আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনা বাড়ছে

নারী ও মেয়েশিশুদের আগুনে পোড়ানোর প্রবণতা বরাবরই উদ্বেগজনক ছিল। গত কয়েক বছরে এমন সহিংসতা বাড়ছে। এতে মৃত্যুঝুঁকি খুব বেশি। তবে একই সময়ে অ্যাসিড দিয়ে পোড়ানোর ঘটনা কমেছে।

১৯৯৮ সাল থেকে অ্যাসিড ব্যবহার করে সহিংসতার ঘটনা বাড়তে শুরু করে। আইন প্রণয়নসহ সরকারি–বেসরকারি উদ্যোগে সে ঘটনা উল্লেখযোগ্য হারে কমে এসেছে। তবে খোঁজখবর করেও কেরোসিন, পেট্রল ব্যবহার করে সহিংসতা প্রতিরোধে কোনো কর্মসূচি সম্পর্কে জানা যায়নি।

মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের উপপরিচালক নীনা গোস্বামী প্রথম আলোকে বলেন, নারীকে আগুনে পুড়িয়ে মারার ঘটনা পুরোনো। তবে সাম্প্রতিক সময়ের হামলা বিশ্লেষণ করে মনে হয়, কেরোসিন, পেট্রল ব্যবহার করে নারীর প্রতি সহিংসতার মাত্রা ও ভয়াবহতা বাড়ছে।

বেসরকারি সংস্থা বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের হিসাব বলছে, ২০১৩ থেকে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত ৪৩৯টি আগুন হামলার ঘটনা ঘটেছে। আর এতে মারা গেছে ১৬৮ নারী ও মেয়েশিশু। তবে এ সময়ে অ্যাসিড–সন্ত্রাসের ঘটনা ছিল এর অর্ধেকের মতো। ১৪টি দৈনিক সংবাদপত্রে প্রকাশিত খবরের বছরওয়ারি হিসাব রাখে প্রতিষ্ঠানটি।

তথ্য আরও বলছে, ২০১৩ সালে ৫৩টি আগুন–সহিংসতার ঘটনা ঘটে। বছর বছর বেড়ে ২০১৭ সালে সে সংখ্যা দাঁড়ায় ৯১–তে। গেল বছর অবশ্য ঘটনার সংখ্যা কিছু কম ছিল।

গত ১২ জুন বরগুনার পাথরঘাটায় শাজেনূর বেগমের (৩০) শরীরে পেট্রল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয় দুর্বৃত্তরা। এতে শাজেনূর ও তাঁর মেয়ে সখিনা আক্তার (১০) পুড়ে মারা যায়।

মহিলা ও শিশুবিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে নারী নির্যাতন প্রতিরোধকল্পে মাল্টিসেক্টরাল প্রোগ্রাম চলছে। এই প্রোগ্রামের ওয়ান–স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) তথ্য বলছে, ২০০১ সাল থেকে চলতি বছরের মে পর্যন্ত আগুন–সহিংসতায় আক্রান্ত ৩৬৮ নারী ও মেয়েশিশুকে সেবা দেওয়া হয়েছে। এর বিপরীতে অ্যাসিডে আক্রান্তের সংখ্যা ১২৫ জন।

ওসিসির মাধ্যমে দেশের বড় নয়টি শহরে সহিংসতার শিকার নারী ও মেয়েশিশুকে স্বাস্থ্য, আইনি ও সামাজিক সুরক্ষা দেওয়া হয়।

 সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) ‘নারীর প্রতি সহিংসতা’ জরিপে নারীর প্রতি শারীরিক নির্যাতনের একটি অন্যতম হাতিয়ার দেখানো হয়েছে, উদ্দেশ্যমূলকভাবে আগুনে পোড়ানো।

মাল্টিসেক্টরাল প্রকল্পের পরিচালক আবুল হোসেন বলেন, কেরোসিন, পেট্রলে পুড়িয়ে মারার ঘটনা ঘটছেই। তবে গুরুতর পোড়া রোগীকে সেবা দেওয়ার মতো সুবিধা ওসিসিতে নেই।

অ্যাসিড–সহিংসতা প্রতিরোধে কাজ করা প্রতিষ্ঠান অ্যাসিড সারভাইভারস ফাউন্ডেশন (এএসএফ) ১৯৯৯ সাল থেকে এ–সংক্রান্ত হিসাব রাখছে। এতে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি অ্যাসিড হামলার ঘটনা ঘটে ২০০২ সালে, ৪৯৪টি। গেল বছর এ ধরনের ঘটনা ছিল ১৮টি।

>

নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা
আগুনে পুড়িয়ে মারা নারী ও মেয়েশিশুর প্রতি একটি বড় সহিংসতা
এটি প্রতিরোধে নেই বিশেষ কোনো কর্মসূচি

সম্প্রতি আগুন–সন্ত্রাসের বেশ কয়েকটি ঘটনা গণমাধ্যমে আলোচিত হলে এ ধরনের সহিংসতার হিসাব রাখতে শুরু করে এএসএফ। এতে দেখা যায়, অ্যাসিডের তুলনায় কেরোসিন, পেট্রল দিয়ে হামলার সংখ্যা প্রায় পাঁচ গুণ বেশি। চলতি বছরের প্রথম সাড়ে পাঁচ মাসে এ ধরনের ঘটনার সংখ্যা ৩৩টি। এতে দগ্ধ ৪২ জনের মধ্যে ৩৬ জনই নারী ও মেয়েশিশু।

 এএসএফের নির্বাহী পরিচালক সেলিনা আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, নানা কর্মসূচিতে অ্যাসিডের ঘটনা কমেছে। অপরদিকে, কম দাম, সহজলভ্য ও বহনের সুবিধার কারণে কেরোসিন ও পেট্রল ব্যবহার করে সহিংসতা বাড়ছে। অপরাধ ঢাকতেও এর ব্যবহার হচ্ছে বলে মত তাঁর।

ঢাকা মহানগর পুলিশের উইমেন সাপোর্ট অ্যান্ড ইনভেস্টিগেশনের (ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার) উপকমিশনার ফরিদা ইয়াসমিন প্রথম আলোকে বলেন, এ ধরনের সহিংসতার শিকার হয়ে নারী–শিশুরা আসছে। স্বজনের হাতে যেমন এ ধরনের ঘটনা ঘটে। স্বার্থ হাসিল না হলে ও প্রতিশোধ নিতে কম পরিচিতজনেরাও নারী–শিশুর গায়ে আগুন দিয়ে থাকে।

শ্লীলতাহানির অভিযোগে মামলা করলে ফেনীর সোনাগাজীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাত জাহানের হাত-পা বেঁধে গায়ে কেরোসিন ঢেলে আগুন দেওয়া হয়। অগ্নিদগ্ধ হয়ে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি। আগুনে নুসরাতের শরীরের ৭৫ শতাংশ পুড়ে গিয়েছিল।

চিকিৎসকেরা বলছেন, অ্যাসিডের তুলনায় কেরোসিন বা পেট্রল দিয়ে অগ্নিদগ্ধের ঘটনায় মৃত্যুর হার অনেক বেশি। অঙ্গহানির আশঙ্কাও বেশি। বাংলাদেশ মহিলা পরিষদের হিসাবেও এই প্রবণতা দেখা যায়।

এএসএফ এই বছরের মে মাসের অগ্নিদগ্ধের ঘটনাগুলো যাচাই করে দেখেছে। এতে দেখা যায়, ১২টি কেরোসিন ও পেট্রল হামলার ঘটনায় ১৪ জন আক্রান্তের মধ্যে ১২ জনই মারা গেছে। দুটি অ্যাসিড হামলায় দুজন দগ্ধ হলেও কেউ মারা যায়নি।

ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব বার্ন অ্যান্ড প্লাস্টিক সার্জারি ইউনিটের জাতীয় সমন্বয়ক সামন্ত লাল সেন বলেন, অ্যাসিডে চেহারা বিকৃতি বা অঙ্গহানির ঘটনা ঘটলেও কেরোসিন বা পেট্রলের আগুন দ্রুত সারা শরীরে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে মৃত্যু ঘটে বেশি।

মানবাধিকারকর্মী ও আইনজীবী নীনা গোস্বামী বলেন, অ্যাসিড প্রতিরোধের কার্যক্রমগুলোকে বিবেচনা করে কেরোসিন ও পেট্রলের মতো দাহ্য পদার্থ বহন ও সংরক্ষণে নিয়ন্ত্রণ আনা দরকার। আবার বিচার–প্রক্রিয়া দ্রুত শেষ ও অপরাধীর দৃষ্টান্তমূলক শাস্তিও নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ের সমন্বিত উদ্যোগ ও সামাজিক আন্দোলন বড় ভূমিকা রাখবে বলে মনে করেন তিনি।