করোনাকালে লাশবাহী গাড়িতেও মাদকের চালান

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

করোনাকালে ইয়াবার চালান ধরা পড়েছে লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্সে, এর স্বর্গভূমি কক্সবাজারে। উত্তর ও পূর্ব সীমান্ত দিয়ে ঢুকছে ফেনসিডিল, গাঁজা আর হেরোইন। লাশ, খাদ্য, জরুরি পণ্য, কুরিয়ার সার্ভিসের গাড়িতে-ট্রাকে চড়ে মাদক যাচ্ছে দেশের সর্বত্র। ব্যবসার নিয়ন্ত্রণ ২৫ প্রবাসীর হাতে।

আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলোর কর্মকর্তারা আরও বলছেন, এই সময় দেশে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ছয়জন মাদক ব্যবসায়ী নিহত হয়েছেন। আর পুলিশের একজন সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) প্রথম আলোকে বলেছেন, সর্বকালে মাদক ব্যবসা জারি থাকার একটি কারণ—পুলিশের সঙ্গে ব্যবসায়ীদের সম্পৃক্ততা।

পুলিশ, র‌্যাব, মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তর ও সীমান্তরক্ষী বাহিনী বিজিবির কর্মকর্তারা মার্চের শেষ সপ্তাহ থেকে দেশজোড়া লকডাউনের সময় হাজারের বেশি অভিযানে বিপুল পরিমাণ মাদক জব্দ করার হিসাব দিয়েছেন। তাঁরা কয়েক হাজার কারবারিকে গ্রেপ্তার করেছেন।

কর্মকর্তারা বলেছেন, কারবারের অন্তত ২৫ জন হোতা পাঁচটি দেশে ছড়িয়ে আছেন। তাঁদের রাজনৈতিক ও অন্যান্য খুঁটির জোর আছে। দেশে তাঁদের ৪ হাজারের বেশি সহযোগী আছে, বছরের শুরুতে অধিদপ্তর যাঁদের নামের তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠিয়েছে।

তালিকা ধরে অধিদপ্তর সম্প্রতি ১০ দিনে প্রায় দেড় হাজার অভিযান চালিয়েছে। তবে র‌্যাব সদর দপ্তর ও ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) অভিযানের সংখ্যা জানা যায়নি। ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (অপরাধ ও অভিযান) কৃষ্ণপদ রায় অবশ্য প্রথম আলোকে বলেছেন, তথ্য পেলেই পুলিশ অভিযান চালাচ্ছে।

সব কর্মকর্তাই বলেছেন, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীগুলো সংক্রমণ প্রতিরোধের নানা দায়িত্ব পালনে ব্যস্ত রয়েছে। এ সুযোগটাই কাজে লাগাচ্ছেন মাদকের কারবারিরা।

করোনাকালে মাদকের রমরমা

গত ২৬ মার্চ থেকে ৩০ মে পর্যন্ত দেশজুড়ে করোনার লকডাউন চলেছে। পণ্যবাহী ও জরুরি সেবায় যুক্ত পরিবহন ছাড়া অন্য সব গণপরিবহন বন্ধ ছিল। কিন্তু লাশবাহী অ্যাম্বুলেন্স, ত্রাণবাহী ট্রাক, কুরিয়ারসেবা আর নিত্যপণ্যের গাড়িতে মাদকের ছোট–বড় চালান ধরেছে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ও অধিদপ্তর।

সদর দপ্তরের হিসাব অনুযায়ী র‌্যাব ঢাকাসহ সারা দেশে দেড় হাজারের বেশি মাদক কারবারিকে গ্রেপ্তার করেছে। রাজধানীতে ডিএমপির হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন প্রায় দুই হাজার ব্যক্তি এবং বিভিন্ন থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়েছে প্রায় ১ হাজার ২০০। বিজিবি এবং অধিদপ্তরও কয়েক শ ব্যক্তিকে গ্রেপ্তার করেছে।

>

মহামারির মধ্যেও দেশে মাদক ঢুকছে। ‘ক্রসফায়ার’ হচ্ছে। বাহিনীগুলো বলছে, প্রবাসী ২৫ হোতা ৪০০০ সহযোগী দিয়ে কারবার চালাচ্ছেন।

র‌্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন প্রথম আলোকে বলেন, লকডাউনে কৌশলে মাদক পরিবহন ও কেনাবেচার গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে তাঁরা মাদকবিরোধী অভিযান জোরদার করেছেন। এটা অব্যাহত থাকবে।

মাদক ব্যবসায়ীরা বিচিত্র পন্থায় মাদক আনা-নেওয়া করছেন। ইয়াবাই প্রধান। গত ৬ এপ্রিল গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) কক্সবাজারের লিংক রোডে লাশবাহী একটি অ্যাম্বুলেন্স আটক করে। ‘আঞ্জুমান অ্যাম্বুলেন্স সার্ভিস’ লেখা গাড়িটিতে তল্লাশি চালিয়ে পুলিশ ২০ হাজার ইয়াবা বড়ি জব্দ করে।

অ্যাম্বুলেন্সে থাকা চারজন গ্রেপ্তার হন। ডিবির কর্মকর্তারা প্রথম আলোকে বলেছেন, তাঁরা কক্সবাজারের টেকনাফ, ভোলার তজুমদ্দিন ও চট্টগ্রামের সাতকানিয়ার নিবাসী। উখিয়া টিভি স্টেশনের পাশে একজন রোহিঙ্গা ব্যক্তির বাড়ি থেকে ইয়াবা তুলে তাঁরা চট্টগ্রামে যাচ্ছিলেন।

গত ২৯ এপ্রিল রাতে র‌্যাব-১১-এর একটি দল ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে একটি লবণ বোঝাই কাভার্ড ভ্যান থেকে ৫৯ হাজার ইয়াবা বড়ি জব্দ করে। সঙ্গে থাকা ব্যক্তিরা র‌্যাবকে বলেছেন, তাঁরা টেকনাফ থেকে ঢাকার ধামরাইয়ে মাল নিয়ে যাচ্ছিলেন।

গত ২১ মে রাতে আদাবর রিং রোডের মোড়ে নিরাপত্তাচৌকিতে র‌্যাব-২ কাঁঠাল ও ডাবভর্তি একটি পিকআপ আটক করে। পিকআপটিতে ‘জরুরি প্রাণী খাদ্য উৎপাদন কাজে নিয়োজিত’ স্টিকার সাঁটা ছিল। চালক, চালকের সহকারী ও দুই যাত্রীর প্রত্যেকের কাছে ৭ হাজার করে ইয়াবা বড়ি পাওয়া যায়। যাত্রী দুজনের পিঠের ব্যাগে একটি করে বন্দুক ও ছয়টি গুলি ছিল।

অভিযান পরিচালনাকারী পুলিশ সুপার মহিউদ্দিন ফারুকী প্রথম আলোকে বলেন, দলটি কক্সবাজার থেকে ইয়াবার চালান পৌঁছে দিতে ঢাকায় এসেছিল। তারা গাজীপুরেও চালান নেয়। র‌্যাবকে তারা বলেছে, মাদক কারবারিদের লোকজন আরেকটি গাড়িতে তাদের পাহারা দিয়ে কক্সবাজার জেলা পার করিয়ে দেয়। নিরাপত্তাচৌকি দেখলে অগ্রগামী পাহারাদারেরা মুঠোফোনে তাদের সতর্ক করে দেয়।

গত ২৮ মে বিকেলে র‌্যাব-২-এর একটি দল ঢাকার আশুলিয়ায় কুরিয়ারসেবার একটি গাড়িতে শিশুখাদ্যের মধ্যে থাকা দেড় কেজির বেশি হেরোইন জব্দ করে। পিকআপে থাকা দুই ব্যক্তিকে আটক করা হয়। তাঁদের একজন নারী।

১ জুন অন্য একটি দল টেকনাফ থেকে কারওয়ান বাজারে আসা একটি কাভার্ড ভ্যান আটক করে। ভ্যানটির পেছনের দরজার ঝালাই ভেঙে স্যাভলন সাবানের প্যাকেটে ভরা ১৫ হাজার ইয়াবা বড়ি পাওয়া যায়। প্যাকেটের গায়ে লেখা ছিল ‘নট ফর সেল’।

কক্সবাজার র‌্যাব-১৫-এর অধিনায়ক উইং কমান্ডার আজিম আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, গত সপ্তাহে মিয়ানমার থেকে আসা আদার একটি ট্রাক ঢাকায় যাচ্ছিল। র‌্যাব সদস্যরা চালকসহ সেটা আটক করে ৪২ হাজার ইয়াবা বড়ি পান।

কক্সবাজার ৩৪ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল আলী হায়দার আজাদ প্রথম আলোকে বলেছেন, চলতি বছর এযাবৎ বিজিবি প্রায় সাড়ে ৪৫ কোটি টাকার ইয়াবা জব্দ করেছে। ১৫ জুন উখিয়ার একটি জায়গায় ইজিবাইক থামিয়ে তিন যুবককে আটক করা হয়। তাঁদের কাছে একটি বস্তায় মরিচের গুঁড়ার মধ্যে দেড় লাখ বড়ি ইয়াবা ছিল।

কর্মকর্তারা বলেছেন, ২০১৮ সালে মাদকবিরোধী অভিযান ও ক্রসফায়ারের পর মিয়ানমার থেকে ইয়াবা আসা কমে গিয়েছিল। কিন্তু করোনাকালে নাফ নদী দিয়ে নৌযানে আর পণ্যবাহী ট্রাকে কক্সবাজারের টেকনাফ ও উখিয়ায় অনবরত ইয়াবার চালান আসছে।

একইভাবে চাঁপাইনবাবগঞ্জসহ উত্তরবঙ্গ এবং ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আখাউড়ায় ভারত সীমান্ত পেরিয়ে আসছে ফেনসিডিল ও গাঁজা। হেরোইন ঢুকছে রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ দিয়ে। অভিযানগুলো হয়েছে আগাম গোয়েন্দা তথ্যের ভিত্তিতে। সব চালানের তথ্য জানা যায় না।

মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ অধিদপ্তরের উচ্চপর্যায়ের সূত্র প্রথম আলোকে বলেছে, করোনার কারণে প্রতিষ্ঠানটির অভিযান বন্ধ ছিল। তারপর বিভিন্ন দল গত ২৫ মে থেকে ৩ জুন পর্যন্ত সারা দেশে বিশেষ অভিযান চালিয়ে ৩৮১ জনকে গ্রেপ্তার করেছে। জব্দ করা মাদকের মধ্যে ইয়াবা ছিল মূল।

অধিদপ্তরের পরিচালক পুলিশের উপমহাপরিদর্শক এ এফ এম মাসুম রব্বানী বলেন, করোনাকালে মাদক কারবারিরা সক্রিয় হয়েছে, তবে খুচরা বেচাকেনা কমে গেছে। এখন মাদকসেবীরা সরাসরি যোগাযোগ করে কিনছে।

২৫ প্রবাসী আর ৬ ক্রসফায়ার

তিন বাহিনী ও অধিদপ্তরের পদস্থ কর্মকর্তারা বলেছেন, ধরা পড়ছেন বাহক বা ছোট কারবারিরা। থাইল্যান্ডের ব্যাংকক এবং দুবাই, মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া ও সৌদি আরব থেকে হুন্ডিতে টাকা পাঠিয়ে মাদকের কারবারে বিনিয়োগ ও নিয়ন্ত্রণ করছেন অন্তত ২৫ জন প্রবাসী।

দেশগুলোতে প্রতিষ্ঠিত এই ব্যবসায়ীরা যাওয়া-আসার মধ্যে থাকেন। বেশির ভাগেরই বাড়ি কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম জেলায়। এলাকার রাজনৈতিক দলের নেতা আর প্রভাবশালীদের সঙ্গে তাঁদের সুসম্পর্ক আছে। তবে কোনো কর্মকর্তাই তাঁদের নাম বলতে চাননি।

এদিকে লকডাউনকালে র‌্যাবের সঙ্গে কথিত বন্দুকযুদ্ধে ছয়জন মারা গেছেন। তাঁদের কাছ থেকে প্রচুর ইয়াবা, ফেনসিডিল এবং অস্ত্র উদ্ধারের কথা বলেছে র‌্যাব।

গত ২৭ এপ্রিল গাজীপুরের পুবাইলেনিহত হন রবিউল ইসলাম ওরফে রবু (৩২)। ১৪ মে মধ্যরাতে রাজধানীর কড়াইল বস্তি এলাকায় নিহত হন আবদুল জলিল। তৃতীয়জন নিহত হন ২০ মে রাতে, আগারগাঁওয়ে পঙ্গু হাসপাতালের কাছে। ২২ মে রাতে গাজীপুরের টঙ্গীর হাজির মাজার বস্তি এলাকায় একসঙ্গে নিহত হন দুজন। শেষ ঘটনাটি ঘটে কাশিমপুরের তেতুইবাড়ি এলাকায় ৩১ মে রাতে।

সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক বলছেন, ‘ক্রসফায়ার’ করে মাদক ব্যবসা বন্ধ করা যাবে না। প্রথম আলোকে তিনি বলেন, মাদকাসক্তদের নিরাময় ও পুনর্বাসন ছাড়া গতি নেই। মাদক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি সেটা নিশ্চিত করতে হবে।

শহীদুল হক আরও বলেন, আইজিপি থাকাকালে বহু চেষ্টা করেও তিনি মাদক বন্ধ করতে পারেননি। পুলিশ মাদক ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে পয়সাকড়ি নেয়। তাঁর মতে, পুলিশের সম্পৃক্ততা না থাকলে অর্ধেক ব্যবসা বন্ধ হয়ে যাবে।