>

পরিবারের দাবি, বগুড়ার শফিকুল ছয় মাস আগে সর্বশেষ বাড়ি এসেছিলেন
গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জিম্মি উদ্ধার অভিযানে নিহত আরেক সন্দেহভাজন হামলাকারীর পরিচয় জানা গেছে। তাঁর নাম শফিকুল ইসলাম ওরফে উজ্জ্বল (২৫)। বাড়ি বগুড়ার ধুনট উপজেলার ভান্ডারবাড়ি ইউনিয়নের কৈয়াগাড়ি গ্রামে। এ নিয়ে পাঁচজনের পরিচয় জানা গেল।
এদিকে ঘটনার তিন দিনের মাথায় গতকাল সোমবার রাতে গুলশান থানায় সন্ত্রাসবিরোধী আইনে একটি মামলা দায়ের হয়েছে। ওই ঘটনায় নিহত পাঁচজনসহ অজ্ঞাতনামা কয়েকজনকে মামলায় আসামি করা হয়েছে। আর হামলা থেকে বেঁচে ফেরা ১৩ জনের কয়েকজনকে এখনো জিজ্ঞাসাবাদ করছে তদন্ত সংস্থাগুলো।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, তদন্তকারীরা এখন জঙ্গিদের মদদদাতা ও নেপথ্যের লোকদের খুঁজছে। নিহত সন্দেহভাজন জঙ্গিরা পরিবার থেকে অন্তর্ধানের পর এবং হামলার আগ পর্যন্ত কোথায়, কাদের আশ্রয়ে ছিলেন, কারা তাঁদের জঙ্গি দলে টানল—এসব সূত্র ধরে তদন্ত এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা।
আমাদের ধুনট (বগুড়া) প্রতিনিধি জানান, নিহত শফিকুল ইসলামের পরিবার দাবি করেছে, ছয় মাস আগে সর্বশেষ বাড়ি এসেছিলেন তিনি। দীর্ঘদিনের জন্য ‘তাবলিগের চিল্লায় যাচ্ছি’ বলে বাড়ি থেকে বিদায় নেন। এরপর আর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি তিনি।
শনিবার সকালে জিম্মি উদ্ধার অভিযানের পর হামলাকারী হিসেবে যে পাঁচটি লাশের ছবি পুলিশ গণমাধ্যমকে দিয়েছিল, তাঁদের মধ্যে শফিকুলের ছবিও ছিল। এ ছাড়া আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন আইএস (ইসলামিক স্টেট) হামলার দায় স্বীকার করে হামলাকারী হিসেবে যে পাঁচজনের ছবি প্রচার করেছে, তাতেও শফিকুলের ছবি ছিল। আইএস দাবি করেছে, এঁরা তাদের সদস্য। এঁরাই শুক্রবার রাতে গুলশানের রেস্তোরাঁয় হামলা ও হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছেন।
পুলিশ সূত্র জানায়, গতকাল বিকেলে এএসপি গাজিউর রহমানের নেতৃত্বে পুলিশের একটি দল শফিকুলের বাড়ি যায়। পরিবারের সদস্যরা পুলিশকে জানান, শফিকুল ঢাকার আশুলিয়ায় চাকরি করেন, সেখানে আছেন। পরে ঘরের ভেতর বাঁধিয়ে রাখা ছবির সঙ্গে পুলিশ তাদের কাছে থাকা ছবি মিলিয়ে দেখে। একপর্যায়ে শফিকুলের লাশের ছবি তাঁর বাবা ও বড় ভাইকে দেখালে তাঁরা ছবি দেখে তাঁকে শনাক্ত করেন। এরপর পুলিশ বাবা ও ভাইকে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য ধুনট থানায় নিয়ে আসে।
রাতে এএসপি গাজিউর রহমান প্রথম আলোকে বলেন, শফিকুলের বাবা ও ভাইকে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
শফিকুলের বাবা বদিউজ্জামান (৫৫) ও বড় ভাই আসাদুল ইসলাম (৩২) দুজনই কৃষিশ্রমিক। বদিউজ্জামান প্রথম আলোকে বলেন, ‘রোববার গ্রামের লোকজন বলাবলি করছিল, টেলিভিশনে শফিকুলের ছবি দেখাচ্ছে। সে ঢাকায় জঙ্গি হামলা করতে গিয়ে মারা গেছে। কিন্তু আমি তা বিশ্বাস করিনি। গতকাল বিকেলে বাড়িতে পুলিশ যাওয়ায় বিষয়টি নিশ্চিত হই।’
শফিকুলের ভাই আসাদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, তাঁর ভাই ধুনটের গোঁসাইবাড়ি উচ্চবিদ্যালয় থেকে এসএসসি ও গোসাইবাড়ি ডিগ্রি কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন। এরপর বগুড়া সরকারি আজিজুল হক কলেজে ভর্তি হন। পরে পড়ালেখা বাদ দিয়ে বছর দুয়েক আগে তিনি ঢাকার আশুলিয়ায় একটি কিন্ডারগার্টেন স্কুলে শিক্ষকতার চাকরি নেন। সর্বশেষ ডিসেম্বর শফিকুল বাড়িতে আসেন। তারপর তাবলিগ জামাতের চিল্লায় যাচ্ছেন বলে বাড়ি থেকে বিদায় নেন। এরপর শফিকুল আর বাড়ির কারও সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি।
গুলশানের রেস্তোরাঁয় জিম্মি উদ্ধার অভিযানে নিহত সন্দেহভাজন হামলাকারীদের মধ্যে এর আগে চারজনের পরিচয় জানা যায়। তাঁদের একজন খায়রুল ইসলাম ওরফে পায়েলের বাড়ি বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার ব্রিকুষ্টিয়া গ্রামে। তিনি ডিহিগ্রাম ডিইউ সেন্ট্রাল ফাজিল মাদ্রাসা থেকে ২০১৫ সালে আলিম (এইচএসসি সমমান) পাস করে ফাজিল শ্রেণিতে ভর্তি হন। তাঁর মা পেয়ারা বেগম প্রথম আলোর কাছে দাবি করেন, এক বছর ধরে খায়রুল নিখোঁজ ছিলেন। তাঁর বোনের দাবি, তাঁরা জানতেন, তাঁর ভাই ঢাকার জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছেন। এরপর আর বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি তিনি।
বাকি যে তিনজনের পরিচয় পাওয়া গেছে, তাঁরা হলেন ঢাকার ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র রোহান ইবনে ইমতিয়াজ, স্কলাসটিকা থেকে ও লেভেল পাস করা মীর সামেহ মোবাশ্বের ও মালয়েশিয়ার মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র নিবরাস ইসলাম। এঁদের মধ্যে রোহান গত ৩০ ডিসেম্বর থেকে এবং মোবাশ্বের ২৯ ফেব্রুয়ারি থেকে নিখোঁজ ছিলেন বলে তাঁদের পরিবার তখন থানায় সাধারণ ডায়েরি (জিডি) করেছিল।
গতকাল ডিবির একজন কর্মকর্তা প্রথম আলোকে জানিয়েছেন, গত ৩ ফেব্রুয়ারি জঙ্গি সন্দেহে তিন তরুণকে গ্রেপ্তার করা হয়েছিল। তাঁদের কাছ থেকে প্রথমে নিবরাস ইসলাম ও রোহান ইমতিয়াজের নাম পাওয়া যায়। ওই তথ্যের ভিত্তিতে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে দায়ের করা একটি মামলায় নিবরাসকেও আসামি করা হয়েছিল। অভিযোগ ছিল, তাঁরা বড় ধরনের নাশকতার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। পরে নিবরাসের খোঁজে পুলিশ তাঁর বাসায় গেলে পরিবার থেকে জানানো হয়, তিনি নিখোঁজ। এরপর নানা জায়গায় তাঁকে খোঁজাখুঁজি করে পুলিশ। পুলিশ এটাও জানতে পারে, তিনি মোনাশ বিশ্ববিদ্যালয়ের মালয়েশিয়া ক্যাম্পাসের ছাত্র হলেও দীর্ঘদিন ধরে ঢাকাতেই অবস্থান করছেন।
ঢাকায় পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) এ কে এম শহীদুল হক গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, গুলশানের ঘটনায় সন্দেহভাজন দুজনকে আটক করা হয়েছে। চিকিৎসা শেষে তাঁদের জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে। নিহত দুই পুলিশ কর্মকর্তার স্মরণে রাজারবাগ পুলিশ লাইনসে আয়োজিত শোকসভার পর সাংবাদিকদের এ কথা বলেন আইজি।
এর আগ পর্যন্ত পুলিশ একজনকে আটকের কথা বলে আসছিল। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুলিশ এখন যে দুজনকে জঙ্গি সন্দেহে আটকের কথা বলছে, তাঁদের একজন জাকির হোসেন ওরফে শাওন ওই রেস্তোরাঁর কর্মী। তাঁকে শুক্রবার মধ্যরাতের পরেই রক্তাক্ত অবস্থায় আটক করা হয়। গতকাল আরেকজনকে আটকের কথা বলা হলেও তাঁর পরিচয় জানা যায়নি।
র্যাবের মহাপরিচালক বেনজীর আহমেদ বলেন, ‘গুলশানে অভিযানে যেসব জঙ্গি মারা গেছেন, তাঁরা উচ্চবিত্ত পরিবারের সন্তান। তাঁদের মধ্যে একজন বাসা থেকে পাসপোর্ট নিয়ে গেছেন, কিন্তু মুঠোফোন ও ব্যক্তিগত জিনিসপত্র রেখে গেছেন। আমরা পর্যবেক্ষণ করে দেখেছি, নিখোঁজ হওয়ার পর আর তাঁরা পরিবারের সঙ্গে যোগাযোগ রাখেননি।’ গতকাল দুপুরে জাতীয় ঈদগাহ ময়দানের নিরাপত্তাব্যবস্থা পরিদর্শনে গিয়ে সাংবাদিকদের কাছে এসব কথা বলেন র্যাবের মহাপরিচালক। পরিবারের কোনো সন্তান নিখোঁজ হলে তিনি দ্রুত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে জানানোর পরামর্শ দিয়েছেন।
ঢাকা মহানগর পুলিশ গতকাল জানিয়েছে, মহানগর ডিবির একদল কর্মকর্তাকে মামলার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে। তাঁরা ঘটনাস্থল থেকে জব্দতালিকা, লাশের সুরতহাল প্রতিবেদনসহ আনুষঙ্গিক কাজ গুটিয়ে এনেছেন। তবে জঙ্গিরা কীভাবে, কোন পথে গুলশান এলাকার কড়া নিরাপত্তা ডিঙিয়ে ওই রেস্তোরাঁয় ঢুকলেন, সে বিষয়ে এখনো কিছু জানা যায়নি। পুরো গুলশান এলাকায় পুলিশ ও গুলশান সোসাইটির উদ্যোগে ক্লোজড সার্কিট (সিসি) ক্যামেরা লাগানো হলেও গতকাল পর্যন্ত সেগুলোর ফুটেজ দেখে জঙ্গিদের গতিবিধির বিষয়ে কিছু জানায়নি পুলিশ।
আক্রান্ত রেস্তোরাঁটির একজন নিরাপত্তাকর্মী বলেছেন, ওই দিন একটি মাইক্রোবাস সন্দেহভাজন জঙ্গিদের নামিয়ে দিয়ে গেছে। পুলিশ এখন পর্যন্ত ওই নিরাপত্তাকর্মীর বক্তব্যের সত্যাসত্য যাচাই করেনি বলে জানা গেছে। গুলশান এলাকার সিসি ক্যামেরাগুলোতে যানবাহন শনাক্তকরণের (ভেহিক্যাল ট্র্যাকিং) ব্যবস্থা থাকলেও এখনো জঙ্গিদের বহনকারী বাহনটি শনাক্ত হয়নি। তবে কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাঁরা পুলিশের সিসি ক্যামেরার ফুটেজসহ ওই রেস্তোরাঁর আশপাশের ভবনের ফুটেজ সংগ্রহ করেছেন। বিভিন্ন সংস্থার কর্মকর্তারা সেগুলো দেখছেন।