আগেও আদালতে নিজেদের আইএস দাবি দুই জঙ্গির

রাকিবুল হাসান ও জাহাঙ্গীর হোসেন
রাকিবুল হাসান ও জাহাঙ্গীর হোসেন

গ্রেপ্তারের পর আদালতে দেওয়া জবানবন্দিতে নিজেকে আইএসের সদস্য হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন জঙ্গি রাকিবুল হাসান (রিগ্যান)। আর আদালতে আত্মপক্ষ সমর্থন করে দেওয়া বক্তব্যে আরেক জঙ্গি জাহাঙ্গীর হোসেনও (রাজীব গান্ধী) নিজেকে আইএসের উত্তরবঙ্গের সামরিক শাখার প্রধান বলে দাবি করেছিলেন। এই দুজনকেই গত বুধবার রায় ঘোষণার পর আইএসের প্রতীকসংবলিত কালো টুপি পরে থাকতে দেখা গেছে।

দুই জঙ্গির নিজেদের আইএস দাবি করার বিষয়টি আদালতের রায়েও উল্লেখ রয়েছে। হোলি আর্টিজানে হামলা মামলার রায়ে জঙ্গি রাকিবুল সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে, ‘তার দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পর্যালোচনায় দেখা যায় যে সে আইএসের সদস্য হিসেবে যোগ দিয়েছে এবং উক্ত সংগঠনের প্রশিক্ষণসহ বিভিন্ন কার্যক্রমে অংশ নিয়েছে। আসামি আসলাম হোসেনসহ অন্যান্য আসামির দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি পর্যালোচনায় দেখা যায় যে রাকিবুল হাসান যে আইএসের কথা বলেছে, সে আইএস হলো জেএমবির এক অংশ নিয়ে গঠিত নব্য জেএমবি।’

জঙ্গি রাকিবুলের জবানবন্দিতেই উঠে আসে হোলি আর্টিজান হামলার মূল পরিকল্পনাকারী বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত কানাডার নাগরিক তামিম চৌধুরী। এই তামিমের সঙ্গে রাকিবুলের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। জবানবন্দিতে রাকিবুল দাবি করেছিলেন, বাংলাদেশে আইএস পরিচালনা ও পরিকল্পনার দায়িত্বে ছিলেন তামিম। ২০১৭ সালের ২৭ আগস্ট নারায়ণগঞ্জের এক জঙ্গি আস্তানায় পুলিশের অভিযানে নিহত হন তামিম।

আর জাহাঙ্গীর হোসেন সম্পর্কে রায়ে বলা হয়েছে, ‘ফৌজদারি কার্যবিধির ৩৪২ ধারায় পরীক্ষাকালে আসামি স্বীকার করেছে, সে তামিম চৌধুরী ও সরোয়ার জাহানের মাধ্যমে বাইয়াত গ্রহণ করে এবং তাদের আনুগত্য স্বীকার করে। আইএসের উত্তরবঙ্গ সামরিক শাখার প্রধান হয় ও অনেকগুলো হত্যাকাণ্ডে অংশগ্রহণ করে।’

হোলি আর্টিজান হামলা মামলায় গত বুধবার রাকিবুল, জাহাঙ্গীর হোসেনসহ সাত আসামির মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা করেন ঢাকার সন্ত্রাসবিরোধী বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক মো. মজিবুর রহমান। তিন বছর আগে ২০১৬ সালের ১ জুলাই রাতে ঢাকার গুলশানে অভিজাত রেস্তোরাঁ হোলি আর্টিজান বেকারিতে আইএস মতাদর্শ অনুসরণকারী পাঁচ জঙ্গি হামলা চালায়। তারা বিদেশি নাগরিকসহ ২২ জনকে হত্যা করে। নিহত ব্যক্তিদের মধ্যে নয়জন ইতালির, সাতজন জাপানের, তিনজন বাংলাদেশি, একজন ভারতীয় নাগরিক। এ ছাড়া দুজন পুলিশ কর্মকর্তা নিহত হয়েছিলেন জঙ্গিদের নিক্ষিপ্ত গ্রেনেড ও গুলিতে।

গত বুধবার এই মামলার রায় ঘোষণার পরই রাকিবুল আইএসের প্রতীকসংবলিত টুপি পরে এজলাস থেকে বের হন। এরপর প্রিজন ভ্যানে আরেক জঙ্গি জাহাঙ্গীর হোসেনের মাথায়ও একই ধরনের টুপি দেখা যায়। যদিও হোলি আর্টিজানে হামলার পর থেকেই পুলিশ দাবি করে আসছে, জঙ্গিদের সঙ্গে আইএসের কোনো যোগাযোগ ছিল না।

কারাগার থেকে কড়া নিরাপত্তার মধ্য দিয়ে আনা জঙ্গিদের মাথায় আইএসের প্রতীকসংবলিত টুপি কীভাবে এল, তা নিয়ে আলোড়ন সৃষ্টি হয়। বিষয়টি খতিয়ে দেখতে তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি করেছে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি)। আবার কারাগার প্রান্তে কোনো ত্রুটি ছিল কি না, তা তদন্তে তিন সদস্যের পৃথক কমিটি গঠন করেছে কারা কর্তৃপক্ষ। গত বৃহস্পতিবার পুলিশ বলেছে, টুপিটি কারাগার থেকে এনেছিলেন জঙ্গি রাকিবুল। তবে পুলিশের এই দাবির বিষয়ে কোনো মন্তব্য করতে চায়নি কারা কর্তৃপক্ষ। তারা বলছে, তদন্ত শেষেই পুরো বিষয় খোলাসা হবে।

>

হোলি আর্টিজান মামলার রায়
জঙ্গি রাকিবুল হাসান ও জাহাঙ্গীর হোসেন নিজেদের আইএসের সদস্য দাবি করেছিলেন

প্রচার পেতে এবং প্রোপাগান্ডা চালাতে জঙ্গি রাকিবুল ও জাহাঙ্গীর হোসেন রায় ঘোষণার সময় আইএসের প্রতীকসংবলিত টুপি পরে এসেছিলেন বলে মনে করেন নিরাপত্তা বিশ্লেষক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) সাখাওয়াত হোসেন। তিনি প্রথম আলোকে বলেন, ভয়ংকর এসব জঙ্গিকে কঠোরভাবে হ্যান্ডেল (নজরদারি) করা প্রয়োজন। কারাগারে কিংবা আদালতে জঙ্গিরা কোনোভাবেই যাতে অন্যদের সংস্পর্শে আসার সুযোগ না পায়, সেটি নিশ্চিত করা খুব জরুরি।

রাকিবুল–জাহাঙ্গীরকে নিয়ে রায়ে যা আছে

দোষ স্বীকার করে যে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছিলেন রাকিবুল হাসান, তা রায়ের একাধিক অংশে উল্লেখ করেছেন এই মামলার বিচারক। জবানবন্দিতে রাকিবুল বলেছিলেন, ‘আমি আইএস সংগঠনের সদস্য। আমার সাংগঠনিক নাম রাফিউল ইসলাম। সাংগঠনিক কারণে কোনো সদস্য জায়গা পরিবর্তন করলে তার কোড নেম (সাংকেতিক নাম) পরিবর্তন হয়।’ জবানবন্দিতে এই জঙ্গি বলেছেন, ২০১৫ সালের ২৩ জুলাই আইএসে যোগ দেওয়ার উদ্দেশ্যে বগুড়া থেকে ঢাকায় আসেন। যে পাঁচ জঙ্গি হোলি আর্টিজানে সরাসরি হামলায় জড়িত ছিলেন, তাঁদের প্রত্যেককে প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন রাকিবুল। এর বাইরে ১৩ জনকে জঙ্গি হামলা চালানোর প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন এই জঙ্গি। যে ১৩ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়, তাঁদের মধ্যে একজন হোলি আর্টিজানে হামলার পর কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় জঙ্গি হামলা চালাতে গিয়ে নিহত হন। আরেকজন রাজধানীর কল্যাণপুরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিহত হন।

জাহাঙ্গীর হোসেনের দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি ও আত্মপক্ষ সমর্থন করে দেওয়া বক্তব্য রায়ের একাধিক অংশে উল্লেখ রয়েছে। এর এক জায়গায় বলা হয়েছে, ২০১৪ সালেই সাদা চামড়ার বিদেশিদের হত্যা করে দেশকে অস্থিতিশীল করার পরিকল্পনা নিয়েছিলেন তামিম চৌধুরী।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বিচারক বলেছেন, আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএসের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য জেএমবির একাংশ নিয়ে গঠিত নব্য জেএমবির সদস্যরা গুলশানের হোলি আর্টিজান বেকারিতে নারকীয় ও দানবীয় হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে। হোলি আর্টিজান বেকারিতে হামলার মধ্য দিয়ে জঙ্গিবাদের উন্মত্ততা, নিষ্ঠুরতা ও নৃশংসতার জঘন্য বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কলঙ্কজনক এ হামলার মাধ্যমে অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের চরিত্র হরণের চেষ্টা করা হয়েছে।

আদালত রায়ে এ মামলার এক সাক্ষীকে তারকা (অতি গুরুত্বপূর্ণ) সাক্ষী (১৮ বছরের নিচে, তাই নাম প্রকাশ করা হলো না) হিসেবে উল্লেখ করেছেন। আদালত বলেছেন, তার সাক্ষ্যকে অবিশ্বাস করার কোনো কারণ নেই। রায়ের একাধিক অংশে এই সাক্ষীর বক্তব্য তুলে ধরেছেন বিচারক। এই সাক্ষীর বাবা (তানভীর কাদেরী) হোলি আর্টিজান হামলা চালাতে অর্থ দিয়েছিলেন। হামলাকারী জঙ্গিদেরও অশ্রয় দিয়েছিলেন তিনি। হোলি আর্টিজানে হামলার দুই মাস পর ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বরে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে রাজধানীর আজিমপুরে তানভীর কাদেরী নিহত হন।

হোলি আর্টিজান মামলার রায় নিয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, বিচারিক আদালত সাক্ষ্য–প্রমাণের ভিত্তিতে রায় দিয়েছেন। এখন মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য আইন অনুযায়ী মামলার নথিপত্র হাইকোর্টে আসবে। তখন হাইকোর্টও রায়টি দেখবেন, পর্যালোচনা করবেন। তিনি বলেন, যারা ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে নৃশংস হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে, তাদের বিচারের পুরো প্রক্রিয়া দ্রুত সম্পন্ন করে সাজা কার্যকর হোক, এটিই মানুষ চায়।