কৃষিজমিতে জলাশয় বানিয়ে মাছ চাষ প্রকল্প

যন্ত্রের সাহায্যে চলছে কৃষিজমি খনন। এখানেই মাছচাষের প্রকল্প করা হবে। সম্প্রতি জামালপুর সদরের শরিফপুর ইউনিয়নের বেড়াপাথালিয়া গ্রামে।  ছবি: প্রথম আলো
যন্ত্রের সাহায্যে চলছে কৃষিজমি খনন। এখানেই মাছচাষের প্রকল্প করা হবে। সম্প্রতি জামালপুর সদরের শরিফপুর ইউনিয়নের বেড়াপাথালিয়া গ্রামে। ছবি: প্রথম আলো

জামালপুর সদর উপজেলার শরিফপুর ইউনিয়নের বেড়াপাথালিয়া গ্রামে ১০০ বিঘা বিস্তীর্ণ কৃষিজমি খনন করে জলাশয় তৈরি করে মাছ চাষ প্রকল্প গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে।

গ্রামটির মো. গোলাম রব্বানী, মোহাম্মদ রাসেল ও লিটন মিয়া নামের তিন ব্যক্তি সরকারি বিধিনিষেধ তোয়াক্কা না করে প্রভাব খাটিয়ে তিন ফসলি কৃষিজমি খনন করে মাছ চাষ প্রকল্প তৈরি করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। প্রশাসন নিষেধ করার পরও তাঁরা খননকাজ চালিয়ে যাচ্ছেন।

গত রোববার সরেজমিনে দেখা যায়, বেড়াপাথালিয়া এলাকায় বিশাল একটি বিস্তীর্ণ কৃষিজমির মাঠ। কয়েকটি বাড়িঘর ছাড়া তার চারদিকে শুধু কৃষিজমি। বেড়াপাথালিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পশ্চিম পাশে বিশাল কৃষিজমিটি এক্সকাভেটর দিয়ে খনন করা হচ্ছে। খননকাজের দক্ষিণ পাশে কৃষক রবিউল ইসলামের ঘরবাড়ি। চারপাশে জলাশয় তৈরি হওয়ায় তাঁর ঘরবাড়ি ভেঙে অন্যত্র সরিয়ে নিচ্ছেন। তাঁর মতো একই
অবস্থা কৃষক রফিকুল ইসলামেরও। দুটি ঘরবাড়ির চারপাশে কৃষিজমির মাটি কেটে জলাশয়ের পাড় তৈরি করা হচ্ছে।

স্থানীয় কয়েকজন বাসিন্দা জানান, একই ইউনিয়নের গোদাশিমলা গ্রামে প্রায় তিন বছর আগে দেড় শ বিঘা আবাদি জমি খনন করে কৃত্রিম জলাশয় তৈরি মৎস্য খামার গড়ে তোলেন এই তিন ব্যক্তি। মৎস্য খামার সম্প্রসারণ করতে বেড়াপাথালিয়া এলাকার কৃষিজমির মালিকদের ধান চাষের চেয়ে অতিরিক্ত লাভের কথা বলে ১০০ বিঘা জমি লিজ নেন তাঁরা। এই জমিতে জলাশয় তৈরি করতে গত কয়েক মাস ধরে এক্সকাভেটর দিয়ে খনন করা হচ্ছে। এই জমি তিন ফসলি কৃষিজমি ছিল। শত শত বছর ধরে এসব জমিতে কৃষকেরা আমন, আউশ, বোরো, সরিষাসহ সারা বছর ধরে বিভিন্ন ফসল আবাদ করে আসছেন। বছরে প্রতি বিঘা আট হাজার টাকায় ভাড়া নিয়ে এবং কারও কারও কাছ থেকে জোর করে কম দামে জমি কিনে নিয়ে জলাশয় তৈরি করছেন তিনজন। সেই জলাশয়ে তৈরি করা হচ্ছে মৎস্য খামার।

বেড়াপাথালিয়ার কৃষক মো. রফিকুল ইসলাম অভিযোগ করেন, প্রভাবশালী চক্রটির মৎস্য খামারের মাঝখানে পড়েছে তাঁর এবং প্রতিবেশী আরও কয়েকজনের বসতভিটা। তাঁরা জমি ভাড়া দেননি। তাই প্রভাবশালী চক্রটি তাঁদের নানাভাবে ভয়ভীতি ও হুমকি দিচ্ছে। মাছ চাষের নামে গোটা এলাকার কৃষিজমি নষ্ট করা হচ্ছে। এতে করে কৃষিজমি কমে যাচ্ছে।

রফিকুল ইসলাম আরও অভিযোগ করেন, সম্প্রতি চক্রটি স্থানীয় শিল্পপতি মো. জুলহাস উদ্দিনের প্রায় ১৭ বিঘা জমিসহ আরও প্রায় ৮৩ বিঘা জমি প্রলোভন দেখিয়ে ভাড়া নিয়ে বিশাল এলাকাজুড়ে খননকাজ শুরু করেছে। ইতিমধ্যে এক্সকাভেটর দিয়ে দিনরাত খননকাজ চলছে। এই জমিতে ধান, সরিষাসহ নানা ফসল ফলাতেন কৃষকেরা।

বেড়াপাথালিয়ার আরেক কৃষক রবিউল ইসলামের স্ত্রী পারুল আক্তার বলেন, বহু বছর ধরে তাঁরা এখানে বসবাস করেন। চাষাবাদ করে কোনোরকমে সংসার চালান। হঠাৎ করে তাঁদের বাড়ির চারপাশ দিয়ে বিশাল আকারে পুকুর খনন করার জন্য মাটি কাটা হচ্ছে। চক্রটি তাঁদের জমিও চেয়েছিল। কিন্তু তাঁরা দিতে রাজি হননি। কিন্তু এখানে থাকারও কোনো অবস্থা নেই। চারপাশ মাটি দিয়ে পাড় বাঁধা হচ্ছে।

এ অবস্থায় বিপাকে পড়ে পারুল আক্তার বলেন, ‘আমরা কোন দিক দিয়ে চলাচল করব। তাই ঘরবাড়ি অন্যত্র ভেঙে নিয়ে যাচ্ছি। এসব কৃষিজমিতে পুকুর খনন না করতে অনেক বলা হয়েছিল। কিন্তু তাঁরা প্রভাবশালী হওয়ার কারণে কারও কথাই শোনেননি। অনেক কৃষক মিলে অভিযোগও দিয়েছিলেন। অভিযোগ পেয়ে প্রশাসনের লোকজনও এসেছিলেন। কিন্তু তাঁরা খননকাজ এখনো অব্যাহত রেখেছেন।’

কৃষিজমিতে জলাশয় তৈরির বিষয়ে গোলাম রব্বানী দাবি করেন, ‘আমরা কৃষকদের কাছ থেকে প্রভাব খাটিয়ে জমি ভাড়া নিইনি। ধান আবাদে লাভ হয় না বিধায় কৃষকেরাই আমাদের কাছে জমি ভাড়া দিয়ে লাভবান হচ্ছেন। অনেকেই জমি বিক্রি করে দিচ্ছেন। কাউকে এ ব্যাপারে কোনো হুমকি দেওয়া হয়নি। কারও জমি জোর করেও নেওয়া হয়নি।’

যোগাযোগ করলে জামালপুর সদর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) এস এম মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘কৃষিজমিতে বিশাল একটি জলাশয় তৈরির জন্য খননকাজের বিষয়ে অভিযোগ পেয়েছি। কাজটি বন্ধ রাখা নিয়ে প্রকল্পের মালিকের সঙ্গে কথা হয়েছে। সেখানে আমার কার্যালয় থেকে লোকজনও গিয়েছেন। খননকাজ বন্ধ হওয়ার কথা রয়েছে। তারপরও যদি খননকাজ চলে, তাহলে ওই ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।’

সদর উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফরিদা ইয়াছমিন বলেন, ওই এলাকায় গিয়ে গ্রামবাসীর অভিযোগের সত্যতা পাওয়া গেছে। বিশাল এলাকাজুড়ে কৃষিজমি খনন করে জলাশয় তৈরি করা হচ্ছে। তিনি নিজে জলাশয় তৈরির কাজ বন্ধ রাখতে নিষেধ করে এসেছিলেন। তারপরও যদি কাজ চলমান থাকে এবং মৎস্য খামারের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিরা সংশ্লিষ্ট বৈধ কাগজপত্র না দেখাতে পারলে প্রকল্পের কাজ বন্ধ করে দিয়ে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে।