অফশোর ব্যাংকিংয়ের আড়ালে ৩৪০ কোটি টাকা পাচার

.
.

বেসরকারি খাতের এবি ব্যাংকের অফশোর ইউনিটের মাধ্যমে অর্থ পাচার করা হয়েছে। অফশোর ইউনিট থেকে চার বিদেশি কোম্পানির নামে ৪ কোটি ২৫ লাখ ৪০ হাজার ডলার (বাংলাদেশি টাকায় ৩৪০ কোটি) বের করে নেওয়া হয়েছে।
যে উদ্দেশ্যে এসব ঋণ নেওয়া হয়েছিল, তার কোনোটাই ব্যবহৃত হয়নি। ঋণের অর্থ অন্য হিসাবে পাচার করা হয়েছে। এর সঙ্গে সাবেক একজন মন্ত্রীর নাম এসেছে। অর্থ পাচার হয়েছে সিঙ্গাপুর ও সংযুক্ত আরব আমিরাতে। বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
প্রতিষ্ঠান চারটি হলো সংযুক্ত আরব আমিরাতের গ্লোবাল এমই জেনারেল ট্রেডিং ও সেমাট সিটি জেনারেল ট্রেডিং, সিঙ্গাপুরের এটিজেড কমিউনিকেশনস পিটিই লিমিটেড ও ইউরোকারস হোল্ডিংস পিটিই লিমিটেড। এ ঋণের অন্যতম সুবিধাভোগী সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খানের মালিকানাধীন প্যাসিফিক মোটরস। তিনি এবি ব্যাংকেরও সাবেক চেয়ারম্যান।
টাকার অঙ্কে দেশে ব্যাংক খাতে এর আগে আরও বড় ধরনের জালিয়াতি হলেও অফশোর ব্যাংকিং ইউনিটে এটাই বড় ঘটনা। অফশোর ব্যাংকিং হলো ব্যাংকের অভ্যন্তরে পৃথক ব্যাংকিং। বিদেশি কোম্পানিকে ঋণ প্রদান ও বিদেশি উৎস থেকে আমানত সংগ্রহের সুযোগ রয়েছে অফশোর ব্যাংকিংয়ে। স্থানীয় মুদ্রার পরিবর্তে বৈদেশিক মুদ্রায় হিসাব হয় অফশোর ব্যাংকিংয়ে। ব্যাংকের কোনো নিয়ম-নীতিমালা অফশোর ব্যাংকিংয়ে প্রয়োগ হয় না। কেবল মুনাফা ও লোকসানের হিসাব যোগ হয় ব্যাংকের মূল হিসাবে।
বিশ্বব্যাপী অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ পাচারের বিষয়টি এখন ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে। ‘পানামা পেপারস’ নামে অর্থ পাচারের যে ঘটনা ফাঁস করা হয়েছে, তা মূলত অফশোর ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমেই ঘটেছে। বিশ্বব্যাপী আলোচনা পরিচিতি পেয়েছে। বাংলাদেশ থেকেও একই পন্থায় অর্থ পাচারের ঘটনা জানা গেল।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন, অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে বিদেশি প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহজেই ঋণ দেওয়া হচ্ছে। যেসব প্রতিষ্ঠান ঋণ নিচ্ছে তাদের অস্তিত্ব আছে কি না, তা দেখার কোনো ব্যবস্থা নেই। এ কারণে বাংলাদেশিরাই কাগুজে কোম্পানি তৈরি করে ঋণসুবিধা নিচ্ছেন। অর্থ লোপাটের নতুন পন্থা হিসেবে অফশোর ব্যাংকিংকে বেছে নেওয়া হচ্ছে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের বিশেষ পরিদর্শনে এসব অনিয়ম বেরিয়ে আসার পর আগামী ৩১ মের মধ্যে এবি ব্যাংককে অর্থ ফেরত আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। অর্থ ফেরত না দিলে ৩০ জুনের মধ্যে ক্ষতিজনক মানে খেলাপি করার নির্দেশ দিয়েছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে এ-সংক্রান্ত নির্দেশনা পেয়েছে এবি ব্যাংক।
চারটি প্রতিষ্ঠানকে ঋণসুবিধা দেওয়া হয়েছিল প্রায় ৪৫০ কোটি টাকার। এর মধ্যে ৩৪০ কোটি টাকা পাচার হয়েছে বলে কেন্দ্রীয় ব্যাংক পরিদর্শন দল চিহ্নিত করেছে। এই অর্থ ফেরত আনার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে এবি ব্যাংকের বক্তব্য জানতে প্রথম আলোর পক্ষ থেকে লিখিত প্রশ্ন দেওয়া হয়। পরে ব্যাংকের পক্ষ থেকে লিখিতভাবে জানানো হয়, ‘এবি ব্যাংক অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নির্দেশনা সম্পর্কে অবগত আছে। আমরা বিষয়টি পর্যালোচনা করছি। এবি ব্যাংক উল্লিখিত ঋণ আদায় করার যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করছে।’
যোগাযোগ করা হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের ডেপুটি গভর্নর আবু হেনা মোহা. রাজী হাসান প্রথম আলোকে বলেন, অনিয়ম ধরা পড়ায় এবি ব্যাংককে কয়েকটি নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এ জন্য সময়ও বেঁধে দেওয়া হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে নির্দেশনা পরিপালন না করলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
ভুয়া আদেশে ঋণ: অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের প্রতিষ্ঠান সিমাট সিটি জেনারেল ট্রেডিংকে ২ কোটি ৯৫ লাখ ডলার (২৩৬ কোটি টাকা) ঋণসুবিধা দেওয়া হয়। নেপালের সড়ক নির্মাণ প্রতিষ্ঠান কেটিএন এনার্জি প্রাইভেট লিমিটেডকে বিটুমিন সরবরাহ আদেশের বিপরীতেই এ ঋণ দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের ২৯ জুন থেকে ২৯ ডিসেম্বর সময়ে এসব ঋণ বিতরণ করা হয়। কিন্তু ঋণের কোনো কিস্তি পরিশোধ হয়নি। এ ছাড়া বিটুমিন সরবরাহ হয়েছে কি না, সে বিষয়েও ব্যাংকে কোনো নথি নেই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংক এ বিষয়ে এবি ব্যাংককে জানিয়েছে, সরবরাহ আদেশ ভুয়া বলে পরিদর্শক দলের কাছে মনে হয়েছে। ঋণটি বাংলাদেশি স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো প্রতিষ্ঠানে স্থানান্তর করা হয়েছে। এ ঋণ আদায়ের সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
যেভাবে সুবিধাভোগী মোরশেদ খান: অফশোর ইউনিট থেকে সিঙ্গাপুরের ইউরোকারস হোল্ডিংস পিটিই লিমিটেডকে ১ কোটি ৪৮ লাখ ডলার (১১৮ কোটি ৪০ লাখ টাকা) ঋণসুবিধা দেওয়া হয়। অথচ প্রতিষ্ঠানটির পরিশোধিত মূলধন মাত্র ৩ মিলিয়ন সিঙ্গাপুর ডলার। ঋণের মঞ্জুরিপত্রে উল্লেখ করা হয়, বাংলাদেশি ক্রেতা প্রতিষ্ঠান মিলেনিয়াম ডিস্ট্রিবিউশন, মিলেনিয়াম মোটরস, মিলেনিয়াম চাং ইয়ং মোটরস, মেসার্স হুন্দাই মোটরস বাংলাদেশ লিমিটেড ও মেসার্স প্যাসিফিক মোটরসকে মোটরযান ও যন্ত্রাংশ সরবরাহের জন্য মূলধন হিসেবে এই ঋণ মঞ্জুর করা হয়। সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোরশেদ খানের মালিকানাধীন প্যাসিফিক মোটরস। বাকিগুলোও তাঁরই প্রতিষ্ঠান। মোরশেদ খান বর্তমানে দেশের বাইরে রয়েছেন।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলছে, ঋণপত্র খোলা হলেও এর বিপরীতে দেশে মালামাল আসেনি। আর খোলাই হয়েছে মাত্র ২০ লাখ ডলারের ঋণপত্র। বাকি অর্থ ব্যবহারের কোনো হিসাব নেই ব্যাংকের কাছে। পুরো ঋণই এখন মেয়াদোত্তীর্ণ হয়ে পড়েছে। প্রকৃতপক্ষে পণ্য আসার আগেই অর্থবিক্রেতা প্রতিষ্ঠানের নামে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে। মূলত ঋণের অর্থ বাংলাদেশি স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হিসাবে স্থানান্তর করা হয়েছে। ঋণটি আদায়ের সম্ভাবনা ক্ষীণ।
ভুয়া লেনদেন: বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠান লেভেল থ্রি ক্যারিয়ার লিমিটেডের ক্রয় আদেশের বিপরীতে সিঙ্গাপুরের এটিজেড কমিউনিকেশনস পিটিই লিমিটেডকে ১ কোটি ডলারের (৮০ কোটি টাকা) ঋণসুবিধা দেওয়া হয়। এটিজেড কমিউনিকেশনস সিঙ্গাপুরে কার্যক্রম শুরু করে ২০১৪ সালের ৭ মে। অফশোর ইউনিট থেকে প্রতিষ্ঠানটিকে একই বছরের ২৮ মে ঋণ বিতরণ করা হয়। ঋণ দেওয়ার জন্যই স্বল্প সময়ে কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে বলে ব্যাংক সূত্রে জানা গেছে।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সিঙ্গাপুরের এটিজেড কমিউনিকেশনস মূলত খেলনা ও গেমস বিক্রি করে থাকে। আর বাংলাদেশি লেভেল থ্রি ক্যারিয়ার মূলত আইএসপি সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান। ফলে এ দুই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে কোনো ধরনের কেনাকাটার প্রয়োজন নেই।
লেভেল থ্রি ক্যারিয়ারের বিপণন ও যোগাযোগ ব্যবস্থাপক খোরশেদ জামান প্রথম আলোকে বলেন, সিঙ্গাপুরের এটিজেড কমিউনিকেশনসের সঙ্গে তাঁদের কোনো ক্রয়-বিক্রয় সম্পর্ক নেই।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, লেভেল থ্রি ক্যারিয়ার প্রতিষ্ঠানটি নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এ ছাড়া ভুয়া সরবরাহ আদেশ ও ঋণের অর্থ ব্যবহার বিষয়ে তথ্য না থাকায় ঋণের আড়ালে বাংলাদেশি স্বার্থসংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের হিসাবে অর্থ স্থানান্তর করা হয়েছে। এ অর্থ আদায়ের সম্ভাবনাও ক্ষীণ।
অন্য দেশে ঋণ পরিশোধ: এবি ব্যাংকের অফশোর ব্যাংকিং ইউনিট থেকে সংযুক্ত আরব আমিরাতের গ্লোবাল এমই জেনারেল ট্রেডিংকে ব্যবসায়িক কার্যক্রম বাড়াতে ১৫ লাখ ডলার বা ১২ কোটি টাকার ঋণ দেওয়া হয়। প্রতিষ্ঠানটিতে বাংলাদেশের রহিমআফরোজ গ্লোবাল লিমিটেডের ৪৯ শতাংশ শেয়ার রয়েছে। ঋণের অর্থ স্থানান্তর হয় এবি ব্যাংকের মুম্বাই শাখার রহিমআফরোজ ব্যাটারির হিসাবে, যা দিয়ে রহিমআফরোজ ব্যাটারির ভারতের বিভিন্ন ঋণের দায় সমন্বয় করা হয়।
ঋণের মেয়াদ ২০১৫ সালের ২৫ মার্চ উত্তীর্ণ হয়। এই সময়ের মধ্যে ঋণের কোনো কিস্তি শোধ না হলেও এর ঋণের মেয়াদ আরও এক বছর বাড়ানো হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংক এবি ব্যাংককে দেওয়া চিঠিতে বলেছে, ঋণের অর্থ দিয়ে পরিচালন ব্যয়নির্বাহের অনুমোদন থাকলেও তা দিয়ে রহিমআফরোজ ব্যাটারির হিসাবে অর্থ স্থানান্তর হয়ে দায় সমন্বয় করা হয়েছে। এই ঋণ তদারকিতে ব্যাংকের গাফিলতি ছিল।
যোগাযোগ করা হলে রহিমআফরোজ গ্রুপের পরিচালক মনোয়ার এম মইন প্রথম আলোকে বলেন, ‘ভারতে আমাদের শাখা ও সহযোগী প্রতিষ্ঠান দুটিই রয়েছে। ভারতের আইনে মূল কোম্পানি থেকে অর্থ নিতে কোনো সমস্যা নেই। আমরা এবি ব্যাংকের অফশোর ইউনিট থেকে ঋণ নেওয়ার পর কিছুটা সময়ও বাড়িয়ে নিয়েছি। তবে এখন প্রশ্ন ওঠায় আমরা দ্রুত অর্থ পরিশোধ করে দেব।’