একটা শটগান ও ফারুকের জেদ

২০১৬ সালের ১ জুলাই। রাত সাড়ে আটটার পরে ওয়্যারলেসে বার্তা আসে হোলি আর্টিজানে যাওয়ার। বুলেটপ্রুফসহ হাতে-পায়ে সুরক্ষা সরঞ্জাম পরার নির্দেশনা ছিল। এর পরপরই হোলি আর্টিজান বেকারিতে সবার আগে যান গুলশান থানার উপপরিদর্শক (এসআই) ফারুক হোসেন, সঙ্গে ছিল টহল দল। সেখানে তাঁর দলের সঙ্গে জঙ্গিদের সরাসরি গোলাগুলি হয়। জঙ্গিদের ছোড়া গ্রেনেডের বিস্ফোরণে তাঁর দুই সহকর্মী আহত হন।
দীর্ঘদিন ধরেই চিকিৎসা নিচ্ছেন ফারুক। এখনো হাঁটতে পারেন না। সর্বশেষ গত ১৫ জুন হাঁটুর অস্ত্রোপচারের জন্য থাইল্যান্ডে গিয়েছিলেন, ২৭ জুন ফিরেছেন। বাসাতেই রয়েছেন। গতকাল শুক্রবার কথা হয় ফারুকের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘সেদিনও শুক্রবার ছিল। এখনো সেই ঘটনা মনে হলে কিছুটা আতঙ্ক হয়। তবে সেই সময় এসব কোনো বোধই আসেনি। মনে হয়েছে এদের ঠেকাতে হবে, মানুষকে বাঁচাতে হবে। কেমন যেন একটা জেদ চেপে গিয়েছিল।’
সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিয়ে এসআই ফারুক হোসেন বলেন, ওই দিন ৮টা ১০ মিনিটে তিনি রাত্রিকালীন দায়িত্ব বুঝে নেন। গুলশানে হোটেল ওয়েস্টিনের পেছনে দায়িত্ব পালন করছিলেন। সেখানে ছোট একটা ঝামেলা চলছিল। রাত সাড়ে ৮টার পরে ওয়্যারলেসে আসে সেই বার্তা।
ফারুক ও তাঁর দলের সদস্যরা গাড়ি নিয়ে দ্রুত সেখানে চলে যান। তিনি বলেন, রাত ৯টার দিকে তাঁরা হোলি আর্টিজানে পৌঁছে যান। বেকারিটির দিকে এগোনোর সময় হঠাৎ তাঁদের গাড়ির সামনে রক্তাক্ত অবস্থায় একজন লোক দৌড়ে এসে পড়ে যান। ওই লোকটি জানান, তিনি একজন গাড়িচালক (আবদুর রাজ্জাক), কয়েকজন জাপানিকে নিয়ে এখানে এসেছিলেন। লোকটি তাঁকে বাঁচানোর আকুতি জানাচ্ছিলেন। রক্তাক্ত লোকটি পুলিশকে বলেন, হোলি আর্টিজানের ভেতরে ওই তরুণেরা অনেককে মেরে ফেলেছে। তাদের হাতে অস্ত্র ও পিঠে ব্যাগ ছিল।
এসআই ফারুক বলেন, এরপর তিনি হোলি আর্টিজানের সামনে চার-পাঁচটি ছেলেকে দেখতে পান। সবার হাতে অস্ত্র, তারা বের হয়ে আসছে। পুলিশ দেখেই তারা গ্রেনেড ছোড়ে। প্রথম গ্রেনেডের হামলাতেই প্রদীপ চন্দ্র দাস ও আলমগীর হোসেন নামে দুই কনস্টেবল আহত হন। এ অবস্থায় ফারুক অস্ত্রসহ গড়িয়ে (ক্রলিং) একটু আড়ালে অবস্থান নিয়ে সামনে যাওয়ার চেষ্টা করেন। ক্রলিং করে একটু বাঁয়ে সরে গিয়ে দেয়ালের পাশে আড়াল নিয়ে শটগান দিয়ে গুলি করা শুরু করেন। এ সময় জঙ্গিরা সেখানে আরেকটি গ্রেনেড ছুড়ে মারে। সেটি ছাদের কোনায় (ওপরেই) বিস্ফোরিত হয়। তিনি অল্পের জন্য রক্ষা পান।
ফারুক বলেন, তিনি তখন গুলশান বিভাগের উপকমিশনার মোশতাক আহমেদ খানকে ফোন করে বলেন, ‘স্যার, আমাদের ওপর হামলা হয়েছে, আমরা আটকে গেছি।’
জঙ্গিরা ‘আল্লাহু আকবার’ বলে গ্রেনেড ছুড়ছিল উল্লেখ করে ফারুক বলেন, তিনি নিজে আল্লাহু আকবার ধ্বনি শুনেছেন। ফোন করার পাঁচ মিনিটের মধ্যে গুলশান বিভাগের ডিসি বাড়তি ফোর্স নিয়ে ঘটনাস্থলে আসেন। এ সময় আহত কনস্টেবল দুজনকে উদ্ধার করা হয় এবং চারপাশ ঘিরে ফেলা হয়।
ঘটনায় হকচকিত হয়ে পড়েছিলেন অনেক পুলিশ সদস্যই। ধীরে ধীরে কর্মকর্তারা আরও ফোর্স নিয়ে আসতে শুরু করেন। অভিযান জোরদার হতে থাকে।
ততক্ষণে কত সময় গড়িয়েছে তা মনে করতে পারেন না ফারুক হোসেন। তিনি বলেন, ঘটনাস্থলে ঢাকা মহানগরের পুলিশ কমিশনার আসার পরে তাঁরা যখন এগোচ্ছিলেন, তখন একটা বড় বিস্ফোরণ হলে তিনি গুরুতর আহত হন। আগেই কিছুটা আহত ছিলেন। পরে দেখেন শরীর দিয়ে রক্ত ঝরছে। নড়তে পারছেন না। প্রায় আধা ঘণ্টা ওই অবস্থায় পড়ে ছিলেন। প্রচুর রক্তপাত হয় এ সময়। গ্রেনেড বিস্ফোরণে তাঁর ডান হাঁটু, ডান পায়ের গোড়ালি, বাঁ পায়ের পাতার নিচে, দুই হাতসহ বিভিন্ন স্থানে ১৯টি স্প্লিন্টার লাগে। হাঁটুসন্ধি ভেঙে যায়। পরে তাঁকে ইউনাইটেড হাসপাতালে নেওয়া হয়।
ফারুক বলেন, ওই অভিযানের সময় তাঁর পাশেই ছিলেন বনানী থানার ওসি সালাহউদ্দীন আহমেদ খান। বিস্ফোরণে আহত হয়ে পরে মারা যান সালাহউদ্দীন।
২০১৭ সালে সাহসিকতার জন্য পুলিশের সর্বোচ্চ পুরস্কার বাংলাদেশ পুলিশ পদকে (বিপিএম) ভূষিত হন ফারুক। পদক পাওয়া পুলিশ সদস্যদের নিয়ে পুলিশের বার্ষিক প্রকাশনায় বলা হয়েছে, হোলি আর্টিজানের ঘটনায় তিনিই প্রথম ঘটনাস্থলে উপস্থিত হন এবং সাহসিকতার সঙ্গে ঘটনা মোকাবিলা করেন। তাঁর যথাযথ ভূমিকার কারণে সন্ত্রাসীরা হোলি আর্টিজানের ভেতরে আটকে থাকতে বাধ্য হয়।