেওয়ার কথা বলা হয়েছে।

আমি তাঁদের সব সময়ই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিই। অপরাধ করলে শাস্তি পাবে, সেটাই তো নিয়ম। এ নিয়ে কেন তাঁরা এতে বাহানা করেন, বোধগম্য নয়। তবে এবার আমি দেখছি, কী করে ব্যবস্থা না নেন। যাঁরা ব্যবস্থা না নেবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে
আসাদুজ্জামান খান, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী

স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান প্রথম আলোকে বলেন, ‘আমি তাঁদের সব সময়ই শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে নির্দেশ দিই। অপরাধ করলে শাস্তি পাবে, সেটাই তো নিয়ম। এ নিয়ে কেন তাঁরা এতে বাহানা করেন, বোধগম্য নয়। তবে এবার আমি দেখছি, কী করে ব্যবস্থা না নেন। যাঁরা ব্যবস্থা না নেবেন, তাঁদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, কাশিমপুরের আগে কুমিল্লা কারাগারে জেল সুপারের দায়িত্বে ছিলেন জাহানারা বেগম। ওই কারাগারের অনিয়ম নিয়ে অভিযোগ ওঠার পর মন্ত্রণালয়ের উপসচিব মনিরুজ্জামান তদন্ত করে জেল সুপারসহ অন্য কর্মকর্তাদের কম গুরুত্বপূর্ণ স্থানে বদলির সুপারিশ করেন এবং বিভাগীয় ব্যবস্থা নিতে বলেন। কিন্তু কারা কর্তৃপক্ষ জেল সুপারকে শুধু সতর্ক করে দিয়ে দেশের সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ কারাগার কাশিমপুর কেন্দ্রীয় কারাগার-২–এ বদলি করে।

চট্টগ্রামের কারাধ্যক্ষের দুর্নীতির তদন্ত করতে গিয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের তখনকার ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিক, জ্যেষ্ঠ জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিক, জ্যেষ্ঠ জেল সুপার ইকবাল কবির চৌধুরী, কারাধ্যক্ষ সোহেল রানা বিশ্বাস, ৭ উপকারাধ্যক্ষসহ ৪৯ কর্মকর্তা-কর্মচারীর দুর্নীতির সত্যতা পায়। ২০১৮ সালের ২৬ অক্টোবর চট্টগ্রাম কারাগারের কারাধ্যক্ষ সোহেল রানা বিশ্বাসকে ময়মনসিংহগামী ট্রেন থেকে ৪৪ লাখ ৪৩ হাজার টাকা, ২ কোটি ৫০ লাখ টাকার এফডিআর (স্থায়ী আমানত), ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার নগদ চেক, ১২ বোতল ফেনসিডিলসহ রেলওয়ে পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তিনি চট্টগ্রাম থেকে ময়মনসিংহে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। সোহেল রানার এই অর্থের বিষয়ে অনুসন্ধান করতে গিয়ে চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের ঘাটে ঘাটে দুর্নীতির খোঁজ পায় তদন্ত কমিটি। সুপারিশ করা হয় শাস্তির। এর মধ্যে জ্যেষ্ঠ জেল সুপার প্রশান্ত কুমার বণিককে বরিশালে বদলি করা হয়। আর ইকবাল কবির চৌধুরীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের দায়িত্ব দেওয়া হয়। নানা অভিযোগ ওঠায় গতকাল শুক্রবার তাঁকে রংপুর কেন্দ্রীয় কারাগারে বদলি করা হয়। অন্যদিকে ডিআইজি পার্থ গোপাল বণিককে ঘুষ নেওয়ার অভিযোগে তাঁর বাসা থেকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। তিনি এখন কারাগারে আছেন।

একাধিক তদন্ত প্রতিবেদনের পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, কারাগারে সব ক্ষেত্রেই অনিয়ম-দুর্নীতি রয়েছে। বন্দীর প্রবেশ-বের হওয়া—কোনো কিছুই টাকা ছাড়া হয় না। টাকা দিলে সেখানে অনিয়মকে নিয়মে পরিণত করা যায়। আর এই অনিয়ম-দুর্নীতি বন্ধ না হওয়ার অন্যতম কারণ ‘ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের আশ্রয়-প্রশ্রয়’।

এসব বিষয়ে জানতে চাইলে আইনজীবী শাহদীন মালিক প্রথম আলোকে বলেন, শুধু বদলি বা বিভাগীয় ব্যবস্থা নিলে বা এক বছরের বেতন কমিয়ে দিলে তাঁরা বারবার একই অপরাধ করতে পারবেন। অপরাধভেদে প্রত্যেকের বিরুদ্ধে ফৌজদারি ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। একজন অপরাধীকে বদলি করে দিলে তিনি আরেক কারাগারে গিয়ে একই অপরাধ করবেন।