আত্মসাতের টাকায় বাড়ি, তিন ফ্ল্যাট

পরিচালক মঈন উদ্দিন আহমেদ ৮১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। এই কোম্পানির ৫০% শেয়ার সরকারি সংস্থা বিপিসির।

মঈন উদ্দিন আহমেদ

সরকারি-বেসরকারি যৌথ মালিকানার প্রতিষ্ঠান স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল লিমিডেটের ৮১ কোটি টাকার বেশি আত্মসাৎ করেছেন কোম্পানিটির বেসরকারি পরিচালক মঈন উদ্দিন আহমেদ। এই আত্মসাতের প্রক্রিয়ায় তাঁকে সহায়তা করেছেন প্রতিষ্ঠানটির মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদ। তিনি নিজে হাতিয়েছেন ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা।

দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত করে এই অর্থ লোপাটের প্রমাণ পেয়েছে। সংস্থাটি সুনির্দিষ্ট অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে গত বছরের ৬ ফেব্রুয়ারি এ বিষয়ে তদন্ত শুরু করে। দুদকের উপপরিচালক মোহাম্মদ মাহমুদুর রহমান ও সহকারী পরিচালক মামুনুর রশীদ চৌধুরী চলতি মাসে তাঁদের প্রতিবেদন কমিশনে জমা দেন। এতে মঈন উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে নিয়মিত মামলা করার সুপারিশ করা হয়েছে। অন্যদিকে মোহাম্মদ শাহেদ গত ১৮ আগস্ট মারা গেছেন। তাই তাঁর ক্ষেত্রে মামলার সুযোগ নেই বলে উল্লেখ করা হয়েছে।

দুদকের তদন্তে উঠে আসে যে মঈন উদ্দিন আহমেদ লোপাটের অর্থ দিয়ে তিনটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। আবার বাড়ি নির্মাণসহ বিভিন্ন খাতে বিনিয়োগ করেছেন।

স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল লিমিটেড সরকারি কোম্পানি বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশনের (বিপিসি) অঙ্গপ্রতিষ্ঠান। বিপিসি এর ৫০ শতাংশ শেয়ারের মালিক। বাকি ৫০ শতাংশ শেয়ার মঈন উদ্দিন ও তাঁর ভাই মিশু মিনহাজের। কোম্পানিটি ১৯৬৫ সালে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয়। শুরুতে এটির যৌথ মালিকানা ছিল এশিয়াটিক ইন্ডাস্ট্রিজ লিমিটেড ও যুক্তরাষ্ট্রের ইসো ইস্টার্ন ইনকরপোরেশনের হাতে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর ইসো ইস্টার্ন এ দেশ ছেড়ে গেলে তাদের হাতে থাকা মালিকানার ৫০ শতাংশ বিপিসির অধীনে দেয় সরকার। স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল লুব অয়েলের ব্যবসা করে।

বিপিসি জানিয়েছে, এখন তাদের দুজন ও বেসরকারি মালিকানা থেকে দুজন পরিচালকের সমন্বয়ে স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েলের পরিচালনা পর্ষদ গঠিত। প্রতিষ্ঠানের চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকেন সরকারের জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ বিভাগের একজন কর্মকর্তা।

অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে বক্তব্য জানার জন্য মঈন উদ্দিন আহমেদের সঙ্গে মুঠোফোনে যোগাযোগ করে সাড়া পাওয়া যায়নি। অ্যাপভিত্তিক যোগাযোগমাধ্যম হোয়াটসঅ্যাপে পাঠানো প্রশ্ন তিনি দেখেছেন (বার্তা দেখার সবুজ সংকেত উঠেছে)। কিন্তু কোনো উত্তর দেননি।

শুধু এই ৮১ কোটি টাকা আত্মসাৎ নয়, স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েলে আরও দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ রয়েছে। এ বিষয়ে প্রতিষ্ঠানটির চেয়ারম্যানের দায়িত্বে থাকা বিপিসির চেয়ারম্যান আবু বকর সিদ্দিক প্রথম আলোকে বলেন, কোম্পানির হিসাবে তাঁরা অনেক গরমিল পাচ্ছেন। টাকা যে আত্মসাৎ হয়েছে, বিষয়টি নিশ্চিত। এর বাইরেও তাঁদের (মঈন উদ্দিন) কাছে কোম্পানির অনেক পাওনা রয়েছে, যেগুলো আদায় করা হচ্ছে। তিনি বলেন, দুদক অনুসন্ধান করে যে ব্যবস্থা নেবে, সে অনুযায়ীই তাঁরা পরবর্তী পদক্ষেপ নেবেন।

দুদকের অনুসন্ধান প্রতিবেদনে বলা হয়, মঈন উদ্দিন আহমেদ বিভিন্ন সময়ে ঋণপত্রের (এলসি) বিপরীতে স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েলের পাঁচটি ব্যাংক হিসাব থেকে প্রায় ৪২ কোটি টাকা তুলে নিজের প্রতিষ্ঠান পিরামিড এক্সিম লিমিটেডের চারটি ব্যাংক হিসাবে জমা করেন। ট্যাংকার ও কনটেইনার ওঠানো-নামানোসহ (হ্যান্ডলিং) বিভিন্ন খাতের ব্যয়ের বিপরীতে তিনি মনগড়া চাহিদাপত্র বা রিকুইজিশন দিতেন। যে নগদ চেকের মাধ্যমে তিনি এই টাকা হাতিয়েছেন, সেগুলোর অধিকাংশেই কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদের সই ছিল।

দুদক বলছে, স্থানান্তরিত এই অর্থের প্রায় সাড়ে ১৩ কোটি টাকা দিয়ে মঈন উদ্দিন আহমেদ তিনটি ফ্ল্যাট কিনেছেন। এ ছাড়া তিনি ঢাকার লালমাটিয়ায় বাড়ি নির্মাণের জন্য ভূমি ডেভেলপমেন্ট নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে প্রায় ছয় কোটি টাকা, একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এক কোটি টাকা ও ব্র্যান্ডস অনলি নামের একটি প্রতিষ্ঠানকে দেড় কোটি টাকার মতো দিয়েছেন।

দুদকের তদন্ত প্রতিবেদন বলছে, মঈন উদ্দিন আহমেদ আরেকটি উপায়ে প্রায় ৩৯ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন। সেটি হলো খরচের নাম করে নিজের নামে বা অন্য কর্মচারীদের নামে চেকে অগ্রিম টাকা নেওয়া।

তদন্ত প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েল কোম্পানির মহাব্যবস্থাপক মোহাম্মদ শাহেদ গুডউইন পাওয়ার লিমিটেড নামের একটি প্রাইভেট লিমিটেড কোম্পানির অংশীদার। এটি চাকরির শৃঙ্খলার পরিপন্থী। শাহেদ বিভিন্ন সময়ে স্ট্যান্ডার্ড এশিয়াটিক অয়েলের তিনটি ব্যাংক হিসাব থেকে গুডউইনের একটি ব্যাংক হিসাবে ২ কোটি ৭০ লাখ টাকা বিনিয়োগের উদ্দেশ্যে জমা করেন।

দুদকের মুখপাত্র প্রণব কুমার ভট্টাচার্য প্রথম আলোকে বলেন, কমিশন পর্যালোচনা করে প্রতিবেদনের সুপারিশ অনুযায়ী কী ব্যবস্থা নেওয়া যায়, সে বিষয়ে পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে।