অপরাধীদের ফাঁদ আরও বিস্তৃত

  • গত বছরের মার্চ-সেপ্টেম্বরে মামলা হয়েছে ১,১৩৫টি, আগের বছরের চেয়ে ২৯% বেশি।

  • মামলা বেশি ডিজিটাল অর্থ লেনদেনে ও যৌন হয়রানির অভিযোগে।

প্রতীকী
ছবি: রয়টার্স

করোনা মহামারির শুরু থেকে সাইবার অপরাধ বেড়েছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছে মুঠোফোনকেন্দ্রিক অর্থ লেনদেন ও যৌন হয়রানি নিয়ে। পুলিশ ও অপরাধ বিজ্ঞানীরা বলছেন, করোনা মহামারির মধ্যে সরকারি-বেসরকারি দাপ্তরিক কাজ, ব্যবসা-বাণিজ্যের লেনদেন, কেনাকাটার মতো কাজগুলো করতে হয়েছে অনলাইনে। এই সময়ে মানুষ প্রযুক্তিমুখী হয়েছে, ফলে বেড়েছে ইন্টারনেটের ব্যবহার। আর এই সুযোগটাই কাজে লাগিয়েছে সুযোগসন্ধানীরা। তারা ফাঁদ পেতেছে সাইবারজগতে। হাতিয়ে নিয়েছে অর্থ, ফেলেছে বিপদে।

দেশে প্রথম করোনা শনাক্ত হয় গত বছরের ৮ মার্চ। পুলিশ সদর দপ্তর ও ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) সূত্র জানায়, গত বছরের মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সারা দেশে সাইবার অপরাধের অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন, পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ, টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে ১ হাজার ১৩৫টি মামলা হয়েছে। ২০১৯ সালের একই সময়ে একই ধরনের অভিযোগে মামলা হয় ৮৭৯টি। অর্থাৎ করোনাকালের ওই ৯ মাসে আগের বছরের তুলনায় মামলা বেড়েছে ২৫৬টি। বৃদ্ধির হার ২৯ শতাংশ।

ঘরবন্দী মানুষ প্রয়োজনের তাগিদে ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়িয়েছে। অন্যদিক সাইবার অপরাধীদের জালও বিস্তৃত হয়েছে।

আর রাজধানীতে গত মার্চ থেকে নভেম্বর পর্যন্ত সাইবার অপরাধের অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা ও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে ২৫৬টি মামলা হয়। এর মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা ১৯১ ও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে ৬৫টি মামলা। আগের বছর এই সময় একই আইনে ২৩৬টি মামলা হয়। অর্থাৎ মামলা বেড়েছে ২০টি বা সাড়ে ৮ শতাংশ।

সারা দেশে মার্চ থেকে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সাত মাসে যে ১ হাজার ১৩৫টি মামলা হয়, তার মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৭৬৬টি ও পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে ৩৬৩টি মামলা হয়। বাকি ছয়টি মামলা হয় টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে। অবশ্য যতটি অভিযোগ মামলা আকারে নথিবদ্ধ হয় প্রকৃত অভিযোগ তাঁর থেকে আরও অনেক বেশি। গত বছরের মার্চ থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত রাজধানীসহ সারা দেশ থেকে পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) সাইবার পুলিশ সেন্টারে (সিপিসি) সাইবার অপরাধসংক্রান্ত অভিযোগ এসেছে ৩৩ হাজার ৭৯টি।

সিআইডি সূত্র জানায়, সিপিসির ফেসবুক পেজ ও ফোনে সাইবার অপরাধসংক্রান্ত বেশির ভাগ অভিযোগ আসে। বাকি অভিযোগ ইমোতে, সিপিসির ই-মেইলে, আবার ভুক্তভোগী সিআইডি কার্যালয়ে সশরীর এসে দিচ্ছেন।

ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইমের (সিটিটিসি) সাইবার অপরাধ তদন্ত বিভাগের উপকমিশনার এ এফ এম আল কিবরিয়া প্রথম আলোকে বলেন, করোনার সময় সব মানুষ ছিল ঘরমুখী। তাই ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীলতা অনেক বেড়ে যায়। এ সময় অনলাইনে প্রতারণাসহ সাইবার অপরাধও বেড়েছে।

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপরাধের মধ্যে রয়েছে মোবাইল ব্যাংকিং প্রতারণা, ফোনে উত্ত্যক্ত, অনলাইনে কেনাকাটায় প্রতারণা, বিদেশি মুদ্রা বেচাকেনায় অনলাইন প্রতারণা, এমএলএম কোম্পানির নামে অনলাইন প্রতারণা, চাকরি দেওয়ার নামে প্রতারণা, এনজিও ও মানবাধিকার সংগঠনের নামে প্রতারণা। আরও আছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে বন্ধু সেজে বিদেশ থেকে উপহার পাঠানোর নামে টাকা হাতিয়ে নেওয়া, বিদেশে জনশক্তি পাঠানোর নামে অনলাইন প্রতারণা ও অনলাইনে প্রভাবশালী ব্যক্তির নাম করে প্রতারণার অভিযোগ। পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের অভিযোগগুলোর মধ্যে আছে ব্যক্তিগত মুহূর্তের ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়, ব্ল্যাকমেলিং, যৌন হয়রানিসহ নানা ধরনের হয়রানি।

সিপিসির বিশেষ পুলিশ সুপার এস এম আশরাফুল আলম প্রথম আলোকে বলেন, মোবাইল ব্যাংকিং ও অনলাইনে কেনাকাটায় প্রতারণা ও যৌন হয়রানিসংক্রান্ত অভিযোগই বেশি আসছে। সাইবার অপরাধের সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছেন নারীরা। অনলাইনে প্রায়ই নানা হয়রানির মুখে পড়ছেন তাঁরা। সিপিসিতে আসা অভিযোগগুলো তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।

গত বছরের ২৪ ডিসেম্বর রাজধানীর মোহাম্মদপুরে মুঠোফোনে অর্থ লেনদেনসংক্রান্ত প্রতারণার অভিযোগে শিমুল মিয়া (২৯), শাহিন মাতুব্বর (২৮) ও মহিদুল (২৬) নামের তিন যুবককে গ্রেপ্তার করে পুলিশ। পুলিশ জানায়, এ ধরনের চক্র প্রতারণার জন্য চারটি গ্রুপে ভাগ হয়ে কাজ করে। প্রথম গ্রুপটি টাকা পাঠানো বা তোলার নাম করে কোনো দোকানে অবস্থান নেয়। এ সময় কৌশলে দোকানের লেনদেনের খাতার ছবি তুলে নেয় তারা। এতে থাকে গ্রাহকের তথ্য। তারা ওই ছবি হোয়াটসঅ্যাপে দ্বিতীয় গ্রুপের কাছে পাঠিয়ে দেয়। দ্বিতীয় গ্রুপ অর্থ লেনদেনকারী এজেন্ট দোকানদার সেজে ফোন করে টাকা গেছে কি না এবং সেই টাকা ক্যাশ আউট করেছেন কি না—জানতে চায়। টাকা ক্যাশ আউট না করলে ফাঁদ পাতে তারা। গ্রাহককে বলে, দোকান থেকে একই সময়ে কয়েকটি নম্বরে পাঠানো টাকা নিয়ে অভিযোগ আসায় তাদের নম্বর লক করতে গিয়ে ‘আপনার’ নম্বরও লক হয়ে গেছে। ‘আপনাকে’ সংশ্লিষ্ট মুঠোফোনে আর্থিক সেবাদাতা অফিস থেকে ফোন করে আনলক করে দেবে। এরপরই তৃতীয় গ্রুপ কাস্টমার কেয়ার সার্ভিস অফিসার পরিচয় দিয়ে অনলাইনভিত্তিক বিভিন্ন অ্যাপসের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট অফিসের নম্বর ক্লোন করে ফোন দেয়। কৌশলে অ্যাপের পিন নম্বর নিয়ে নেয়। সর্বশেষ চতুর্থ গ্রুপ এই পিনকোর্ড দিয়ে তার মুঠোফোনে টাকা নিয়ে নেয়।

করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতিতে মানুষের প্রশান্তি ও বিনোদনমূলক কার্যক্রমের জায়গাগুলো সীমিত হয়ে গেছে। আবার প্রয়োজনের তাগিদে ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। ফেসবুক ও অনলাইন মনিটরিংয়ের জন্য সরকারের যথাযথ নজরদারি করতে হবে। না হলে অপরাধ বাড়তে থাকবে।
অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা রহমান, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান

২০১৯ সালে সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (সিসিএ ফাউন্ডেশন) একটি গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ করেছিল। এতে বলা হয়, দেশে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের সঙ্গে সমান্তরাল হারে বাড়ছে সাইবার অপরাধ। কৃষক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক পর্যন্ত সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ ইন্টারনেট নেটওয়ার্কে যুক্ত হচ্ছেন। ইন্টারনেটের মাধ্যমে একটি ভার্চ্যুয়াল জগতের বাসিন্দা হলেও এর ঝুঁকি সম্পর্কে এঁদের সিংহভাগই সচেতন নন। অসতর্কতায় জড়িয়ে পড়েন প্রতারণার ফাঁদে।

সাইবার অপরাধের শিকার হওয়া ব্যক্তিরা যেন পুলিশের সঙ্গে বিশেষ করে ডিএমপি, জাতীয় জরুরি সেবা ‘৯৯৯’, ও সিআইডিতে যোগাযোগ করেন সে অনুরোধ সিপিসির। এ ছাড়া নারীদের জন্য পুলিশ সদর দপ্তরে সেল খোলা হয়েছে, কেউ যৌন হয়রানির শিকার হলে সেখানে অভিযোগ জানাতে পারে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অপরাধবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক খন্দকার ফারজানা রহমান প্রথম আলোকে বলেন, করোনার সংক্রমণ পরিস্থিতিতে মানুষের প্রশান্তি ও বিনোদনমূলক কার্যক্রমের জায়গাগুলো সীমিত হয়ে গেছে। আবার প্রয়োজনের তাগিদে ইন্টারনেটের ওপর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। ফেসবুক ও অনলাইন মনিটরিংয়ের জন্য সরকারের যথাযথ নজরদারি করতে হবে। না হলে অপরাধ বাড়তে থাকবে।