অভিযানেও মাদকের মজুত বেড়েছে

আড়াই বছরে ২৭২ জন বন্দুকযুদ্ধে নিহত হওয়ার পর সরকারের কমিটির সভায় বলা হচ্ছে, ইয়াবা কারবারিদের ঠেকানো যায়নি। মাদকের মজুত বেড়েছে

প্রতীকী ছবি

২০১৮ সালের ৪ মে থেকে ‘চল যাই যুদ্ধে, মাদকের বিরুদ্ধে’ স্লোগান নিয়ে বিশেষ অভিযান শুরু হয়। ওই অভিযানে পুলিশ, র‍্যাব ও বিজিবির সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ২৭২ জন। এতে দুই নারীসহ ১০৪ জন রোহিঙ্গা নাগরিকও রয়েছেন। শুধু টেকনাফে বন্দুকযুদ্ধে মারা যান ১৬২ জন। অভিযানের আড়াই বছরের বেশি সময় পর এসে সরকারি সংস্থাগুলোই বলছে, দেশে মাদকের সরবরাহ ও মজুত কমেনি, বরং বেড়েছে।

গণমাধ্যমের কাছে মাদকের সরবরাহ ও মজুত বাড়ার বিষয়টি সরাসরি স্বীকার না করলেও দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারা জাতীয় মাদকবিরোধী কমিটির সভায় এমন তথ্য জানান। গত ১৭ সেপ্টেম্বর ছিল কমিটির প্রথম সভা। জুম অনলাইন প্ল্যাটফর্মে ওই সভায় সংযুক্ত ছিলেন কমিটির ৪৭ জন সদস্য।

সভায় মাদকদ্রব্যের সরবরাহ হ্রাসে নেওয়া উদ্যোগ সম্পর্কে প্রথমে বক্তব্য দেন মাদকদ্রব্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আহসানুল জব্বার। তিনি বলেন, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর এং সব আইনপ্রয়োগকারী সংস্থা মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণে কাজ করে যাচ্ছে। গত পাঁচ বছরে এসব সংস্থার মাদকবিরোধী অভিযানে ৬ লাখ ৭ হাজার ৪৫১ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়। তাঁদের বিরুদ্ধে ৪ লাখ ৬৭ হাজার ৩৬২টি মামলা হয়েছে।

সভায় মাদকের মজুত বৃদ্ধি সম্পর্কে কথা বলেন র‍্যাবের প্রতিনিধি (র‍্যাব সদর দপ্তরের তৎকালীন পরিচালক) সারওয়ার বিন কাশেম। তিনি বলেন, মাদক ব্যবসায়ীরা ঘন ঘন রুট পরিবর্তন করছেন এবং করোনা মহামারির মধ্যেও তাঁরা মাদকের মজুত বৃদ্ধি করেছেন। তিনি আরও বলেন, ফেনসিডিলের অপব্যবহার বৃদ্ধির ধারাও আবার দেখা যাচ্ছে।

মাঠে থাকা বিভিন্ন বাহিনীর কর্মকর্তারা অনানুষ্ঠানিক আলোচনায় বলেছেন, কোনোভাবেই ইয়াবার প্রবেশ ঠেকানো যাচ্ছে না। পরিসংখ্যান বলছে, মাদক উদ্ধারের হিসাবে ২০১৯ সালের পরিস্থিতির সঙ্গে চলতি বছরের খুব একটা পার্থক্য নেই। গত বছর মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর, পুলিশ, র‍্যাব, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও কোস্টগার্ড মিলে ৩ কোটি ৪ লাখ ইয়াবা উদ্ধার করেছে। এ বছর করোনার মধ্যে জানুয়ারি থেকে অক্টোবর পর্যন্ত ৯ মাসে ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে ২ কোটি ৭৯ লাখ।

সরকারি সভা বা অনানুষ্ঠানিকভাবে মাদকের সরবরাহ বাড়ার কথা জানালেও প্রথম আলোর পক্ষ থেকে যোগাযোগ করা হলে বাহিনীগুলো মাদকের মজুত বাড়ার বিষয়টি স্বীকার করেনি। পুলিশ সদর দপ্তরের মুখপাত্র ও সহকারী মহাপরিদর্শক মো. সোহেল রানা প্রথম আলোকে বলেন, দেশে মাদকের মজুত বেড়েছে, এমন কোনো তথ্য তাঁদের কাছে নেই। সাধারণত পুলিশ বিভিন্ন সময়ে যে মাদক উদ্ধার করে, তার পরিসংখ্যান থেকে মাদকের হ্রাস-বৃদ্ধির ধারণা পাওয়া যায়। বিগত কয়েক বছরের পরিসংখ্যানের তুলনামূলক বিশ্লেষণ মাদকের মজুত বৃদ্ধির এ ধরনের কোনো দাবিকে সমর্থন করে না। এ ছাড়া বাংলাদেশে মাদক মজুতের এমন কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থা নেই, যা থেকে এমন কোনো স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যেতে পারে।

গত বছর উদ্ধার ৩ কোটি ৪ লাখ ইয়াবা। এ বছরের ৯ মাসে ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে ২ কোটি ৭৯ লাখ। ২০১৮ সালের ৪ মে থেকে শুরু হওয়া বিশেষ অভিযানে কথিত বন্দুকযুদ্ধে নিহত হন ২৭২ জন।

মাদকের মজুত বেড়েছে, এমন কোনো তথ্য তাঁদের কাছেও নেই বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন র‍্যাবের আইন ও গণমাধ্যম শাখার পরিচালক লে. কর্নেল আশিক বিল্লাহ।

তবে ১৭ সেপ্টেম্বরের জাতীয় মাদকবিরোধী কমিটির সভায় র‍্যাবের প্রতিনিধির বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও সব আইন প্রয়োগকারী সংস্থাকে মাদক ব্যবসায়ীদের ওপর কড়া নজর রাখার সুপারিশ করা হয়।

জাতীয় মাদকবিরোধী কমিটির প্রধান হলেন সুরক্ষা সেবা সচিব মো. শহিদুজ্জামান। সভার কার্যবিবরণী ধরে প্রশ্ন করা হলে ১২ ডিসেম্বর তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ইয়াবার মজুত বেড়েছে। মজুত বাড়ার কারণ সম্পর্কে তিনি বলেন, করোনাকে সবাই ভয় পেলেও মাদক কারবারিরা পান না। মাসছয়েক অভিযানে একটু ঘাটতি ছিল, সেই সুযোগ মাদক কারবারিরা কাজে লাগিয়েছেন। তাঁরা শিগগিরই জোরদার অভিযান শুরু করবেন। এর ফলও দেখা যাবে।

সেই অভিযানের ফল কী

এখন আবার জোরদার অভিযানের কথা বলা হচ্ছে। প্রশ্ন উঠেছে, ২০১৮ সালে শুরু হওয়া সেই অভিযানের ফল তাহলে কী দাঁড়াল? সূত্রগুলো জানাচ্ছে, ওই অভিযানের সময়ও মাদকের পাচার থেমে থাকেনি।

কর্মকর্তারা বলছেন, যখন যে সীমান্ত কড়াকড়ি হয়েছে, মাদক কারবারিরা বিকল্প পথ খুঁজে নিয়েছেন। সীমান্ত রক্ষার দায়িত্বে থাকা বিজিবি বলছে, কেবল মিয়ানমার নয়, ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়েও ইয়াবা ঢুকছে।

বিজিবির পরিচালক (অপারেশনস) ফয়জুর রহমান বলেন, গত বছর বাংলাদেশ–ভারত সীমান্ত দিয়ে ৮ লাখ ৩৪ হাজার ইয়াবা উদ্ধার হয়েছিল। এ বছরের নভেম্বর পর্যন্ত ভারতের বিভিন্ন সীমান্ত থেকে প্রায় ৬ লাখ ইয়াবা উদ্ধার হয়েছে। মাদকের যে মজুত বেড়েছে, তার প্রভাব পড়েছে এখনকার বাজারেও। আগের চেয়ে অনেক কম দামে বিক্রি হচ্ছে ইয়াবা। প্রাণঘাতী অভিযানের মধ্যেও মাদকের বেচাকেনা চলেছে।

২০১৮ সাল থেকে ‘চল যাই যুদ্ধে মাদকের বিরুদ্ধে’ নামে তাঁদের যে অভিযান শুরু হয়েছে, সেটা এখনো চলছে।
আশিক বিল্লাহ ,মুখপাত্র , র‌্যাব

র‍্যাবের মুখপাত্র আশিক বিল্লাহ প্রথম আলোকে বলেন, ২০১৮ সাল থেকে ‘চল যাই যুদ্ধে মাদকের বিরুদ্ধে’ নামে তাঁদের যে অভিযান শুরু হয়েছে, সেটা এখনো চলছে। ওই মাদকবিরোধী বিশেষ অভিযানে দুই বছরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে অনেক হতাহতের ঘটনা ঘটেছে। সর্বশেষ কক্সবাজারের মেরিন ড্রাইভ সড়কে গত ৩১ জুলাই মেজর (অব.) সিনহা মো রাশেদ খান পুলিশের গুলিতে খুন হওয়ার পর থেকে মাদকবিরোধী অভিযানের নামে ‘বন্দুকযুদ্ধ’ বা ‘ক্রসফায়ার’-এর মতো ঘটনা একেবারেই কমে যায়।

আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা জরুরি। আর সরকারের উচিত মাদক নির্মূলে জিরো টলারেন্স মানে জিরো টলারেন্স, এটা মনে রাখা।
ইমতিয়াজ আহমেদ ,অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক ইমতিয়াজ আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা জরুরি। আর সরকারের উচিত মাদক নির্মূলে জিরো টলারেন্স মানে জিরো টলারেন্স, এটা মনে রাখা। সে ক্ষেত্রে রাজনৈতিক পরিচয় দেখে অভিযান করলে সুফল পাওয়া যাবে না।