আসামি ১০ হাজারের বেশি, গ্রেপ্তার ৪৬১

নোয়াখালী ও কুমিল্লায় ৪৪টি মামলা করা হয়েছিল। এসব মামলায় এজাহারে নাম থাকা অনেক আসামিও ধরাছোঁয়ার বাইরে।

পূজামণ্ডপে হামলা ও হত্যার প্রতিবাদে সারা দেশে নানা কর্মসূচি পালিত হয়
ফাইল ছবি

দেশে গত বছর দুর্গাপূজার সময় হিন্দু সম্প্রদায়ের মন্দির, মণ্ডপ ও বাড়িঘরে হামলার ঘটনায় সবচেয়ে বেশি মামলা হয়েছিল নোয়াখালীতে। সংখ্যা ৩২। এসব মামলায় ৯ হাজারের বেশি মানুষকে নামসহ ও অজ্ঞাতনামা আসামি করা হয়। আসামিদের মধ্যে ৩০১ জনকে গ্রেপ্তার করতে পেরেছে পুলিশ। সংখ্যার তুলনায় আসামি গ্রেপ্তারের হার ৩ শতাংশের মতো।

একই চিত্র কুমিল্লায়। সেখানেও বিপুলসংখ্যক মানুষকে আসামি করা হয়েছে। ঘটনার তিন মাস পর দেখা যাচ্ছে, এজাহারে নাম থাকা আসামিদের অনেককে পুলিশ ধরতে পারেনি।

এসব তথ্য পাওয়া গেছে আপিল বিভাগে দাখিল করা রাষ্ট্রপক্ষের প্রতিবেদন থেকে। সম্প্রতি মামলার তথ্যাদিসংবলিত প্রতিবেদন আদালতে দাখিল করা হয়। তিন জেলার তথ্যে দেখা যায়, নোয়াখালীতে ৩২টি, কুমিল্লায় ১২টি ও রংপুরে ৫টি—মোট ৪৯টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় মোট ৫৩৮ জন আসামিকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।

এই তিন জেলার মধ্যে নোয়াখালী ও কুমিল্লার ঘটনায় হওয়া মামলায় জ্ঞাত ও অজ্ঞাতনামা আসামি ১০ হাজারের মতো। বিপরীতে গ্রেপ্তার হয়েছেন ৪৬১ জন আসামি। ফলে দেখা যাচ্ছে, নোয়াখালী ও কুমিল্লায় আসামি সংখ্যার বিপরীতে গ্রেপ্তারের হার সাড়ে ৪ শতাংশ।

পিবিআইয়ের প্রধান অতিরিক্ত মহাপরিদর্শক বনজ কুমার মজুমদার প্রথম আলোকে বলেন, মামলাগুলোতে বহু লোককে আসামি করা হয়েছে। আসামি যে–ই হোক, পিবিআই প্রথমে নিশ্চিত হয়, তিনি ঘটনার সঙ্গে জড়িত কি না। জড়িত থাকার বিষয়ে নিশ্চিত হওয়ার পর তাঁকে গ্রেপ্তার করা হয়। এ কারণে হয়তো আসামি গ্রেপ্তারের হার কম। তিনি বলেন, অনেকগুলো মামলায় অগ্রগতি হয়েছে। কয়েকজন স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছেন।

সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তার করার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঢিমেতালে অবস্থান নিয়েছে। বেশির ভাগ আসামি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে।
রানা দাশগুপ্ত, সাধারণ সম্পাদক, হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ

নোয়াখালী

রাষ্ট্রপক্ষের তথ্যাদি পর্যালোচনায় দেখা যায়, নোয়াখালীর ৩২টি মামলায় এজাহারে ৪১২ জন আসামির নাম রয়েছে। অজ্ঞাতনামা হিসেবে রয়েছেন ৭ হাজার ৬৮৩/৯ হাজার ১৩৫ জন। এজাহারে নাম থাকা ১১৩ জন এবং সন্দিগ্ধ হিসেবে ১৮৮ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। সব মিলিয়ে গ্রেপ্তার আসামির সংখ্যা ৩০১। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, এজাহারে নাম থাকা ৭৩ শতাংশ আসামি ধরা পড়েনি। রাষ্ট্রপক্ষের তথ্যে দেখা যায়, নোয়াখালীতে পৃথক মামলায় ২৩ আসামি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন।

অবশ্য নোয়াখালী জেলা পুলিশ সুপার মো. শহীদুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ওই সব মামলার একটি বেগমগঞ্জ থানা-পুলিশ তদন্ত করছে। সেটির অভিযোগপত্র শিগগিরই দেওয়া হবে। বাকিগুলো সিআইডি ও পিবিআইয়ের হাতে।

কুমিল্লা

কুমিল্লা জেলায় ১২টি মামলায় ৯৪ জন আসামির নাম উল্লেখ করা হয়েছে। অজ্ঞাতনামা আসামি ১ হাজার ১০ জন। মোট আসামি ১ হাজার ১০৪ জন। এর মধ্যে এজাহারে নাম থাকা ৫১ জন এবং অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের মধ্যে ৯০ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। আর ১৯ জনকে গ্রেপ্তার দেখানো হয়েছে। সব মিলিয়ে গ্রেপ্তার আসামির সংখ্যা ১৬০। সুতরাং দেখা যাচ্ছে, কুমিল্লায়ও এজাহারে নাম থাকা অনেক আসামি এখনো গ্রেপ্তার হননি।

রাষ্ট্রপক্ষের তথ্য থেকে জানা গেছে, কুমিল্লার ঘটনায় ১৫ আসামি ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। জামিনে আছেন ১০ জন। ১২টি মামলার মধ্যে ছয়টি সিআইডি, চারটি পিবিআই ও দুটি থানা-পুলিশ তদন্ত করছে।

সিআইডির চট্টগ্রাম বিভাগের উপমহাপরিদর্শক মো. হেলাল উদ্দিন বদরী প্রথম আলোকে বলেন, তদন্তে অগ্রগতি আছে। আসামি গ্রেপ্তার হচ্ছেন।

রংপুরে পাঁচ মামলায় মোট আসামি কত, তা জানা যায়নি। পর্যালোচনায় দেখা যায়, পাঁচ মামলায় গ্রেপ্তার আসামির সংখ্যা ৭৭। দুটি মামলা সিআইডি ও তিনটি মামলা সংশ্লিষ্ট থানা-পুলিশ তদন্ত করছে।

‘ঢিমেতালে অবস্থান নিয়েছে’

দুর্গাপূজার সময় শুধু এই তিন জেলায় নয়, বিভিন্ন জেলায় হিন্দু সম্প্রদায়ের মণ্ডপ, মন্দির, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান ও বাড়িঘরে হামলার ঘটনা ঘটেছিল। গত বছরের ৬ নভেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদ সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছিল, গত বছরের ১৩ অক্টোবর থেকে ১ নভেম্বর পর্যন্ত দেশের ২৭টি জেলায় সাম্প্রদায়িক হামলা হয়েছে। উল্লেখ্য, ওই ঘটনাগুলোতে নয়জন (চারজন পুলিশের গুলিতে) নিহত হন।

হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত প্রথম আলোকে বলেন, সাম্প্রদায়িক দুর্বৃত্তদের গ্রেপ্তার করার ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ঢিমেতালে অবস্থান নিয়েছে। বেশির ভাগ আসামি এখনো ধরাছোঁয়ার বাইরে। তিনি বলেন, যাঁরা গ্রেপ্তার হয়েছেন, তাঁরাও জামিনে বেরিয়ে যাবেন, সে আশঙ্কা রয়েছে। কারণ, ১২০ দিনের মধ্যে অভিযোগপত্র দিতে না পারলে আদালত যেকোনো আসামিকে জামিন দিতে পারেন।

রানা দাশগুপ্ত আরও বলেন, তদন্ত ও আসামি গ্রেপ্তারের কার্যক্রম যেভাবে চলছে, তাতে সংখ্যালঘুদের ওপর হামলার পর দায়মুক্তির যে সংস্কৃতি, তা থেকে উদ্ধার হবে না। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে শূন্য সহনশীলতা (জিরো টলারেন্স) নীতির কথা বলা হয়েছিল।

[প্রতিবেদনটি তৈরিতে তথ্য দিয়েছেন নিজস্ব প্রতিবেদক, ঢাকানোয়াখালী]