এক মৌজাতেই মালেকের ৭ প্লট

গাড়িচালক মালেক ও তাঁর স্ত্রীর ছয়তলা দুটি বাড়ি। সম্পদের পুরো হিসাব এখনো পাওয়া যায়নি।

আবদুল মালেক
ছবি: সংগৃহীত

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের গাড়িচালক আবদুল মালেক ওরফে বাদলের সম্পদ আসলে কত, তা এখনো নিশ্চিত নয় আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তবে দুদক প্রাথমিক অনুসন্ধানে ঢাকার একটি মৌজাতেই মালেক ও তাঁর স্ত্রী নার্গিস বেগমের সাতটি প্লটের সন্ধান পেয়েছে। এর মধ্যে দুটি প্লটে বহুতল ভবন রয়েছে। সব কটিই রাজধানীর তুরাগ থানার ধউর এলাকায়।

দুদক সূত্র জানায়, স্বাস্থ্য খাতের দুর্নীতি উদ্‌ঘাটনে অনুসন্ধান চালাতে গিয়ে গাড়িচালক আবদুল মালেকের নাম বেরিয়ে আসে। গত বছরের মার্চে তাঁর ব্যাপারে অনুসন্ধান শুরু হয়। এখন পর্যন্ত মালেক ও তাঁর স্ত্রীর যে সাতটি প্লটের সন্ধান পাওয়া গেছে, তার পাঁচটি মালেকের ও দুটি স্ত্রীর নামে। এর মধ্যে ধউর মৌজায় পৌনে ৭ শতক (৬৭০ অজুতাংশ) জমির ওপর মালেকের ছয়তলা একটি ভবন রয়েছে। ধউর মৌজায় আরও চারটি জমি আছে। একটি ৬ শতক, একটি সাড়ে ৬ শতক, একটি ৬ দশমিক ২৫ শতক, অন্যটি ২ দশমিক ৫ শতক।

আর নার্গিস বেগমের নামে ৬৭০ অজুতাংশ বা পৌনে ৭ শতক জমির ওপর একটি ছয়তলা ভবন রয়েছে। একই মৌজায় তাঁর আরেকটি প্লট রয়েছে। ১৯৯৬ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে ২০১১ সালের মার্চে এসব জমি কেনা হয়। এ ছাড়া প্রাথমিকভাবে মালেকের ৬৪ লাখ টাকা ব্যবসায় বিনিয়োগ পাওয়া গেছে।

স্বাস্থ্য খাতে দুর্নীতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে অভিযানের অংশ হিসেবে ২০ সেপ্টেম্বর তুরাগ থানার দক্ষিণ কামারপাড়ার বাসা থেকে আবদুল মালেককে গ্রেপ্তার করে র‍্যাব। পরদিন তাঁর বিরুদ্ধে র‍্যাব অবৈধ অস্ত্র ও জাল নোট ব্যবসার অভিযোগে দুটি মামলা করে। গ্রেপ্তারের সময় তাঁর কাছ থেকে একটি বিদেশি পিস্তল, একটি ম্যাগাজিন, পাঁচটি গুলি, দেড় লাখ জাল টাকা, একটি ল্যাপটপ ও একটি মোবাইল উদ্ধার করা হয় বলে র‍্যাব জানায়। দুই মামলায় মালেক ১৪ দিনের রিমান্ডে আছেন।

টঙ্গীর তুরাগের বামনারটেক এলাকায় গাড়িচালক আবদুল মালেকের সাততলা বাড়ি। বাড়িতে রয়েছে দুটি আলাদা ফটক। সামনে বিশাল ফাঁকা জায়গা। মঙ্গলবার দুপুরে
ছবি: প্রথম আলো

গতকাল বুধবার র‍্যাব-১–এর অধিনায়ক লে. কর্নেল শাফি উল্লাহ বুলবুল প্রথম আলোকে বলেন, আবদুল মালেককে গ্রেপ্তারের পর পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। র‍্যাব দুটি মামলাই তদন্ত করতে চায়। অনুমতি চেয়ে পুলিশ সদর দপ্তরে চিঠি পাঠানো হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় অনুমোদন দিলে তারা কাজ শুরু করবে।

দুদকের দায়িত্বশীল সূত্রগুলো বলছে, মালেক ও তাঁর স্ত্রীর সম্পদের অনুসন্ধান এখনো চলছে। ইতিমধ্যে এই দম্পতিকে সম্পদ বিবরণী দাখিল করতে নোটিশ দিয়েছে দুদক। অবৈধভাবে সম্পদ অর্জনের অভিযোগে দুদক ২১ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য বিভাগের ১১ কর্মকর্তা-কর্মচারীর সম্পদের বিবরণী চেয়ে নোটিশ দিয়েছে। তাঁদের আটজনের নয়জন স্ত্রীর (একজনের দুই স্ত্রী) সম্পদের হিসাবও চাওয়া হয়েছে। সেখানে মালেক ও তাঁর এক স্ত্রীও আছেন। এরই মধ্যে দুদক মালেকের আরেক স্ত্রী রাবেয়া খাতুনের খোঁজ পেয়েছে। তাঁরও সম্পদের হিসাব চেয়ে নোটিশ দেওয়া হবে।

২০ সেপ্টেম্বর আবদুল মালেককে গ্রেপ্তারের পর র‍্যাব গণমাধ্যমকে জানিয়েছিল, ঢাকায় তাঁর দুটি ৭ তলা ভবন, নির্মাণাধীন একটি ১০ তলা ভবন, জমি ও গরুর খামার খুঁজে পেয়েছে তারা। এ খোঁজ শেষ হয়নি। র‍্যাব সূত্রগুলো বলছে, আবদুল মালেকের স্ত্রী দুজন। প্রথম স্ত্রী নার্গিস বেগমের নামে তুরাগ এলাকার দক্ষিণ কামারপাড়া রমজান মার্কেটের উত্তর পাশে ৬ কাঠা জায়গার ওপর সাততলার দুটি আবাসিক ভবন আছে। নাম হাজী কমপ্লেক্স। এতে ফ্ল্যাটের সংখ্যা ২৪। ওই ভবনের সামনে আছে ১০-১২ কাঠার আরেকটি প্লট। ভবনের তৃতীয় তলায় তিনি সপরিবার থাকেন। বাকি ফ্ল্যাটগুলো ভাড়া দেওয়া আছে। বড় মেয়ে ‘বেবি’র নামে দক্ষিণ কামারপাড়ার ৭০ রাজাবাড়ি হোল্ডিংয়ে ১৫ কাঠা জায়গার ওপর ইমন ডেইরি ফার্ম নামে একটি গরুর ফার্ম আছে। এতে ৫০টি বাছুরসহ গাভি আছে। এর বাইরে রাজধানীর ২৩ ফ্রি স্কুল স্ট্রিট, হাতিরপুলে পৈতৃক সাড়ে ৪ কাঠা জায়গার ওপর ১০ তলা নির্মাণাধীন ভবন আছে। ভাই আবদুল খালেকের সঙ্গে বিরোধের কারণে ভবনটির নির্মাণকাজ আদালতের নির্দেশে বন্ধ রয়েছে।

বয়স নিয়ে জটিলতা

র‍্যাবের কাগজপত্রে আবদুল মালেকের বয়স ৬৩। তবে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, তাঁর বয়স প্রায় ৫৯। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিবহন কর্মকর্তা আলাউদ্দিন খান প্রথম আলোকে বলেন, আগামী বছরের ৯ জানুয়ারি আবদুল মালেকের অবসর প্রস্তুতিকালীন ছুটিতে যাওয়ার কথা ছিল। তিনি স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিবহন পুলের একজন গাড়িচালক ও তৃতীয় শ্রেণির কর্মচারী। অষ্টম শ্রেণি পাস মালেক ১৯৮২ সালে সাভার স্বাস্থ্য প্রকল্পের গাড়িচালক হিসেবে যোগ দেন। বছর চারেক পর অধিদপ্তরের পরিবহন পুলে যোগ দেন। গ্রেপ্তারের আগ পর্যন্ত তিনি প্রেষণে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিবহন পুলের গাড়িচালক ছিলেন। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ চিকিৎসক নেতাদের আনুকূল্য পেয়ে তিনি বিপুল সম্পদ ​গড়েছেন।

এদিকে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক (প্রশাসন) মোস্তফা খালেদ আহমদ গতকাল আবদুল মালেকের ব্যাপারে গণমাধ্যমে একটি বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়েছেন। তাতে তিনি বলেছেন, স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কোনো পরিবহন পুল নেই। এর সঙ্গে স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। মালেকের বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলোর দায় তাঁর ব্যক্তিগত।

সাহেদ ও চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা

রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে কোভিড চিকিৎ​সায় স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের করা চুক্তিকে অবৈধ বলেছে দুদক। এ অবৈধ চুক্তির ওপর ভর করেই করোনায় আক্রান্ত রোগীদের নমুনা বিনা মূল্যে পরীক্ষা করে অবৈধ পারিতোষিক বাবদ ১ কোটি ৩৭ লাখ ৮৬ হাজার ৫০০ টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন রিজেন্ট হাসপাতালের চেয়ারম্যান মো. সাহেদ।

এ অভিযোগে গতকাল মো. সাহেদ ও স্বাস্থ্য বিভাগের চার কর্মকর্তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে দুদক। কমিশনের উপপরিচালক মো. ফরিদ আহমেদ পাটোয়ারী মামলাটি করেন। অন্য আসামিরা হলেন স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের সাবেক পরিচালক (হাসপাতাল ও ক্লিনিক) আমিনুল হাসান, উপপরিচালক (হাসপাতাল-১) ইউনুস আলী, সহকারী পরিচালক শফিউর রহমান ও গবেষণা কর্মকর্তা দিদারুল ইসলাম।

মামলার নথিতে দেখা যায়, মো. সাহেদ ও স্বাস্থ্য বিভাগের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দুর্নীতি, প্রতারণা ও অর্থ আত্মসাতের অপরাধের প্রমাণ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া রিজেন্ট হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্সদের থাকা-খাওয়ার বিল তুলে নেওয়ারও উদ্যোগ নিয়েছিলেন সাহেদ ও আসামিরা।

মামলার অভিযোগে বলা হয়েছে, আসামিরা একে অপরের যোগসাজশে লাইসেন্স নবায়ন বন্ধ থাকা রিজেন্ট হাসপাতালকে ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতালে রূপান্তর করে সমঝোতা স্মারক সই করেন। এ ছাড়া সরকারি প্রতিষ্ঠান নিপসমের ল্যাবে ৩ হাজার ৯৩৯ কোভিড রোগীর নমুনা বিনা মূল্যে পরীক্ষা করে অবৈধ পারিতোষিক বাবদ রোগীপ্রতি ৩ হাজার ৫০০ টাকা হিসাবে ১ কোটি ৩৭ লাখ ৮৬ হাজার ৫০০ টাকা গ্রহণ করে আত্মসাৎ করেন তাঁরা। রিজেন্ট হাসপাতালের চিকিৎসক, নার্স, ওয়ার্ড বয় ও অন্যান্য কর্মকর্তার খাওয়ার খরচ বরাদ্দের বিষয়ে ১ কোটি ৯৬ লাখ ২০ হাজার টাকা মাসিক চাহিদা তুলে ধরে তা স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ে পাঠান।

রিজেন্ট হাসপাতালের সঙ্গে কোভিড চিকিৎ​সার জন্য করা চুক্তিকে দুদক অবৈধ বললেও চুক্তির সঙ্গে সম্পৃক্ত সচিব ও মহাপরিচালক (ডিজি) সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। যদিও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তৎকালীন সচিব আসাদুল ইসলাম ও অধিদপ্তরের মহাপরিচালক আবুল কালাম আজাদকে দুদক জিজ্ঞাসাবাদ করেছিল।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে দুদক সচিব দিলোওয়ার বখত সাংবাদিকদের বলেন, অনুসন্ধানে যাঁদের বিরুদ্ধে মামলা করার মতো তথ্যপ্রমাণ পাওয়া গেছে, শুধু তাঁদের আসামি করা হয়েছে। যাঁদের বিরুদ্ধে আসামি করার মতো পর্যাপ্ত তথ্যপ্রমাণ পাওয়া যায়নি, তাঁদের বিষয়টিও তদন্তে খতিয়ে দেখা হবে।

সাবেক সচিবের নির্দেশেই এ চুক্তি করা হয়েছে বলে গণমাধ্যমে খবর এসেছে, তারপরও কেন আসামি করা হলো না—এ প্রশ্নের জবাবে দুদকের সচিব বলেন, ‘গণমাধ্যমে আমরাও বিষয়টি দেখেছি। কারও মৌখিক নির্দেশে আর্থিক সংশ্লেষের মতো কোনো কাজ সম্পন্ন করার আইনি সুযোগ নেই।’

রিজেন্ট হাসপাতালের লাইসেন্স সর্বশেষ কবে নবায়ন করা হয়েছে, জানতে চাইলে দুদক সচিব দিলোওয়ার বখত বলেন, ২০১৪ সালের ৩০ জুনের পর থেকে হাসপাতালটির লাইসেন্স আর নবায়ন করা হয়নি।