অবশেষে পি কের আদালত অবমাননা

প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার

হল-মার্ক, ডেসটিনি-কাণ্ডের পর দীর্ঘদিন এ রকম কাণ্ড সংবাদমাধ্যমে আসছিল না। প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার এসে সেই শূন্যতা পূরণ করলেন। তিনি অব্যাহতভাবে উচ্চ আদালত ও সংবাদ মাধ্যমের মনোযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে থাকছেন।

আমরা জেনেছিলাম, তিনি দেশে ফিরবেন, বিমানবন্দরে এসে নামবেন। এ সময় দেশের প্রচলিত আইন কী উপায়ে প্রয়োগ করা হবে, তারও একটা সম্ভাব্য চিত্র কল্পনা করতে পেরেছিলাম। মৃদু আশা ছিল, নিয়মকানুন পুরোপুরি মেনে না চলা গেলেও ‘নয়ছয়’ করা ‘কোটি কোটি টাকা’ ফেরতের বিষয়ে আমরা একটা শুনানি দেখব। তখন পি কে হালদার কী ব্যাখ্যা দেন, সেটা শোনার সৌভাগ্য আমাদের হবে, কিন্তু শেষ মুহূর্তে আশাভঙ্গের ঘটনাই ঘটল।

২৪ অক্টোবর সর্বশেষ জানা গেল, তিনি আপাতত আসছেন না। ২৩ অক্টোবর তাঁর সই করা মূল চিঠিটি দেখলাম। তিনি তাঁরই দখল করা একটি প্রতিষ্ঠানের এমডিকে লিখেছেন, ‘বাংলাদেশে পৌঁছার বিষয়ে ১৮ অক্টোবরে দেওয়া আমার চিঠির পরিপ্রেক্ষিতে হাইকোর্টের সর্বশেষ আদেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে পাইনি।’ একজন পলাতক আসামি বলছেন, তিনি তাঁর ‘স্বদেশ প্রত্যাবর্তন’-সংক্রান্ত হাইকোর্টের আদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে পাননি। আমরা তাঁর এই স্পর্ধায় বিস্মিত।

তাঁর তিনটি ছোট প্যারাগ্রাফের চিঠির প্রথম বাক্যটিতেই তিনি কোর্ট আদেশ না পাওয়ার দোহাই দিয়েছেন।

চিঠির পরের প্যারাগ্রাফে তিনি অবশ্য দাবি করেছেন, তাঁর শরীরে তিনি করোনার উপসর্গ টের পাচ্ছেন। তাই ২৫ অক্টোবর আসবেন না। তবে শারীরিকভাবে ফিট হলে ‘শিগগিরই’ তাঁর আগমনের নতুন তারিখ ও সময় জানাবেন। এই চিঠি আদালতে পেশ করা হবে।

প্রশ্ন হলো, আইনের চোখে তিনি পলাতক। আমাদের নবনিযুক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল আমিন উদ্দিন হাইকোর্টে যথার্থই বলেছেন, আইনের চোখে পলাতক ব্যক্তি বিচার বিভাগীয় প্রতিকার পাওয়ার অধিকারী নন। এটা শতাব্দীপ্রাচীন আইন ও রীতি। বিশ্বের সব দেশে এটা মানা হয়। একজন পলাতক আসামি হিসেবে পি কে হালদারকে প্রথমেই আত্মসমর্পণ করতে হবে, এখানে আদালতের সঙ্গে দেন-দরবারের কোনো সুযোগ নেই। আদালতের কাছ থেকে ‘আনুষ্ঠানিক আদেশ’ পাওয়ার প্রশ্ন এখানে অবান্তর। এক-এগারোতে ‘মিথ্যা মামলার’ দোহাই দিয়ে এই রীতি পাল্টানোর চেষ্টা চলেছিল। অবশ্য তখনো নিম্ন আদালতে আত্মসমর্পণ না করে উচ্চ আদালতে আত্মসমর্পণ করার প্রবণতাই মুখ্য ছিল। কিন্তু এখন তো পি কে হালদার প্রকারান্তরে বিদেশে পলাতক থাকা অবস্থায় তাঁর আগমনের আদেশ ‘আনুষ্ঠানিকভাবে’ হাতে নিয়ে ফেরার স্বপ্ন দেখছেন। এর আগে এ রকম অভিপ্রায় কেউ প্রকাশ করেছেন বলে আমাদের জানা নেই।

গত জানুয়ারিতে প্রথম আলোর এক অনুসন্ধানী প্রতিবেদনে বলা হয়েছিল, প্রশান্ত কুমার (পি কে) হালদার সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা নিয়ে চম্পট দেন। এর সঙ্গে আরও কয়েকজনের যুক্ততা রয়েছে। তাঁরা হলেন পি কে হালদারের আরেক ভাই প্রীতিশ কুমার হালদার, প্রীতিশের বউ সুস্মিতা সাহা ও পি কে হালদারের এক ঘনিষ্ঠ সহযোগী অবন্তিকা বড়াল। অভিযোগ হলো, তাঁরা কয়েকজন মিলেই এক অভিনব জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে একটির পর একটি নতুন কোম্পানির জন্ম দেন। উপকথার মতো। কার পেটে কার জন্ম, ডিএনএ টেস্ট ছাড়াই বোঝা যায়। এক কোম্পানির যা দায়, অন্য কোম্পানির কাছে তা-ই সম্পদ। এক কোম্পানি ক্রেতা, আরেক কোম্পানি বিক্রেতা। প্রয়াত অর্থমন্ত্রী সাইফুর রহমান সেই কবে সংসদে বলেছিলেন, ‘বাংলাদেশ রানস বাই দুই নম্বর খাতা।’ পি কে হালদার পরিবার সেই দুই নম্বর খাতা তৈরির সৃজনী শক্তিকে একটা ধ্রুপদি জায়গায় নিয়ে গিয়েছেন। কিন্তু তিনি ও তাঁর পরিবারের লোকজন বা ঘনিষ্ঠজনেরাই দায়ী নন। সরকারি প্রশাসনের যাঁরা ভুয়া কোম্পানি তৈরিতে সহায়তা দিয়েছেন, যাঁরা কোম্পানি দখলে সহায়তা ও অনুমোদন দিয়েছেন, তাঁরা তো পলাতক নন। তাঁরা চুনোপুঁটি, তাঁদের ধরা হোক। একটা চিত্র তুলে ধরি।

পি কে হালদার, তাঁর ভাই ও ভাইয়ের স্ত্রী এবং পি কে হালদারের ঘনিষ্ঠ সহযোগী অবন্তিকা বড়াল মিলে প্রথমে ‘সুখদা’ নামে একটি কোম্পানি করেন। এরপর ‘সুখদা’র শেয়ার দিয়ে খোলেন হাল ইন্টারন্যাশনাল। এই হালের পরিচালক হন প্রীতিশ ও তাঁর স্ত্রী সুস্মিতা। আবার এই হালের ৯০ ভাগ শেয়ারের মালিক হন সুখদার পক্ষে প্রশান্তের ঘনিষ্ঠ সহযোগী অবন্তিকা। এরপর প্রথম হালের মালিকানায় ২০১৬ সালে জন্ম নেয় হাল ক্যাপিটাল। কিন্তু হাল ক্যাপিটালের ৯০ ভাগ শেয়ারের মালিক থাকে হাল ইন্টারন্যাশনাল। বাকি ১০ ভাগ রাখা হয় হাল ক্যাপিটালের দুই কর্মচারীর নামে। এবার ওই তাঁরাই হাল ক্যাপিটালের নামে আগে থেকে বিদ্যমান মাইক্রোটেকনোলজি নামে একটি কোম্পানির শেয়ার কেনেন। এবার মাইক্রোটেকনোলজির নাম পাল্টে নতুন নামকরণ হয় হাল টেকনোলজি। মালিক তাঁরাই।

গত জুলাইয়ে জেনেছিলাম, হাইকোর্টের একটি ভার্চ্যুয়াল বেঞ্চে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ না করে বাংলাদেশ ব্যাংক এবং দুদকের মামলায় বিদেশে পলাতক থাকা প্রশান্ত কুমার হালদার প্রতিকার পেয়েছিলেন। ৯ জুলাই দেওয়া হাইকোর্টের আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করা হয় এবং আদেশটি স্থগিত হয়েছিল। এর চার মাসের কম সময়ের ব্যবধানে জানলাম, মি. হালদার আদালতের একটি আদেশের বাতাবরণে দেশে আসছেন। ভিন্ন মামলা, তবে আমরা স্মরণ করতে পারি যে এর আগে বিদেশে পলাতক থেকে আগাম জামিন চাওয়ার কারণে সিকদার গ্রুপের দুই ভাইকে ১০ হাজার পিপিই জরিমানা করা হয়েছিল।

অবশ্য আদালত গত জুলাইয়েই প্রশান্ত কুমার, অবন্তিকা বড়াল, ভাই, ভাইয়ের স্ত্রী-সংশ্লিষ্ট ৩১টি কোম্পানির কার্যক্রম স্থগিত করেছিলেন এবং আদালতই তারও আগে প্রশান্ত কুমারসহ বাকি তিনজনের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট জব্দের নির্দেশ দিয়েছিলেন।

প্রশ্ন হলো, পাওনাদারদের এখন কী হবে? একজন এমডি অসুস্থ হতে পারেন। তাতে পাওনাদারদের স্বার্থ বিঘ্নকারী কার্যক্রম তো অবশিষ্ট কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দ্বারা চলতে পারে না। যেমন হাইকোর্টে ভিন্ন মামলায় পি কেরই করা একটি দরখাস্তের দাবি: হাল টেকনোলজি ভালোই চলছিল। কিন্তু অন্যতম পরিচালক প্রশান্ত কুমার হালদারের বিরুদ্ধে দুদক মামলা করায় তিনি দেশত্যাগ করেন। এ জন্য ব্যবসা চালানোয় সমস্যা হচ্ছে। অথচ ওই সময় থেকেই তাঁর ভাই প্রীতিশ কুমার (হাল টেকনোলজির পরিচালক) এবং তাঁর স্ত্রী সুস্মিতাসহ হাল ক্যাপিটালের সবাই পলাতক। কিন্তু দরখাস্তে শুধু পি কে হালদারকেই পলাতক বলে স্বীকার করা হয়। অথচ পি কে হালদার কাগজে-কলমেও হাল টেকনোলজির চেয়ারম্যান ছিলেন না। কিন্তু তাঁকে পলাতক চেয়ারম্যান দেখিয়ে (৪ নম্বর বিবাদী করে) তাঁর শূন্য পদে একজন স্বাধীন চেয়ারম্যান নিয়োগের আবেদন করা হয়েছিল এবং হাইকোর্টের পৃথক একটি বেঞ্চ তা মঞ্জুর করেছিলেন। আপিল বিভাগ পরে তা স্থগিত করেন।

ওপরের পুরো চিত্রে দেখা যাচ্ছে পরতে পরতে আইনের মারপ্যাঁচ। এই প্যাঁচ থেকে কে কবে মুক্তি পাবেন, আমানতকারীরা কে কবে টাকা ফেরত পাবেন, তা কারও জানা নেই। দোষী ব্যক্তিরা কে কী দণ্ড পাবেন, তা-ও জানা নেই।

২১ অক্টোবর হাইকোর্টের একক বেঞ্চের দেওয়া আদেশটি অনেকটাই ব্যতিক্রমী। আদেশটিতে যদিও উল্লেখ করা হয় যে দরখাস্তকারীর (পি কে হালদার) দরখাস্ত বিভ্রান্তিকর। কিন্তু আবেদন অনুযায়ী তাঁকে একটা কমফোর্ট বা স্বস্তি দেওয়া হয়েছিল। অথচ পি কে তা অগ্রাহ্যই করলেন। গতকাল দুদকের প্রধান আইনজীবী খুরশীদ আলম খানের সঙ্গে কথা হলো। তাঁর সঙ্গে আমরা একমত যে পি কে হালদার তাঁর এক প্রতিষ্ঠানের এমডির কাছে যে চিঠি লিখেছেন, তা আদালত অবমাননার শামিল। কারণ, তিনি আদালতের কাছে প্রতিকার চেয়েছেন, আদালত তাঁকে ফিরতে বলেছে, কিন্তু তিনি স্পর্ধার সঙ্গে লঙ্ঘন করেছেন।

গত ৭ সেপ্টেম্বর হাইকোর্ট পর্যবেক্ষণ দিয়েছিলেন যে পি কে যদি তাঁর আগমনের দিনক্ষণ জানান, তাহলে হাইকোর্ট প্রচলিত আইনে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে নির্দেশ দেবেন। যথারীতি গ্রেপ্তার হবেন, বিক্ষুব্ধ আমানতকারীদের কবলে পড়বেন না। এমন আদেশ জারির ‘মূল কারণ’ সম্পর্কে আদালত নিজেই বলেছেন, দেশে পি কের উপস্থিতি নিশ্চিত করাই আদালতের আসল উদ্দেশ্য। মসৃণভাবে টাকা উদ্ধারে (স্মুথ রিকভারি অব মানিজ) আদালতকে সহায়তা করতে পি কে হালদারকে বাধ্য করা।

কিন্তু আমরা জানি, টাকা ফেরতে আপিল বিভাগের নির্দিষ্ট আদেশ অতীতে অগ্রাহ্য হয়েছে। হল-মার্ক, ডেসটিনি কেউ টাকা ফেরত দেয়নি। সবাই ‘মসৃণভাবে’ টাকা লুটতেই শিখেছেন।